ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত না হয়ে ২০২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হলে ভৌগোলিক কারণে অবশ্যই এর অবস্থান বর্তমান স্থানে হতো না। মানসম্মত কোনো বিশ্ববিদ্যালয় জনবহুল ও বাণিজ্যিক পরিবেশে গড়ে উঠার নজির নেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়কে শুধু শ্রেণিকার্যক্রমের গণ্ডির মধ্যে বিবেচনা করা কোনোভাবেই সমীচীন হয় না। শিক্ষার্থীদের পূর্ণমাত্রায় আবাসিক সুবিধা ও অবকাঠামো না দিতে পারলে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার দৈন্যদশা থেকে কোনোভাবেই বের হয়ে আসা যাবে না। তবে শুধু বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির খাতিরে তৈরি করা হলে সেটি ভিন্ন বিষয়, যা সনদপত্র ও নাম সর্বস্ব হতে বাধ্য। ইতোমধ্যে এটি দৃশ্যমান হয়েছে যে বিগত সরকারের প্রতি জেলায় একটি করে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগটি শিক্ষার মান উন্নয়নে কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। তাই যেন-তেন প্রকারে জনবহুল কর্মব্যস্ত শহরের প্রাণকেন্দ্রে স্বল্প জায়গায় কোনো বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিপক্ষে সচেতন জনগোষ্ঠির কণ্ঠস্বর ক্রমশ স্পষ্টতর হচ্ছে। আবার ২০০৫ সালে ১৫০ বছরের পুরোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘সরকারি জগন্নাথ কলেজ’-কে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হলেও প্রতিষ্ঠানটি এখনো নানা সমস্যায় জর্জরিত এবং প্রায় একই ধরনের বা ক্ষেত্র বিশেষে ততোধিক সমস্যা ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়কেও মোকাবেলা করতে হতে পারে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমস্যাগুলো হলো- আবাসিক সমস্যা, নতুন ক্যাম্পাস নির্মাণে কালক্ষেপণ, বাজেটের অপর্যাপ্ততা, গবেষণার সীমিত সুযোগ, অপর্যাপ্ত অবকাঠামো, যাতায়াত সমস্যা ইত্যাদি। প্রতিষ্ঠা পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু মামলা বা আইনী জটিলতার মুখোমুখিও হতে হয়েছিলো জগন্নাথ বিশাববিদ্যালয়কে। লক্ষণীয় বিষয় হলো এ সমস্যাগুলোর উদ্ভব হয়েছে শুধুমাত্র সরকারি জগন্নাথ ‘কলেজ’কে জগন্নাথ ‘বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপান্তরের কারণে এবং দীর্ঘ ২০ বছরেও এসব সমস্যার সমাধান সম্ভব হয়নি। অপরদিকে নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে স্থাপিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এসব সমস্যা নেই বললেই চলে। যেখানে একটিমাত্র কলেজ জগন্নাথ কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করে এর সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষার কাম্যমান নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না- শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেখানে সাতটি কলেজের সাতটি পৃথক ক্যাম্পাসকে নিয়ে একটি বিশ্ববিদ্যালয় হলে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সহজেই অনুমেয়। আবার বিবেচ্য সাত কলেজের কোনো ক্যাম্পাস বা ক্যাম্পাসের ভূমির অংশবিশেষ যদি কোনো দাতাকর্তৃক ওয়াক্ফকৃত হয়ে থাকে তাহলে ঐ ওয়াক্ফ’র শর্তাবলী বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক। কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে বা প্রতিষ্ঠানে ওয়াক্ফকৃত ভূমি অন্য কোনো উদ্দেশ্যে বা প্রতিষ্ঠানে হস্তান্তর করা হলে ওয়াক্ফ অধ্যাদেশ, ১৯৬২ এবং ওয়াক্ফ (সম্পত্তি হস্তান্তর ও উন্নয়ন) বিশেষ বিধান আইন, ২০১৩ এর ধারা ৫ উপধারাসমূহের ব্যত্যয় ঘটে কিনা সে বিষয়টিও বিবেচনায় নিতে হবে।
মাস কয়েক পূর্বে একটি সংবাদপত্রের কলামে প্রস্তাবিত নতুন বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে লিখেছিলাম ‘ভবিষ্যতে প্রতিটি ক্যাম্পাস স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পৃথকীকরণের দাবি তুললে আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না’। লেখাটি প্রকাশের একমাসের মধ্যে তিতুমীর কলেজের কিছু শিক্ষার্থী তাদের কলেজকে ‘ঢাকা সেন্ট্রাল বিশ্ববিদ্যালয়’র অধীনে মেনে নিবে না মর্মে দাবী জানিয়েছেন। তারা স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় চায়। কারণ, তারাও হয়তো ভিন্ন বৈশিষ্ঠ্য বিশিষ্ট সাতটি ক্যাম্পাস নিয়ে গঠিত বিশাববিদ্যালয়ে সমস্যাবৃত্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছায়া দেখতে পেয়েছেন। এতদ্রুত এরুপ দাবীর মূল কারণ হলো সাত কলেজ নিয়ে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবী মেনে নেয়ার সময় আন্দোলনকারীদের বাইরে যারা সাধারণ শিক্ষার্থী রয়েছে তাদের মতামত না নেওয়া ও তাদের মনোভাবের মূল্যায়ন প্রতিফলিত না হওয়া। নিকট ভবিষ্যতে ক্রমান্বয়ে অন্য ক্যাম্পাসগুলো ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু তৈরি করে ডিসিইউ থেকে বের হয়ে যেতে চাইবে। এভাবে একসময় হারাধনের ছেলেদের মত ডিসিইউ অস্তিত্বের সংকটে পড়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
