কথায় আছে না- যাকে দেখতে নারি, তার চলন বাঁকা। বাংলাদেশের মানুষের হলো এই অবস্থা। যাকে অপছন্দ- তার চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে ছাড়বো! কি বিস্মিত জাতি আমরা! কেবলমাত্র বিরোধিতার জন্য কিইনা করি আমরা! প্রয়োজনে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গ করেই ছাড়ি! একটা জাতির মননে এত বিরোধিতাবাদের বিষ আর প্রতিহিংসা কীভাবে স্ব-জাতির সভ্যতা ও স্বকীয়তাকে ধ্বংস করে- এই বাংলাদেশকে দেখেই তার প্রমাণ মিলবে। স্বাধীনতা অর্জনের অর্ধশতকের বেশি সময় পথ পেরিয়ে এসে যে জাতি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে-বিপক্ষে বিষোদগার করে তাদের আবার স্বকীয়তা কীসের? নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার গায়ে আমরা কেবলমাত্র বিরোধী মনোভাবের কারণে কলঙ্কের কালিকা লেপন করছি নির্বিঘ্নে! আমাদের বিরোধিতাবাদের ফলশ্রুতিতে দেখছি- একটি আশ্চর্য প্রজন্ম উদ্ভট, অবিশ্বাস, অস্বস্তিদায়ক আচরণ করছে মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে! এমনতর ন্যাক্কারজনক অপকর্ম করেও তারা উল্লাসে উগ্র আস্ফালন করছে আর আমরা হা হা করে তা দেখছি। আমাদের দেশপ্রেম আর চেতনা যেন শীতঘুমে নিমজ্জিত হয়েছে। কী লজ্জা আমাদের! আহা কী লজ্জা!! দেশের চলমান অবস্থাদৃষ্টে আসুন বিশৃঙ্খলতা সৃজনের একটি গল্প শোনা যাক-
একটি গ্রামে বহুদিন ধরে বাস করত নিরীহ কিছু ভেড়া। তারা একে অপরের পাশে দাঁড়াতো। সকালবেলা সূর্যের আলোয় মাঠে ঘুরে বেড়াতো। রাতে একসাথে জড়ো হয়ে ঘুমাতো। তাদের মাঝে ছিল না কোনো বিষ, কোনো চাতুরীপনা। ...শুধু ছিল একে অপরের প্রতি সহানুভূতি ও সরলতা। এই দেখে পাহাড়ের ওপারে একদল নেকড়ে সেই ভেড়াগুলোর একতা আর সহ্য করতে পারছিল না। ভেড়াদের ঐক্য, একতাই ছিল নেকড়েদের জন্য ভয়ংকর। তাই তারা সিদ্ধান্ত নিলÑ ভেড়াদের ভিতর থেকেই ঘৃণা ছড়াতে হবে। ভেড়াদের গায়ে নেকড়ের বিষ ঢুকিয়ে দিতে হবে। কিন্তু এমনভাবে যেন কেউ টের না পায়।
নেকড়ে এক গভীর রাতে এক নরম উলের মুখোশ পরে গ্রামে এসে হাজির হয়ে বললো- ভাই ও বোনেরা, তোমরা এতদিন অনেক কষ্টে থেকেছো। এখন তোমাদের উন্নতির সময় এসেছে। কিন্তু উন্নতির জন্য শক্তি লাগে, আর শক্তির জন্য চাই বিষাক্ত দাঁত। কথা শুনে ভেড়ারা একটু চমকে উঠলো। আমরা তো দাঁতহীন! আমরা কারো ক্ষতি করতে পারি না! তখন নেকড়েটি শান্ত কণ্ঠে বললোÑ তোমাদের ক্ষতি করতে হবে না। শুধু একটু জবাব দিতে শিখো। গর্জন শিখো, হুংকার দাও। আমি তোমাদের শেখাবো কীভাবে মাথা উঁচু করে থাকতে হয়। আমার কাছ থেকে একটা দাঁত নাও আর গর্জন শিখে নাও।
একটা ভেড়া, একটু সাহসী, একটু অভিমানী, এগিয়ে এলো। সে ভাবলো, সবাই আমাকে দুর্বল ভাবে, আমি কি চিরকাল এভাবেই থাকবো? তাই সে মুখোশপরা নেকড়ের কাছ থেকে ‘দাঁত’ নিয়ে নিলো। প্রথম কয়েকদিন কিছুই হয়নি। তারপর আস্তে আস্তে তার কণ্ঠে রুক্ষতা এলো, চোখে আগুন এলো, বন্ধুদের সঙ্গে বিতর্ক, পরে ঝগড়া, পরে হিংস্রতা। সে বুঝলো না, কবে তার হৃদয়ের কোমলতা হারিয়ে গেছে। সে আর ভেড়া ছিল না। ভেড়ার অবয়বে সে হয়ে উঠেছে মায়াহীন এক নেকড়ের ছদ্মবেশ। আর এভাবেই, একে একে অনেক ভেড়া মুখোশধারী নেকড়ের কাছে বিষাক্ত দাঁত নিতে শুরু করলো। তাদের শিখিয়ে দেওয়া হলোÑ ‘জয় শুধু শক্তির। ন্যায়ের কিছু নেই, আদর্শ হলো দুর্বলদের সান্ত্বনা। মুখোশ পরে থাকো, প্রয়োজনে তীক্ষ্ন হয়ে উঠো।’ ফলশ্রুতিতে গ্রামের শান্ত পরিবেশ রূপ নিলো সংঘাতে। একে অপরকে দোষারোপের, গর্জনের রণমূর্তিতে শুরু কারণে-অকারণে হানাহানি। কেউ কাউকে ছাড় দিবে না। সবাই নিজের অস্তিত্বের জন্য অপরকে শেষ করে দিবে! তারপর একদিন, সেই প্রথম দাঁত নেওয়া ভেড়াটি আয়নায় নিজেকে দেখলো। সে আর নিজেকে চিনতে পারলো না! তার উল ঢেকে গেছে রক্তে। চোখে শুধুই হিংসা আর সন্দেহ। সে কেঁদে ফেললো। কিন্তু চোখ থেকে আর জল আসছিল না- আসছিলো শুধুই বিষ! আর তা দেখে ওপাড়ের নেকড়ের দল পাহাড়ের ওপারে দাঁড়িয়ে হাসছিলো আর হাসছিলো! নেতা নেকড়ে বললোÑ আমরা ভেড়াদের কাছ থেকে কিছুই ছিনিয়ে নেইনি। শুধু তাদেরকে বিষাক্ত দাঁত দিয়েছি। বাকিটা তারা নিজেরাই করেছে।
এই গল্পটি থেকে আমরা কি কিছু শিখতে পারি! দেশের চলমান অস্থিরতা আর পারস্পরিক অসহিষ্ণুতা কি তারই প্রমাণ মেলে না! বাঙালিরা কি ওপারের নেকড়ের বিষ ছড়ানোর ফাঁদে পড়ে সরলতা হারাচ্ছে না! নিজেদের শরীর ও মননকে বিষাক্ত করছে না! বিষয়টি নিয়ে ভাবতে থাকুন। আর ততক্ষণে আরেকটি গল্প শুনুন-
আচ্ছা আপনারা টাইটানিকের গল্পটি নিশ্চয়ই জানেন। টাইটানিক যখন ডুবতে ছিল, তখন কাছাকাছি তিনটে জাহাজ ছিল। একটির নাম ছিল স্যাম্পসন। মাত্র ৭ মাইল দূরে ছিল জাহাজটির অবস্থান। বেআইনিভাবে সিল মাছ ধরায় ব্যস্ত ছিল জাহাজটি। তারা দেখতে পেয়েছিল টাইটানিকের বিপদ সংকেত। তবুও উল্টোদিকে জাহাজের মুখ ঘুরিয়ে দূরে চলে গিয়েছিলো। এই জাহাজটির কথা একবার ভাবুন। দেখবেন আপনার আশেপাশের অনেকের সাথেই মিল আছে! এরা শুধু স্বার্থপরের মতো নিজের কথাই ভাবে। অন্যের জীবন কি ঘটল তা নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই তাদের। দ্বিতীয় জাহাজটির নাম ক্যালিফোর্নিয়ান। মাত্র চৌদ্দ মাইল দূরে ছিল টাইটানিকের থেকে। ওই জাহাজের চারপাশে ছিল জমাট বরফ। ক্যাপ্টেন দেখেছিলেন টাইটানিকের বাঁচতে চাওয়ার আকুতি। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূল নয় এই অজুহাতে তিনি সিদ্ধান্ত নেন ঘুমাতে যাবেন। সকালে দেখবেন কিছু করা যায় কিনা। জাহাজটির অন্যসব নাবিকরা নিজেদের মনকে প্রবোধ দিয়েছিল এই বলে যে ব্যাপারটা এতটা গুরুতর নয়। এই জাহাজটিও অনেকের মনের কথা বলে! কেউ বিপদে পড়লে অনেকেই মনে করে ঠিক সেই মুহূর্তে সাহায্য করতে যাওয়া বোকামি, পরিস্থিতি অনুকূল হলে দেখা যাবে। আসলে দায়িত্ব এড়ানোর জন্য কোনো না কোনো অজুহাত খোঁজে এরা। শেষ জাহাজটির নাম ছিল কারপাথিয়ান্স। এই জাহাজ যাচ্ছিল উল্টোদিকে, ছিল প্রায় আটান্ন মাইল দূরে। সেই মুহূর্তে তারা রেডিওতে শুনতে পায় টাইটানিকের যাত্রীদের আর্তচিৎকার। জাহাজের ক্যাপ্টেন হাঁটুমুড়ে বসে পড়েন ডেকের ওপর। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করেন যাতে তিনি সঠিক পথ দেখান তাদের। তারপর নাবিকদের নিয়ে সর্বশক্তিতে বরফ ভেঙে এগিয়ে চলেন টাইটানিকের দিকে। জাহাজটির এই সিদ্ধান্তের জন্যই টাইটানিকের ৭০৫ যাত্রী প্রাণে বেঁচে যায়। মনে রাখবেন- এক হাজার কারণ থাকবে আপনার কাছে দায়িত্ব এড়াবার জন্য, কিন্তু তারাই প্রকৃত মানুষ যারা অন্যের বিপদের সময় কিছু না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়ে।
