বাউবিতে দ্যুতিময় এক বছর অতি অল্পসময়ের মধ্যেই পেরিয়েছে অর্থাৎ দেখতে দেখতে পার হয়ে গেছে তিনশ’ পঁয়ষট্টি দিন। মূল্যবোধ, নিষ্ঠা ও স্বপ্নের আলোকযাত্রী একজন মণীষার সঙ্গে থেকে কাছ থেকে দেখেছি কীভাবে সেই অনিয়ন্ত্রিত শুরুটা সামলিয়েছেন। তার যোগদানের অল্প ক'দিন পর আমার যোগদান। তবে কর্মসূত্রে প্রথম থেকেই কাছাকাছি ছিলাম। অসম্ভব পরিশ্রমী একজন মানুষ কতটা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজে লেগে থাকতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। সমতালে কাজ করা প্রথম দিকে কঠিন ঠেকলেও পরের দিকে পা মিলাতে পেরেছি কিছুটা হলেও। গুণী এই অধ্যাপকের সান্নিধ্য পেয়ে ধন্য হয়েছি।
গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে দেশ ছিল এলোমেলো। সকলে সন্দিহান, দিগ্বিদিক শূন্য সকলে, পরিপার্শ্বিক বিশৃঙ্খলার নিকষ কালো পরিবেশ। অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছিল দেশের উচ্চশিক্ষার আকাশ, অনিয়মের কুয়াশা ও হতাশার দীর্ঘ ছায়া পাড়ি দিচ্ছিল জ্ঞানচর্চার সকল পথ—ঠিক তখনই এক ঝাঁক আলোকবর্তিকা হাল ধরেন শিক্ষার দিগন্তে। তারা যেন প্রভাতের প্রথম সূর্যরশ্মি, অন্ধকার ভেদ করে জানান দিলেন নতুন দিনের আগমনী বার্তা। তাদের মধ্যে অন্যতম এক আলোকযাত্রীর নাম অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক, জ্ঞানের ভাণ্ডার ও শিক্ষা-গবেষণার অনন্য গবেষক। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’র বড় দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়ে জাতীয় পর্যায়ে সুনেতৃত্বের পরিচয়ে পরিচিতি পেয়েছেন। সমাজ উন্নয়নে নেতৃত্ব দিয়ে ইতোমধ্যে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে সবকিছুর পর তিনি যে একজন শিক্ষক, শিক্ষকতা সম্পর্কিত নেতৃত্বে এসে দেশ সেবার মহান ব্রত পালনের মধ্য দিয়ে তিনি তা প্রমাণ করেছেন। আজ তিনি বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি)-এর কর্ণধার—দূরদৃষ্টি ও সততার প্রতীক একজন উপাচার্য। শিক্ষার চরম সংকট ও দুঃসময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, অভিভাবক, কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং শিক্ষকদের নিকট তিনি যেন আস্থা, ভরসা, ভালোবাসার এক নাম।
২০২৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর, যখন তিনি হাতে নিলেন দায়িত্বের প্রদীপ, কালক্ষেপণ না করে তখনই তিনি শুরু করে দিলেন অন্ধকার ভেদ করে আলোয় ভরা নতুন পথচলা। সেদিন থেকেই বাউবি যেন পেয়েছে নবজাগরণের বার্তা, স্বপ্নের ডানায় ভর করে এগিয়ে চলার দুরন্ত সাহস। মাত্র এক বছরের ব্যবধানে বাউবি পরিবারে তিনি আনতে সক্ষম হয়েছেন একগুচ্ছ মৌলিক পরিবর্তন। সকল ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা এবং গতি এনেছেন। প্রতিটি বিষয়ে আধুনিকীকরণ, ডিজিটাল রূপান্তর, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করেছেন। কারিগরি সক্ষমতা, গুণগত শিক্ষার মান, আইসিটি উন্নতিকরণ সহ শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশের নিশ্চয়তা দিয়েছেন। উদ্ভাবনে নতুন মাত্রা, দূরদৃষ্টি, জবাবদিহি ও গবেষণা সংস্কৃতির নতুন নতুন সংস্করণ প্রকাশ করে সুনাগরিক সৃষ্টির পথ দেখিয়েছেন। বাউবির তিন দশকের পথচলায় এই বিস্তৃত উন্নয়ন ধারাবাহিকতা সংশ্লিষ্ট সকল মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
শিক্ষা ও কর্মে দৃঢ় পদক্ষেপ: ড. ওবায়দুল ইসলামের কাছে শিক্ষা কেবল বইয়ের অক্ষরে সীমাবদ্ধ নয়—এটি মুক্তির সোপান, স্বাবলম্বনের সিঁড়ি, মানবিকতার সেতুবন্ধন। দায়িত্ব হাতে নিয়েই তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম জেনেও ঝাঁপিয়ে পড়েন সংস্কার অভিযানে।
