
সরকারের অবহেলা আর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনিয়মের কারণে বাংলাদেশের ডাক বিভাগের কাক্সিক্ষত উন্নয়ন হয়নি। ফলে দিনে দিনে ডাক বিভাগের জনহিতকর কার্যকলাপ মানুষ ভুলে যেতে বসেছে। বিগত সরকারগুলোর সময়ে বড় বড় অনিয়ম এবং দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিচার না হওয়ায় রোধ করা যাচ্ছে না ডাক বিভাগের অনিয়ম দুর্নীতি। সেই সঙ্গে মুখ থুবড়ে পড়েছে ডাক বিভাগের সেবাকার্য। অথচ ডাক বিভাগের রয়েছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস। ডাক বিভাগের কর্মচারীরাই ছিলেন সরকার আর জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধনের অন্যতম।
প্রাচীনকালে ঘোড়ায় চড়ে দ্রুত সময়ে চিঠিপত্র পৌঁছে দিতে ডাক বিভাগ। চিঠিপত্র দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে অন্ধকার বর্ষণমুখর রাতেও ডাক পিয়ন ডাক নিয়ে চলতো। জীবন বিসর্জন দিয়ে রক্ষা করতো মূল্যবান চিঠিপত্র, টাকা-পয়সা। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্ব উন্নয়নের দিকে ধাবিত হলেও ডাক বিভাগ যেন ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে তার পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহে চিঠিপত্র বিলি করতে দিনের পর দিন লেগে যায়।
এখনো পার্সেল অফিসে ঢাকার বাইরে থেকে ঢাকায় পণ্য পাঠালে দুই দিনের কমে পৌঁছায় না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি সময় লাগে। যেখানে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় প্রতিদিন ট্রেন আসছে। যাচ্ছে সেখানে চট্টগ্রামের একটি চিঠি ডাকে ঢাকায় পৌঁছাতে তিন দিন সময় লাগবে কেন? এর উত্তর ডাক বিভাগকেই খুঁজতে হবে। এত সব অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েও সম্প্রতি পালিত হয়েছে বিশ্ব ডাক দিবস। দিবসটি উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মন ইউনূস এক বাণিতে বলেছেন, ডাক বিভাগকে বার্তা আদান প্রদানের মধ্যে সীমিত না রেখে এটিকে অর্থনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে রূপান্তর প্রয়োজন।
দিবসটি পালন উপলক্ষে রাজধানীর আগারগাঁও ডাক ভবনে প্রধান উপদেষ্টার ডাক ও টেলিযোগাযোগবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমেদ তৈয়ব বলেন, দেশের ঠিকানা ব্যবস্থাপনা পুরনো রয়ে গেছে। ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলের আদলে চলছে ঠিকানা ব্যবস্থাপনা। এসব দিয়ে হবে না। ডাক বিভাগের আধুনিকায়নের মাধ্যমে গ্রাম ও শহরের ঠিকানা ব্যবস্থাপনায় নতুন ধারায় প্রবর্তন করা হবে। সেক্ষেত্রে সরকার ডাক আইন সংশোধন করে হাল নাগাদ করবে।
তিনি আরো বলেন, ই-কমার্সকে একটি প্ল্যাটফর্মে নিয়ে আসা হবে। এটা ডাক বিভাগ থেকে ব্যবস্থাপনা করা হবে। তিনি অভিযোগ করেন ই-কমার্সের মাধ্যমে গত সরকারের সময় হাজার কোটি টাকা লুটপাট করা হয়েছে। এতে ই-কমার্স নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জীবন বীমা সেবা ও ডাক সঞ্চয়পত্র সেবা দেবে ডাক বিভাগ। অতীতের সকল অনিয়ম দূর করে একটি সময়োপযোগি পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
প্রযুক্তির যুগে ডাক বিভাগ এতটা পিছিয়ে থাকবে তা মেনে নেওয়া যায় না। তাই আমাদেরকে নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডাক বিভাগের কাজের দক্ষতা বাড়াতে হবে। দ্রুত জনগণের কাছে সেবা নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করতে হবে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বিগত সরকারের সময়ে গ্রামাঞ্চলে আধুনিক ডাকঘর স্থাপনের জন্য সরকার ৫৯৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দ করে। ওই প্রকল্পে অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগে প্রকল্পের পিডি পরবর্তীতে ডাক বিভাগের মহাপরিচালক সুধাংশু শেখর ভদ্রকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। এই সকর ডাকঘর স্থাপনের কেনাকাটায় অনিয়মের অভিযোগে দুদকের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় পোস্ট মাস্টার জেনারেল মোস্তাক আহমেদকে। তার বিরুদ্ধে ১৫ কোটি ১১ লাখ টাকার দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।