আবার সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হলে এসব কলেজের বঞ্চিত প্রায় দেড় লাখ শিক্ষার্থী অতিনিম্ন খরচে অনার্স-মাস্টার্স পর্যায়ে লেখাপড়ার সুযোগ হারাবে। এদের মধ্যে অবস্থাপন্নরা ছুটবে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যা মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের নাগালের বাইরে। ফলশ্রুতিতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্যিক প্রসার ঘটবে উচ্চমাত্রায় আর শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারগুলো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এক্ষেত্রে ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি এবং অদক্ষ জনশক্তি সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। জনশক্তি রপ্তানী ও শ্রমবাজরে এর বিরূপ প্রভাব অবশ্যম্ভাবীভাবে গোচরীভূত হবে। বেকারত্বের পাশাপাশি ছদ্মবেকারত্বের হার বৃদ্ধি পাবে। অদূর ভবিষ্যতে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত রেমিটেন্স তথা সামষ্টিক অর্থনীতিতে এর ঋণাত্মক প্রভাব দৃশ্যমান হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সার্বিক বিবেচনায় সাত কলেজ এখন শিক্ষা চিন্তকদের ভাবনার পাশাপাশি অর্থনীতিবিদদের ভাবনায়ও জায়গা করে নিচ্ছে। আন্দোলনকারী এবং সাধারণ মানের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে অভিভাবকদের কাছে ক্রমান্বয়ে সমস্যার প্রকটতা স্পষ্টতর হচ্ছে।
সাত কলেজের ক্যাম্পাসগুলোকে ডিসিইউ-এর বিভিন্ন অনুষদ বা বিভাগে বিভক্ত করে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে এবং চলতি শিক্ষাবর্ষে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে। ফলে কমপক্ষে আগামী চার বছর এ ক্যাম্পাসগুলোতে একই সময়ে দুই ধরনের শিক্ষার্থী যেমন- ঢাবি অধিভুক্ত পুরাতন শিক্ষার্থী এবং ডিসিইউ এর অধীনে সরাসরি ভর্তিকৃত নতুন শিক্ষার্থী পাশাপাশি অবস্থান করবে। এটি নিশ্চিত ভাবেই বলা যায় কারিকুলাম, শিক্ষার মান, শিক্ষার্থীর মান, আনুসঙ্গিক সুবিধাসহ সবক্ষেত্রেই এ দুই ধরনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে পার্থক্য থাকবে। সরকারি বেসরকারি সুবিধা লাভের ক্ষেত্রেও এখানে সমতা বিধান সম্ভব হবে না। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বৈষম্যের বেড়াজাল, অন্তঃকলহ ও বৈষম্যবিরোধী দাবি আদায়ের আন্দোলন শিক্ষাবান্ধব পরিবেশকে বিনষ্ট করতে পারে। আবার ক্যাম্পাসভিত্তিক বৈষম্য থেকে অদূর ভবিষ্যতে প্রতিটি ক্যাম্পাস স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পৃথকীকরণের দাবিও উঠতে পারে।
সত্যিকার অর্থে একটি মানসম্মত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে সম্পূর্ণ নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিকল্প নেই। সেক্ষেত্রে আপাতত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অথবা নতুন কোনো স্থানে অথবা সাত ক্যাম্পাসের কোনো একটি ক্যম্পাসের কিছু অংশে সীমিত আকারে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা যায়। শিক্ষক হিসেবে সাত কলেজ ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘নিয়মিত শিক্ষক নিয়োগ পেলে মূল কর্মস্থলে ফিরে যাবেন-শর্তে’ শিক্ষকগণকে সংযুক্ত করে শ্রেণিকার্যক্রম চালু করা যায়। একইসাথে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পর্যায়ক্রমে শিক্ষক নিয়োগ সম্পন্ন করে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্পের আওতায় ঢাকার নিকটবর্তী কোনো একটি বড় জায়গা বরাদ্দ, হস্তান্তর, আন্তর্জাতিক মানের নকশা প্রণয়ন সম্পন্ন করে দ্রুততম সময়ে নির্মাণ সম্পন্ন করা যায়।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেশে মানসম্মত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব যেমন রয়েছে, তেমনি মানসম্মত সরকারি কলেজেরও অভাব রয়েছে। যেকোনো বিবেচনায় আলোচ্য সাত কলেজ দেশের সবচেয়ে বৃহৎ ও মানসম্পন্ন সরকারি কলেজ। সাতটি সরকারি কলেজের বিনিময়ে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের মর্মার্থ হলো- একটি সমস্যা সমাধান করতে গিয়ে নতুন একটি সমস্যার প্রকটতা বৃদ্ধি করা। এরূপ সিদ্ধান্ত শিক্ষার সার্বিক মান ও প্রসারে কতটুকু ভূমিকা রাখবে তা সময়ই বলে দিবে যখন প্রায় দেড়লাখ শিক্ষার্থী মানসম্মত সরকারি কলেজে সরকারি খরচে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হবে। তাই শিক্ষার্থীদের দাবী অনুযায়ী দ্রুততম সময়ের মধ্যে ডিসিইউ-এর অধ্যাদেশ জারি করার পাশাপাশি বৃহৎ একটি জায়গা নির্ধারণ করে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য অগ্রাধিকার প্রকল্প গ্রহণ করা হোক। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার্থীরা নতুন অত্যাধুনিক একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্বিত শিক্ষার্থী হওয়ার সুযোগ পাবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের একটাই প্রত্যাশা ডিসিইউ যেন সমস্যাসংকুল আরো একটি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিরূপ না হয়ে ওঠে।
আশেকুল হক: সহযোগী অধ্যাপক, কবি ও কলামিস্ট।
আজকালের খবর/আরইউ