প্রথমেই ছিন্ন করেন অনিয়মের সকল জট। পূর্ববর্তী প্রশাসনের রেখে যাওয়া পরীক্ষা, আর্থিক অস্বচ্ছতা ও সার্টিফিকেট জালিয়াতির অন্ধকার থেকে বাউবিকে বের করে আনেন স্বচ্ছতার আলোয়। বহুদিনের ঝুলে থাকা আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের ইন্টিমেশনে মেলে সমাধানের সুবাতাস। তিনি স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস সাপোর্ট অপারেশন ট্রেনিং (বিপসট); রবীন্দ্র সৃজনকলা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাউবির মধ্যে এক ঐতিহাসিক সমঝোতা স্মারক—যা খুলে দেয় বিজ্ঞান, শিক্ষা, গবেষণা ও বৃত্তি প্রসারের নতুন দুয়ার। দূরশিক্ষণের আলো আরো দূরে ছড়িয়ে দিতে চালু করেন পাইকগাছা ও শরনখোলায় দুটি নতুন উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্র—জ্ঞানের আলো যেন পৌঁছে যায় প্রত্যন্ত গ্রামে, সাধারণ মানুষের ঘরে ঘরে। ঢাকায় দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের জন্য উত্তরা’র তৃতীয় প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণ আজ প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া ১২টি উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্রে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে।
EARN Project-এর মাধ্যমে তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেন এক লাখ NEET যুবকের স্বপ্ন। বিশ্বব্যাংক ও যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের সহায়তায় যাদের কর্মসংস্থানের আশা আজ হয়ে উঠছে একান্ত বাস্তব। ইউনিসেফ-এর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গড়ে তোলেন দক্ষ যুব সমাজের বিকাশযজ্ঞ। শিক্ষকদের মানোন্নয়নে HEAT Project-এর মাধ্যমে তিনি শুরু করেন শিক্ষক প্রশিক্ষণের নতুন অধ্যায়—যা প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে বাউবির হাত ধরেই বাস্তবায়িত হয়। একইসঙ্গে NSDA-এর সঙ্গে সমঝোতা এবং CEMCA-র সহযোগিতায় Blended TVET প্রকল্পের মাধ্যমে কর্মশালা আয়োজন, নীতিমালা প্রণয়ন ও মিডিয়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ—সবকিছুর মধ্যেই তিনি রেখে চলেন নতুনত্বের সাহসী পদক্ষেপ।
প্রযুক্তি ও আধুনিকতার নতুন ছোঁয়া: তার কাছে শিক্ষা মানে কেবল বই নয়—শিক্ষা মানে প্রযুক্তির আলোয় উন্মুক্ত এক সমুদ্র—যেখানে সবার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত থাকে। তিনি আধুনিকায়ন করেন বাউবির মিডিয়া সেন্টার—যেখানে সৃষ্টি হয় নতুন প্রজন্মের শিক্ষা ভিডিও, এর মাধ্যমে জ্ঞান পৌঁছে যায় ছাত্রছাত্রীদের হৃদয়ের দোরগোড়ায়।
`শিক্ষা চ্যানেল’ চালুর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন তিনি বাস্তবে রূপ দেন। প্রতিদিন বিটিভিতে তিন ঘণ্টাব্যাপী আনুষ্ঠানিক, উপ-আনুষ্ঠানিক শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে বাউবিকে ঘরে ঘরে, প্রতিটি প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে উদ্যোগ নেন। সময়োপযোগী ও শিক্ষার্থী-বান্ধব সিলেবাস প্রণয়ন করে গড়ে তোলেন গুণগত শিক্ষার দৃঢ় ভিত্তি। প্রবাসী শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার ও টিউটরিং কার্যক্রমকে করে তোলেন আরো সহজ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য।
আর্থিক স্বচ্ছতা আনতে আধুনিকায়ন করেন ই-টেন্ডারিং ব্যবস্থা। বিগত ১৭ বছরের সিন্ডিকেট ভেঙে নতুনদের অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিয়ে দিগন্ত প্রসারী জনবান্ধব কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেন।
দুর্নীতি দমন ও স্বচ্ছতার নবদিগন্ত: তিনি জানেন—দুর্নীতির বিষবৃক্ষ উপড়ে না ফেললে কোনো প্রতিষ্ঠানে ফুল ফোটে না। তাই তিনি সাহস নিয়ে শুরু করেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান। গঠন করেন দু’টি পৃথক তদন্ত কমিটি। পূর্ববর্তী আমলের আর্থিক ও নিয়োগ দুর্নীতির জট খুলতে এবং বৈষম্য নিরসনে গঠন করেন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন এই কমিটি।
শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য স্বচ্ছ নিয়োগ নীতিমালা প্রণয়নে নেন যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ইতিহাস বিকৃতির মামলায় দীর্ঘদিন ধরে ঝুলে থাকা শিক্ষকদের পদোন্নতি দিয়ে বৈষম্য নিরসন করেন। একইভাবে কর্মকর্তাদের প্রমোশনের মাধ্যমে অনেক দিনের বৈষম্য দূর করেন।
ড. আবুল হাসনাত মোহা. শামীম
মানবিকতায় ভরপুর অভিভাবক: প্রশাসনের শীতল চেয়ারে বসলেও তিনি শাসক হয়ে উঠেননি—বরং তিনি অভিভাবক হয়েছেন। মানুষের হৃদয় ছুঁতে জানেন তিনি।
বাউবির প্রতিষ্ঠাতা ভাইস-চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. এম শমসের আলীকে ইমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে সম্মাননা প্রদান করে তিনি দেখিয়েছেন উদারতা ও ইতিহাসের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা। শিক্ষা পরিবারে পেয়েছেন উচ্চ প্রশংসা। প্রশাসনিক ও একাডেমিক গতিশীলতা আনতে দায়িত্বে নিয়োজিত করেন দুইজন প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর এবং একজন ট্রেজারার। যারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই সুনাম অর্জনকারী অধ্যাপক।
ঢাকায় দ্বিতীয় ক্যাম্পাসের জন্য উত্তরা তৃতীয় প্রকল্পে বর্তমানে জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়াধীন। স্থবির থাকা উপ-আঞ্চলিক কেন্দ্রসমূহের জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রমও আবার শুরু করেছেন নতুন করে। শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের স্থগিত গৃহঋণ পুনর্বহাল করে প্রমাণ করেছেন—মানুষের কল্যাণই তার প্রথম অঙ্গীকার।
তৃতীয় লিঙ্গের শিক্ষার্থীদের বাউবি’তে ভর্তির সুযোগ দিয়ে তিনি গড়ে তোলেন তাদের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ এক আশ্রয়স্থল। তাদের ফি মওকুফ করেন ৬০ শতাংশ পর্যন্ত—যা দেশের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন মানবিক উদ্যোগ। দূরশিক্ষণকে জনপ্রিয় করতে তিনি আয়োজন করেন বিশেষ সংবর্ধনা। নাটোরের ৭৫ বছর বয়সী শিক্ষার্থী সাদেক আলী প্রামানিককে সংবর্ধনা প্রদানের ঘটনাই হয়ে ওঠে মানবিকতার উজ্জ্বল এক দৃষ্টান্ত।
আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সেতুবন্ধন: জাতীয় পর্যায়ের সীমা পেরিয়ে তিনি খুলে দেন বৈশ্বিক সহযোগিতার দুয়ার। সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন National Open University (Nigeria), Afghanistan Online University, Yunnan Open University (China)-এর সঙ্গে। উল্লেখ্য, উপাচার্য UK Charity Commission for England and Wales এর আওতাধীন The Association of Commonwealth University (ACU) ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।
চালু করেন ‘সোনালী সেবা Gateway’, যার মাধ্যমে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি সংগ্রহ হচ্ছে একক পদ্ধতিতে—এর ফলে ফিরে এসেছে আর্থিক শৃঙ্খলা; অনলাইনে সহজলভ্য করেছেন সকল সেবা। প্রবাসী শিক্ষার্থীদের জন্য দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, দুবাই, কাতার ও ইতালিতে পরীক্ষা গ্রহণ ও টিউটরিং সেবা চালু করেন—যাতে জ্ঞানের আলো কোনো দূরত্বেই যেন আর থেমে না যায়।
আলোকবর্তিকা হয়ে পথচলার প্রতীক: অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলামের প্রতিটি পদক্ষেপ যেন আলোর রেখা—যা স্পর্শ করছে বাউবির প্রতিটি শাখা-প্রশাখা। তার সততা, দূরদৃষ্টি ও মানবিকতায় আজ বাউবি দাঁড়িয়ে আছে নবজাগরণের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে। যখন কোনো সৎ, কর্মচঞ্চল ও অমায়িক মানুষ শিক্ষার হাল ধরেন, তখন তিনি কেবল প্রশাসক নন—হয়ে ওঠেন স্বপ্নের কারিগর। অধ্যাপক ড. এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম সেই কারিগর, যিনি সততা, দূরদর্শিতা ও মানবিকতার মিশ্রণে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি)-কে নিয়ে গেছেন শিক্ষার আন্তর্জাতিক মানের উজ্জ্বল এক মানদণ্ডে।
লেখক : অধ্যাপক, গবেষক ও ট্রেজারার, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়।