বিগত সরকারের সময় ডিজিটাল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস নগদ চালু হলেও দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি নগদে। দলীয় এবং দেশের বিশেষ জেলার লোকের হাতে নগদের ভার তুলে দেওয়ায় দুই হাজার ৩০০ কোটি টাকার দুর্নীতি ও পাচারের প্রমাণ রয়েছে দুদকের হাতে। বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করছে। অভিযোগ রয়েছে প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশের কল্যাণেও কাজ করে এ সেবা প্রতিষ্ঠানটি। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং নগদ পরিচালনা পর্ষদের নির্দেশে ২৫ জনের চাকরি চলে যায় নগদ থেকে। অভিযোগ রয়েছে বিগত সরকারের সময়ে দলীয় ও ইউনিয়ন করার কল্যাণে এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী ডাক বিভাগকে লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে। মানুষ সেবা না পেয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় ডাক বিভাগ থেকে। সেই সুযোগটি আরো কাজে লাগায় ডাক বিভাগের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর।
বাংলাদেশে ডাক বিভাগ (বিডিপিও) জাতীয় সংস্থা হিসেবে কাজ করে, যা দেশের ডাক সংক্রান্ত সকল পরিষেবা প্রদান করে। এটি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের (ডিওটি) অধীনে কাজ করে। এটি বাংলাদেশের ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের একটি অধিদপ্তর। এই বিভাগটি প্রধানত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ডাক দ্রব্যাদি গ্রহণ, পরিবহন ও বিলিকরণ, পত্র যোগাযোগ, সরকারি অফিস-আদালতের পত্র যোগাযোগ, বাণিজ্যিক ডাক সেবা, মূল্য অধিকরণ, ভ্যালু পেয়েবল (ভিপি) সেবা, বীমা সেবা, বাণিজ্যিক পার্সেল সেবা, মানি অর্ডার এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সেবা প্রদান করে। বিডিপিওর সদর দপ্তর ঢাকায় অবস্থিত এবং এটির দেশব্যাপী একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রয়েছে। বাংলাদেশের ডাক বিভাগ একটি গুরুত্বপূর্ণ সার্বভৌম সেবা সংস্থা হিসাবে কাজ করে এবং দেশের মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ ডাক বিভাগের স্লোগান- সেবাই আদর্শ। শেরশাহের শাসনামলে ১৭৭৪ সালে ভারতীয় উপমহাদেশে ডাক সার্ভিস চালু হয়। শেরশাহ ডাক যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভারতীয় উপমহাদেশে ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেছিলেন। ১৭৬৫ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশের দেওয়ানি লাভের পর শেরশাহের হাত ধরেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ১৭৭৪ সালে ‘বঙ্গীয় ডাক বিভাগ’ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়। তখন থেকে দীর্ঘ সময় ধরে এই বিভাগ দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বিশ্বে সর্বপ্রথম ডাক ব্যবস্থার প্রচলন হয় মিশরে, ২০০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে।
বাংলাদেশে প্রথম ডাকঘর স্থাপিত হয় চুয়াডাঙ্গায় ১৯৭১ সালে। দেশে বর্তমানে ৯৮৮৬টি ডাকঘর রয়েছে। বিশ্বের প্রথম ডাকটিকেট চালু হয় ইংল্যান্ডে ১৮৩০ সালে। ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম ডাক টিকিট চালু হয় ১৮৭৫ সালে।
বাংলাদেশ ডাক বিভাগ দেশের অর্থনীতি ও সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা, সরকার এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো প্রদান করে।
আজকালের খবর/ওআর