মঙ্গলবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫
পার্বতীপুর রেলওয়ে লোকোমোটিভ কারখানা: সম্ভাবনা ও অব্যবস্থাপনা
মনিরুজ্জামান মনির
প্রকাশ: শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৯:১৭ পিএম
বাংলাদেশ রেলওয়ে কেবল একটি পরিবহন ব্যবস্থা নয়; এটি দেশের ইতিহাস, অর্থনীতি, সংস্কৃতি ও সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম-এই রেলপথ দেশের কোটি মানুষের স্বপ্ন, ভরসা ও দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী। অথচ আজ এই রেলওয়ের প্রাণশক্তি, অর্থাৎ লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন, একের পর এক বিকল হয়ে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো- যে কেন্দ্র থেকে লোকোমোটিভ রক্ষণাবেক্ষণ হওয়ার কথা, সেই পার্বতীপুর রেলওয়ে লোকোমোটিভ কারখানা দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতায় জর্জরিত।

কখনো গর্বের প্রতীক এই কারখানা আজ পরিণত হয়েছে ভগ্নদশার প্রতিচ্ছবিতে। এর প্রভাব পড়ছে গোটা রেলওয়ের কর্মক্ষমতায়। তাই সময় এসেছে খোলামেলা বিশ্লেষণ ও নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার। 
ইতিহাসÑগৌরবের শিকড়: পার্বতীপুর রেলওয়ে  লোকোমোটিভ কারখানার জন্ম ব্রিটিশ আমলে। উত্তরবঙ্গকে কেন্দ্র করে রেলওয়ের বিস্তার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে একটি কেন্দ্রীয় কারিগরি কারখানার প্রয়োজন দেখা দেয়। পাকিস্তান আমলে এটি আধুনিকায়ন করা হয় এবং স্বাধীনতার পর উত্তরাঞ্চলের একমাত্র লোকোমোটিভ কারখানা হিসেবে গড়ে ওঠে।

কারখানার কাজ: লোকোমোটিভের ওভারহলিং ও রক্ষণাবেক্ষণ, যন্ত্রাংশ তৈরি ও সংস্কার, খুচরা যন্ত্রাংশ উৎপাদন, বড় ধরনের মেরামত, প্রযুক্তি ও দক্ষ জনবল প্রশিক্ষণ। 

একসময় এখানে বছরে ৬০-৭০টি ইঞ্জিন ওভারহল হতো। আজ সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ২০-২৫ এ।

বর্তমান অবস্থা- ভগ্নদশার প্রতিচ্ছবি: পার্বতীপুর কারখানার বর্তমান চিত্র হলোÑ মোট যন্ত্রপাতির প্রায় ৪০ শতাংশ অকেজো, আধুনিক ডিজেল ইঞ্জিন মেরামতের সক্ষমতা নেই, দক্ষ প্রকৌশলী ও টেকনিশিয়ানের সংকট ভয়াবহ, খুচরা যন্ত্রাংশের তীব্র ঘাটতি, বাজেট বরাদ্দ অপর্যাপ্ত ও অকার্যকর, প্রশাসনিক জটিলতায় অচলাবস্থা। 

 একজন প্রবীণ কর্মচারীর ভাষায়- এখানে ইঞ্জিন ঢুকলে কখন বের হবে, কেউ বলতে পারে না। কাজের চেয়ে কাগজপত্রই বেশি নড়াচড়া করে।

সমস্যা, সংকট ও দুর্নীতি: যন্ত্রপাতির অপ্রতুলতা-পুরনো, অকেজো যন্ত্রপাতি দিয়ে আধুনিক এঊ, চৎড়মৎবংং জধরষ বা ইন্ডিয়ান মডেলের ইঞ্জিন মেরামত সম্ভব নয়।
জনবল সংকট- প্রকৌশলী, মেকানিক, ফিটার-সবক্ষেত্রেই অভাব। বিদ্যমান জনবলও যথাযথ প্রশিক্ষণ পাচ্ছে না।

দুর্নীতি ও অনিয়ম- টেন্ডার সিন্ডিকেট- রাজনৈতিক প্রভাবশালী ঠিকাদাররা প্রতিযোগিতা ছাড়াই কাজ নিয়ে  নেয়। ভুয়া যন্ত্রাংশ-আসল যন্ত্রাংশের পরিবর্তে নিম্নমানের বা জাল সরঞ্জাম সরবরাহ হয়। কাগজে-কলমে মেরামত-বাস্তবে পাঁচ ইঞ্জিন মেরামত, রিপোর্টে দেখানো হয় দশ। দালালচক্র- নিয়োগ ও বদলির বাজার নিয়ন্ত্রণ করে।

বাজেট ঘাটতি-বার্ষিক বরাদ্দের বড় অংশ বেতন-ভাতায় চলে যায়। মেরামত বা প্রযুক্তি উন্নয়নের জন্য অর্থ নেই।  প্রশাসনিক অচলাবস্থা- দীর্ঘসূত্রিতা, ফাইল টানাটানি, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপÑসব মিলিয়ে কার্যত অচল।

আন্তর্জাতিক তুলনা: ভারত-চিত্তরঞ্জন লোকোমোটিভ ওয়ার্কস বছরে শত শত ইঞ্জিন তৈরি করে। পাকিস্তান-রাইউইন্ড কারখানায় আধুনিক মেরামত ব্যবস্থা চালু। শ্রীলঙ্কা-সীমিত সম্পদ নিয়েও কার্যকরভাবে লোকোমোটিভ রক্ষণাবেক্ষণ করছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান ইঞ্জিন সচল রাখাই এখন চ্যালেঞ্জ।