যাক মন খারাপ করবেন না আবার। ভালো-মন্দ মিলিয়েই মানুষ, সমাজ এবং দেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হওয়া আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি। সবুজের বুকে রক্ত লাল রঞ্জিত পতাকা আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের মাতৃভাষা। আমরা কি এমন মহিমান্বিত গর্বগুলোকে নেকড়েদের প্রলোভনে হারাতে যাচ্ছি! আমরা কি অসভ্যদের চেয়ে অসভ্য জাতির আচরণে বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছি! আমরা কি ধ্বংস করছি, কার জন্য ধ্বংস করছি, এর ফলাফল কারা ভোগ করবে- সে ভাবনাটি কি আমরা একবারও করছি? এই সহজ প্রশ্নটি দেশ জনতার মুখে মুখে- বুকের ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাচ্ছে!
আফ্রিকার একটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের কিছু শিশুর সাথে কথা বলতে বলতে একজন নৃবিজ্ঞানীর অদ্ভুত কিছু উপলব্ধি হয়। তিনি ভেবেছিলেন ওদের সাথে একটা মজার খেলা খেলবেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ওই শিশুরা তাকে এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। নৃবিজ্ঞানী এক ঝুড়ি ফল দূরে একটি গাছের নিচে রেখে শিশুদেরকে বলেন, তোমাদের মধ্যে যে দৌড়ে প্রথমে ওই গাছের কাছে পৌঁছতে পারবে সে ঝুড়িভর্তি ফলগুলো পাবে।
কিন্তু দৌড়ানোর সংকেত দেবার পর তিনি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কেউ ছুটল না, কেউ আগে গেল না। সবাই হাত ধরাধরি করে একসাথে গাছের কাছে পৌঁছাল আর ফলগুলো ভাগ করে মিলেমিশে খেতে লাগল। নৃবিজ্ঞানী যখন সেই শিশুদের কাছে জানতে চাইলেন তারা কেন এরকম করল, তখন তারা তাকে একটাই শব্দ বলল, ‘উবুন্ট’। তাদের ভাষায় ‘উবুন্টু’ শব্দের অর্থ হলÑ ‘আমি আছি, কারণ আমরা সবাই আছি’। বাকিরা যদি দুঃখে থাকে আমি সুখী হব কী করে? ওই আদিবাসীরা জানে সুখের মানে কি। কাউকে বঞ্চিত করে সুখী হওয়া যায় না। সবাই মিলে একসাথে ভালো থাকার নামই হচ্ছে সত্যিকারের সুখ। অথচ ওদেরকেই আমরা বলি অসভ্য। আর এদিকে অন্যের সুখের পাঁজরে বর্শা হেনে এগিয়ে চলছে আমাদের সভ্যতা। আরেকজনের সুখ ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য আমরা হানাহানি রেষারেষি খুনোখুনি করি! স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগলেই আমরা পশু হয়ে যাই। মাঝে মাঝে আমার প্রশ্ন জাগে প্রকৃত সভ্য আসলে কারা? আমরা নাকি ওরা?
প্রিয় দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, নিশ্চিত থাকুন- আমরা কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারবো না। কারণ বাংলাদেশটি আমাদের। দেশের সংস্কৃতি-কৃষ্টি-সভ্যতা-প্রকৃতি-সম্পদ সবই আমাদের। আমরা কেন নেকড়েদের হয়ে নিজেদের মাঝে ঘৃণার বিষয় ছড়াবো! ভাবুন না প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ! আমরা যদি চুপটি করে থাকি। আর বুঝে না বুঝে- ভুল বুঝে অন্যরা যদি নেকড়েদের প্রড়োচনায় যা ইচ্ছা তা-ই করে যায় তাহলে শেষতক কিন্তু সব দায় সবার উপরই বর্তাবে।
লেখক : কলমযোদ্ধা ও সমাজ বিশ্লেষক।
আজকালের খবর/আরইউ