শহরের জীবন যেন ধূলোয় ঢাকা ধূসর নদী। প্রতিদিন একই স্রোত, একই ধোঁয়া, একই ভিড়ভাট্টা। মন ক্লান্ত, অথচ কোথাও এক রকম অদৃশ্য টান ডেকে নিয়ে যায় পথের দিকে। সেই টানেই এক রাতে বেড়িয়ে গেলাম কমলাপুরে। গন্তব্যের কোনো নির্দিষ্ট নাম নেই; যাত্রাটাই মুখ্য। টিকিটের জানালায় দাঁড়িয়ে নিঃসংকোচে বললাম, ‘যেটা আছে, সেটাই দিন’। হাতে এল চট্টগ্রাম মেইলের টিকিট।
রাতের আকাশে তখনো তারার ক্ষীণ দীপ্তি। প্ল্যাটফর্মের বাতিগুলোয় হলুদাভ শ্লথ আলো, তার ভেতরেই হঠাৎ বাঁশির দীর্ঘ শ্বাস ভেদ করে এল ট্রেন, যেন অন্ধকারের বুক থেকে উঠে আসছে অজানা কোনো আহ্বান। কামরার ভেতরে পা রাখতেই পড়ে গেলাম অন্য এক দুনিয়ায়। এ শুধু যন্ত্র নয়, যেন ক্ষুদ্র এক জনপদ।
কোথাও সিদ্ধ ডিমের গন্ধ, কোথাও চানাচুরের কড়মড় শব্দ, কোথাও বা কফির হালকা ধোঁয়া। তিলের খাজা ভাঙার টুংটাং মিষ্টি আওয়াজ মিশে আছে গলার হট্টগোলে। প্রতিটি সিটে যেন বসে আছে ভিন্ন ভিন্ন জীবনের ইতিহাস। মনে হলো জীবনের ছোটখাটো স্রোত একত্রিত হয়ে চলেছে রেলের চাকায় ভর করে।
কিন্তু হুড়োহুড়ি করে চড়েও সিট জুটল না। তাকিয়ে দেখি, জনা কয়েক কিশোর উদাম গায়ে ঠ্যাং চেগিয়ে নির্লজ্জ ভঙ্গিতে সিট দখল করে বসে আছে। তাদের মুখে কেমন এক বিকৃত আত্মবিশ্বাস। টিকিট আছে কি না জানতে চাইতেই হেসে বলল, ‘না, আরেকজন আনতে গেছে।’ তাতে আরেক যাত্রীর রাগ চেপে রইল না। তিনি জড়িয়ে পড়লেন বাকবিতণ্ডায়। তর্কে যুক্ত হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থীও। মুহূর্তেই কামরা পরিণত হলো উত্তপ্ত কাব্যিক মঞ্চে; কণ্ঠে কণ্ঠে জড়ানো ক্ষোভ, ক্ষোভের ভেতর যুক্তি, যুক্তির ভেতর অন্যায্যতার গন্ধ। অবশেষে টিকিটধারী যাত্রীরা কিশোর চক্রটিকে ঠেলে সরিয়ে দু’তিনটি সিট উদ্ধার করল।
এরপরেই অন্ধকারের ভেতর ছায়া ঘনীভূত হলো। বিপত্তিটা বাধল আমাদের বেলায়। স্টেশনে ওঠা সঙ্গী দুজনের সঙ্গে আমিই হলাম নতুন নিশানা। চক্রটি, যাকে সোজাসাপ্টা ‘টোকাই’ বলে থাকি, হঠাৎ তাদের মুখে শয়তানি হাসি, চোখে হিংস্র আভা। যেন রাত নিজেই রূপ বদলে হুমকি হয়ে দাঁড়াল। তাদের ‘দেখে নেব’ হুমকি হঠাৎ অন্ধকারের ভেতর ছুরি বের করে ধরল। টিমটিম আলোয় দেখা গেল এক কিশোরের বিদঘুটে হাসি, হলুদ দাঁত যেন হিংস্র জন্তুর নখের মতো চকচক করছে। আরেকজন ছুটে গেল বাকি সঙ্গীদের ডাকতে।
আমাদের উদ্বেগ আরো বাড়ল যখন লক্ষ্য করলাম তাদের হাতে ধাতব কিছু রয়েছে। কামরার ভেতর ভয়ে স্তব্ধতা নেমে এল। সবার মুখে নিঃশব্দ শঙ্কা। হঠাৎ মনে পড়ল একজন ঝানু যাত্রীর সতর্কতা- ‘রাতের ট্রেন খুবই খারাপ। প্রতিদিন ছিনতাই হয়। শুধু টাকাকড়ি নয়, কখনো কখনো মানুষকেও চ্যাংদোলা করে রেললাইনে ফেলে দেয়।’ সেই কথাগুলো যেন এ মুহূর্তে কানে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
কামরার ভেতরে আর বাইরে, প্ল্যাটফর্মে জটলা করে দাঁড়িয়ে রইল চক্রটি। যাত্রীদের মধ্যে তরুণ প্রায় নেই, নারী, শিশু আর বয়স্করাই সংখ্যায় অধিক। চারদিকে চাপা উদ্বেগ। মনে উঁকি দিচ্ছে নানা আ-কথা, কু-কথা। পত্র-পত্রিকায় অহরহ ভেসে ওঠা ট্রেনের দুর্ঘটনার খবর যেন বাস্তব রূপ নিতে উদ্যত হলো। মনের ভেতর ভাঙচুর শুরু হলো সাহস আর শঙ্কার। ফ্রন্টাল লোব তীক্ষè সংকেত পাঠাচ্ছে ‘সাহায্য প্রয়োজন’। অথচ চৌহদ্দিতে নেই কোনো নিরাপত্তারক্ষী। নেই সাঁটানো হটলাইন নম্বর। কিন্তু প্রতিটি কামরার প্রতিটি যাত্রী দাঁড়িয়ে আছে চরম নিরাপত্তা সংকটে।
অল্প পরেই ঘটল এক ভয়ার্ত দৃশ্য। দশ-বারো বছরের এক ছেলেকে ট্রেনের ছাদে উঠতে দেখে এক প্রৌঢ় যাত্রী নামিয়ে দিলেন রাগের সঙ্গে। ছেলেটি নিচে নেমে প্রতিশোধ নিল। হাতে এক টুকরো পাথর তুলে ছুড়ে মারল তার দিকে। আরেকজন জানালায় সজোরে থাপ্পর মারল। অন্ধকারে আচমকা আঘাতের শব্দ শুনে বুক কেঁপে উঠল।
উদ্বেগ আর অস্থিরতায় একজন ছুটে গেলাম স্টেশন ফাঁড়ির দিকে। অনেক খুঁজে পাওয়া গেল পথে দুজন সিপাহী। সব কথা শুনে তারা এগিয়ে এলেন। তবে নিজেদের সাংবাদিক পরিচয়টি প্রকাশ করার পরেই যেন তাদের উদাসীন দৃষ্টি সজাগ হলো। টিকিট দেখতে চেয়ে টোকাই চক্রটিকে শাসালেন তারা। তাড়িয়ে দিলেন। তবুও সংশয় রয়ে গেল; কারণ ট্রেনে পাথর বা ঢিল মারার যে দৃশ্য একটু আগেই প্রত্যক্ষ করেছি, তা সহজে ভুলবার নয়।
রাত তখন দ্বিপ্রহর। প্রায় দেড় ঘণ্টা বিলম্বে ছাড়ল চট্টগ্রাম মেইল। এতক্ষণ কামরার সব জানালাই বন্ধ ছিল। অজানা আতঙ্কে মনে হচ্ছিল, আবার না কোথাও থেকে ঢিল কিংবা ডিম ছোড়া হয়। ভেতরে ভ্যাপসা গরম, ফ্যান-বাতি অচল, দুর্গন্ধে টেকা দায়। অথচ বাধ্যতা নামের শৃঙ্খলে আবদ্ধ আমরা সবাই। নিরাপত্তার প্রতি কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা যেন কফিনে পেরেক ঠুকে দিল। এই ভোগান্তি, এই আতঙ্কের প্রতিনিধি হয়ে রইল বগি নম্বর খ।
এই দুর্দশার ভেতরও এক অদ্ভুত সুর বেজে চলল। এই বিশৃঙ্খলা, এই ক্লান্তি, এই ভয়ের মাঝেও রয়ে গেছে এক অদ্ভুত টান। চালের বস্তা, মাছের হাড়ি, শাড়ির পোঁটলা, মানুষের হাতে দশ-বিশটা করে বোজকা, ভিড়ের ভেতর হঠাৎ পা মাড়িয়ে দেওয়ার বিরক্তি, প্রতিটি স্টেশনে থেমে যাওয়া ট্রেনের স্থবিরতা- এসবের ভেতরেও বাজতে থাকে জীবনের নিরলস সঙ্গীত। আর দ্রুতগামী এক্সপ্রেসগুলো যখন ঝড়ের মতো পাশ কাটিয়ে ছুটে যায়, মনে হয় সময় নিজেই ছুটে চলেছে অদৃশ্য কোনো গন্তব্যের দিকে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ রোমাঞ্চকর বিশৃঙ্খলা হজম করে অবশেষে নেমে পড়লাম। ক্লান্ত শরীর, কিন্তু মনের ভেতর এক নতুন উপলব্ধি। বুঝলাম, ট্রেন থেকে নামা কোনো যাত্রার সমাপ্তি নয়। বরং নতুন গল্পের সূচনা। পথে নামা মানেই শুধু যাত্রা নয়; বরং অজানা রোমাঞ্চের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা, যেখানে ভয়ের সঙ্গে মিশে থাকে বিস্ময়, আর বিস্ময়ের ভেতর জন্ম নেয় জীবনের অমোঘ কাহিনী।
সৈয়দ মুহাম্মদ আজম: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