জাতীয় অর্থনীতি ও জনজীবনে প্রভাব-ট্রেন দেরি ও বাতিল হওয়া, যাত্রী ভোগান্তি ও আস্থাহীনতা, পণ্য পরিবহন ব্যাহত হয়ে ব্যবসায়িক ক্ষতি ও নতুন ইঞ্জিন আমদানিতে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয়। 

এক ব্যবসায়ীর মন্তব্য- যখন রেল সময়মতো পণ্য পৌঁছাতে পারে না, তখন আমরা ট্রাকে নির্ভর করি। এতে খরচ বাড়ে, সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, আর রেলওয়ে আরো পিছিয়ে পড়ে।

দুর্নীতির বাস্তব উদাহরণ: ভুয়া খুচরা যন্ত্রাংশ-কয়েক কোটি টাকার যন্ত্রাংশ আমদানি হলেও সেগুলো কার্যত অকেজো। টেন্ডার কারসাজি-একাধিক কোম্পানি নামমাত্র কাগজ জমা দিয়ে একই গোষ্ঠীর হাতে কাজ তুলে দেয়। গোপন কমিশন-সরবরাহকারী থেকে শুরু করে অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তা পর্যন্ত সবাই ভাগ নেয়।

একজন টেকনিশিয়ান গোপনে বলেন, আমাদের হাতে যদি সঠিক যন্ত্রাংশ থাকত, অনেক ইঞ্জিন বাঁচানো যেত। কিন্তু ভেতরে যা ঘটে, তা বলার মতো নয়।

নতুন সংযোজন- কাঠামোগত সংকট: প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা-বিশ্বে রেলওয়ে দ্রুত বিদ্যুতায়নের পথে হাঁটছে। কিন্তু আমাদের কারখানা এখনো ডিজেল ইঞ্জিনের পুরনো প্রযুক্তিতে আটকে আছে।

গবেষণা ও উন্নয়নের অভাব-পার্বতীপুর কারখানায় কোনো গবেষণা বিভাগ নেই। ফলে নতুন প্রযুক্তি বা উদ্ভাবন আসার সুযোগও নেই।

দায়বদ্ধতার অভাব-অবহেলা বা ভুলের কারণে ইঞ্জিন বিকল হলেও দায়ী কর্মকর্তাদের কোনো জবাবদিহি নেই।

আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা: জাপান-রেল টেকনোলজির গবেষণায় সরকার ও বেসরকারি খাত একসঙ্গে কাজ করে। চীন-কারখানাগুলোকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে। ইউরোপ-ই-টেন্ডারিং ও স্বচ্ছ ক্রয়ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।

ভবিষ্যৎ করণীয় ও সুপারিশ: আধুনিকায়ন প্রকল্প: নতুন যন্ত্রপাতি, অটোমেশন ও ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক ব্যবস্থা। মানবসম্পদ উন্নয়ন: বিদেশি প্রশিক্ষণ, স্থানীয় ট্রেনিং ইনস্টিটিউট। স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণ: ই-টেন্ডারিং, দুর্নীতি দমন কমিশনের সক্রিয় নজরদারি। বাজেট বৃদ্ধি-আলাদা উন্নয়ন বাজেট বরাদ্দ। প্রশাসনিক সংস্কার-জটিলতা কমিয়ে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। গবেষণা বিভাগ স্থাপন-প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আলাদা সেল।

পার্বতীপুর লোকোমোটিভ কারখানা কেবল একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান নয়; এটি বাংলাদেশের রেলওয়ের অস্তিত্বের মূল ভরকেন্দ্র। আজ যদি এর সংস্কার ও আধুনিকায়ন না হয়, তাহলে পুরো রেলওয়ে খাত ধ্বংসের মুখে পড়বে।

আজ সময় এসেছে কঠোর রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রযুক্তিগত সংস্কার ও স্বচ্ছ প্রশাসনিক পদক্ষেপ নেওয়ার। একটি শক্তিশালী পার্বতীপুর কারখানা মানে স্বপ্নের রেলওয়েÑযা দেশের অর্থনীতি ও মানুষের আস্থাকে পুনরুজ্জীবিত করবে।

মনিরুজ্জামান মনির: সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং সভাপতি বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি। 

আজকালের খবর/আরইউ








http://ajkalerkhobor.net/ad/1751440178.gif
সর্বশেষ সংবাদ
ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস
দেবীদ্বারে প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ, এখন চলছে রঙ ও সাজসজ্জা
জেলা শ্রমিক লীগ সভাপতির ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার
বীর মুক্তিযোদ্ধাকে নানা সাজিয়ে: মিথ্যা তথ্যে চাকরি নিল কনস্টেবল তুহিন
অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে সোনার ভরি ১৯১১৯৬ টাকা
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বগি নম্বর খ
২১ দিনে রেমিট্যান্স এলো দুই বিলিয়ন ডলার
রাজশাহী থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে বাস চলাচল বন্ধ
ভোজ্যতেলের দাম লিটারে বাড়ছে ১ টাকা, ব্যবসায়ীদের আপত্তি
পুঁজিবাজার থেকে সবসময় মুনাফা আসবে এমন ধারণা ভুল : অর্থ উপদেষ্টা
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft