প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫, ৫:১০ পিএম
শিক্ষিত জাতি গঠনের প্রথম পদক্ষেপ হলো সাক্ষরতা। সাক্ষরতা শব্দটি দ্বারা প্রকৃতপক্ষে অক্ষর জ্ঞানসম্পন্নতাকেই বোঝানো হয়। তবে দিন দিন এর পরিধি বৃদ্ধি পাচ্ছে। সময়ের সাথে সাথে স্বাক্ষরতা শব্দটির ব্যপকতা বাড়ছে। একসময় সাক্ষর বলতে কেবল অক্ষর জ্ঞানের সাথে নিজের নাম লিখতে পারার দক্ষতাকেই বোঝানো হতো। তখনকার প্রেক্ষাপটে এইটুকু অর্জন করাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সাক্ষরতা একটি দেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। দেশের অগ্রযাত্রায় এর একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। শিক্ষার সাথেও সাক্ষরতার রয়েছে নিবিড় যোগসূত্র। দেখা গেছে যে দেশে সাক্ষরতার হার যত বেশি সে দেশ তত বেশি উন্নত। সাক্ষরতা বা অক্ষরজ্ঞান অর্জন হলো শিক্ষার একেবারেই প্রাথমিক কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ধারণা কারণ এখান থেকেই বাকি পথটুকু পাড়ি দিতে হয়। জ্ঞান অর্জনের আনুষ্ঠানিক শুরু হয়। আজকাল শিক্ষার সাথে সাথে উচ্চশিক্ষা অর্জন এবং দক্ষতা বৃদ্ধি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
কারণ উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে আমাদের এ অর্জন প্রয়োজন। এ লক্ষ্যেই প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি থেকে শতভাগ উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং শিশুদের শ্রম থেকে সরিয়ে পড়ালেখায় ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। এটা নিশ্চিত করা হলে শতভাগ শিক্ষিত জাতি হিসেবে নিজেদের বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে। কিন্তু নিরক্ষতার হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে এখনো অনেক পথ বাকি রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বুরে্যার (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, ২০১৯ সালের হিসাবে দেশে তখন পর্যন্ত গড় সাক্ষরতার হার ৭৩ দশমিক ৯ শতাংশ। গত বছর সাক্ষরতার হার ৭৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ২০১৭ সালে ছিল ৭২ দশমিক ৩ শতাংশ এবং ২০১৮ সালে ছিল ৭২ দশমিক ৯ শতাংশ। গত বছরের এই ধীরগতির অর্জনের কারণ হিসেবে বলা যায় করোনা মাহামারীতে সাক্ষরতা কার্যক্রমেও বিরুপ প্রভাব পরেছে। সাক্ষরতার সাথে সাথে শিক্ষার হার বৃদ্ধির বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা সাধারণত তিনটি উপায়ে অর্জিত হয়। আনুষ্ঠানিক, উপানুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক। যারা আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় তারা উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে সাক্ষরতা লাভ করে থাকে। তবে সরকারের বিভিন্ন উদ্যেগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শতভাগ শিশুকে শিক্ষার আওতায় আনার প্রাণান্ত প্রচেষ্টায় আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় বেশিরভাগ অক্ষরজ্ঞান শুরু হচ্ছে।
বর্তমানে আমাদের লক্ষ্য কেবল স্বাক্ষরতা বৃদ্ধি নয়। শিক্ষার হার বৃদ্ধি করা এবং তা অবশ্যই গুণগত শিক্ষা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষমাত্রা অর্জনে শতভাগ শিক্ষিত জাতি গঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে একসময়ের লক্ষ স্বাক্ষরতার হার বৃদ্ধি এখন শতভাগ শিক্ষিত জাতি অর্জন করা। কেবল স্বাক্ষরতা অর্জন করলেই আমাদের কাক্সিক্ষত অর্জন সম্ভব হবে না। বাংলাদেশের ভৌগলিক পরিসরে ‘সাক্ষরতা’ শব্দটির প্রথম উল্লেখ দেখা যায় ১৯০১ সালে। শুরুতে স্ব অক্ষরের সাথে অর্থাৎ নিজের নাম লিখতে যে কয়টি বর্ণের প্রয়োজন সেগুলো জানলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো। তখনকার প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টিই ছিল চ্যালেঞ্জিং। আমাদের শুরু সেই অবস্থা থেকেই। বর্তমান অবস্থার সাথে পর্যালোচনা করলেই বোঝা যায়, আমরা আজ অনেকটা পথ পার হয়ে এসেছি। পরবর্তিতে ১৯৪০ সালের দিকে পড়ালেখার দক্ষতাকে সাক্ষরতা বলে অভিহিত করা হতো। এ অবস্থা উত্তোরণের পর ষাটের দশকের দিকে পড়া ও লেখার দক্ষতার সাথে হিসাব নিকাশের যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষই সাক্ষর হিসেবে পরিগণিত হতো। আশির দশকে লেখাপড়া ও হিসাব নিকাশের পাশাপাশি সচেতনতা ও দৃশ্যমান বস্তুসামগ্রী পঠনের ক্ষমতা সাক্ষরতার দক্ষতা হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমানে এসব দক্ষতার পাশাপাশি যোগাযোগ দক্ষতা, ক্ষমতায়নের দক্ষতা, জীবন নির্বাহী দক্ষতাসহ বিভিন্ন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। মূলত সময় এগিয়ে চলার সাথে সাথে সাক্ষরতা শব্দটির সংজ্ঞায়নে পরিবর্তন আসছে। ভবিষ্যতেও এধরনের পরিবর্তন যোগ হবে। নিরক্ষরদের সাক্ষরজ্ঞান প্রদান করতে ২০১৪ সালে মৌলিক সাক্ষরতা প্রকল্প (৬৪ জেলা) নেওয়া হয়েছিল। সারা বিশ্বে আজও বহু মানুষ শিক্ষার আলো গ্রহণ করতে পারেনি। এমনকি নিজের পরিচয়ও লিখতে পারে না অনেক মানুষ। বর্তমানে প্রাথমিকে শিশুদের রিডিং পড়তে পারার দক্ষতা অর্জনের ওপরও গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। যদিও শিক্ষা একটি মৌলিক অধিকার।
বর্তমানে সাক্ষরতার হার যেন থমকে গেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছওে দেশে সাক্ষরতার হার বাড়েনি ১ শতাংশও। ২০২৩ ও ২০২৪ উভয় বছরেই এই হার ৭৭.৯ শতাংশে স্থির রয়েছে। গত পাঁচ বছওে মোট বৃদ্ধি হয়েছে মাত্র ২.৩ শতাংশ। দেশের ২১.৯ শতাংশ মানুষ এখনো নিরক্ষর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধারা চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে না। শিক্ষা, শিক্ষিত মানুষের হার বা সাক্ষরতার হার এসব বিষয় স্থির কোনো বিষয় নয়। এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। কারণ প্রতিদিনই এই কার্যক্রম চলমান। তাই একেবারে শতভাগ নিশ্চয়তা দিয়ে কোনো হিসাব বের করা জটিল কাজ। তবে পরিসংখ্যান যেহেতু সব কাজের তথ্য সংরক্ষণ করে সেহেতু হিসাব করা জরুরি। তা ছাড়া নিজেদের এই উন্নয়নের চিত্র যতটুকু সম্ভব সঠিক হিসাব করতে হবে। কারণ এই সাক্ষরতার হার উন্নত বিশ্বের মত একদিন শতভাগের কাছাকাছি বা শতভাগ অর্জন সম্ভব হবে। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ আর এর সাথে যেহেতু দেশের অগ্রগতির বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেহেতু এটা অতি শিঘ্রই অর্জন করা হবে। তাই সঠিক চিত্র আমাদের জানা প্রয়োজন। কোনো দেশের শিক্ষা বা সাক্ষরতার উন্নয়নে সেই খাতে পর্যাপ্ত অর্থ ব্যয়ের বিষয়টিও জড়িত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ তাদের বাজেটের একটা বিরাট অংশ শিক্ষা খাতে নির্বাহ করে। কারণ এই একটা ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারলে অন্য খাতগুলোতেও তার প্রভাব পরতে বাধ্য। শিক্ষিত জাতি নিয়ে দ্রুত উন্নয়ন সম্ভব। অর্থাৎ উন্নয়নের গতি তরান্বিত করতে হলে শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার বিকল্প নেই। অন্যদিকে নিরক্ষর লোকবল নিয়ে বেশিদূর এগিয়ে যাওয়া যায় না। মুখ থুবড়ে পরে। বর্তমান সরকার শিক্ষানুরাগী। শিক্ষা এবং শিক্ষার মূল চালিকাশক্তি শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নে নানা উদ্যেগ নিয়েছেন।
মানুষকে নিজেদের অন্যতম মৌলিক অধিকার শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার ব্যাপারে সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যেই মূলত এই দিনটির প্রচলন হয়েছে। আমরা যেহেতু এখনো পিছিয়ে রয়েছি ফলে সবাইকে শিক্ষার আওতায় আনতে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সাক্ষরতা আর উন্নয়ন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলে। সাক্ষরতাই টেকসই সমাজ গঠনের মূল চালিকাশক্তি। টেকসই সমাজ গঠনের জন্য যে জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন তা সাক্ষরতার মাধ্যমেই অর্জিত হয়। নিরক্ষতার অভিশাপ যেকোন দেশের জন্য উন্নয়নের অন্তরায়। আমাদের দেশ খুব ধীরে ধীরে সেই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে। এখনো আমরা আমাদের চুড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারিনি। আমাদের লক্ষ শতভাগ সাক্ষরতা অর্জন করা। দারিদ্রের দুষ্টু চক্রে পরে আজও যারা নিরক্ষতার গ্লানি বয়ে বেড়াচ্ছে তারাও অচিরেই সাক্ষরতা সম্পুন্ন হবে। আমরা চাই আধুনিক বাংলাদেশ গঠন করতে। আধুনিক বাংলাদেশ গঠনে প্রত্যেকের অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে। সাক্ষরতা শতভাগ করা আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য যেমন গুরুত্বপূর্ণ সেরকম গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে শতভাগ শিক্ষার হার করা। সাক্ষরতা হচ্ছে শতভাগ শিক্ষিত করার প্রাথমিক ধাপ। সেজন্য ঝরে পরার হার শূন্যের পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। নিরক্ষতা, ক্ষুধা বা দারিদ্র হলো দেশের উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতাস্বরুপ। এসব সমস্যাকে মোকাবেলা করতে পারে কেবল শিক্ষা। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। টেকসই উন্নয়নে দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে সবার জন্য শিক্ষার বিকল্প নেই। বিশ্বের মানচিত্রে একটি সুশিক্ষিত এবং উন্নত জাতি হিসেবে সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করতে হবে। প্রতিটি নাগরিককে একজন সুনাগরিক এবং স্বয়ংসম্পুন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। প্রতিটি নাগরিকেই সম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নিরক্ষতার অভিশাপ থেকে আমাদের মুক্তি পেতেই হবে। এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা জরুরি। এজন্য সরকারি-বেসরকারি সব উদ্যোগ কার্যকর করতে হবে।
অলোক আচার্য: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।
আজকালের খবর/আরইউ