শিল্পগুরু এস এম সুলতান কেবল একজন চিত্রশিল্পীই নন, তিনি একজন দার্শনিকও বটে। জীবদ্দশায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন লিজেন্ড। তার দিনযাপন ছিলো ঐশ্বরিক। জীবদ্দশায় তাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র, লিখিত হয়েছে জীবনীভিত্তিক উপন্যাস। তার প্রতিকৃতি এঁকেছেন নোবেলজয়ী গুন্টার গ্রাস। তার চিত্রকলা নিয়ে লিখেছেন আহমদ ছফা। তিনি ছিলেন এক চিরস্বাপ্নিক- মাটি ও মানুষের নিরন্তর স্বপ্নগাথা রচনা করেছেন তার বিশাল ক্যানভাসে।
শিল্পগুরু এস এম সুলতানের দর্শনের মূল ভিত্তি কৃষক, গ্রাম বাংলা এবং প্রকৃতির প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। দার্শনিক আহমদ ছফা মনে করেন, সুলতানের শিল্পকর্মে বাঙালি সমাজের অন্তর্নিহিত শক্তি এবং গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি মূর্ত হয়ে উঠেছে। তিনি তার চিত্রকর্মের মাধ্যমে কৃষক জীবনের বীরত্ব, সংগ্রামী চেতনা এবং প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, তাদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, যূথবদ্ধতা- সবকিছুই তার ক্যানভাসে তুলে ধরেছেন।
এস এম সুলতানের দর্শন কয়েকটি মূল বিষয়ের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল:
কৃষক কেন্দ্রিকতা: এস এম সুলতানের কাজের প্রধান বিষয় ছিল কৃষক। তিনি তাদের দৈনন্দিন জীবন, সংগ্রাম, এবং প্রকৃতির সাথে তাদের গভীর সম্পর্ককে গুরুত্ব দিতেন।
প্রকৃতির প্রতি অনুরাগ: তিনি প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভালোবাসতেন এবং এটিকে তার কাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচনা করতেন।
গ্রামীণ জীবনের উদযাপন: তিনি গ্রামীণ জীবন, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যকে উদযাপন করতেন এবং এটিকে তার কাজের মাধ্যমে তুলে ধরতেন।
অতিরঞ্জিত শারীরিক গঠন: তার ছবিতে কৃষকদের শক্তিশালী ও পেশীবহুল হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে, যা তাদের কর্মঠ এবং শক্তিশালী সত্তার প্রতীক।
জীবন ও প্রকৃতির ঐক্য: তিনি মনে করতেন মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান এবং এই দুটি উপাদান একে অপরের পরিপূরক।
শিল্পী হিসেবে দায়িত্বশীলতা: তিনি মনে করতেন, একজন শিল্পীর সমাজের প্রতি কিছু দায়িত্ব রয়েছে এবং সেই দায়িত্ববোধ থেকে তিনি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবন চিত্রায়নে ব্রতী হয়েছিলেন।
মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি: এস এম সুলতানের কাজে মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্পষ্ট। তিনি মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ককে সম্মান করতেন। এস এম সুলতানের এই দর্শন তাকে একজন ব্যতিক্রমী শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তার কাজ আজও বাংলাদেশের শিল্পকলায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে।
শিল্পগুরু এস এম সুলতান জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠান সম্প্রতি শুরু হয়েছে বেঙ্গল শিল্পালয়ে। উপস্থিত ছিলেন আব্দুল্লাহ আবু সাঈদ স্যার, অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তার স্যার, আয়োজক শিল্পানুরাগী আবুল খায়ের লিটু, অন্যতম আয়োজক নাসির আলী মামুন প্রমুখ। আলোচনার শুরুতে একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি দেখানো হয়। সেখানে অনেকে কথা বলেছেন। বিশেষভাবে অধ্যাপক মোস্তাফিজুল হকের একটি মন্তব্য ভালো লেগেছে। তিনি বলেছেন, এই প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে সুলতানের দর্শনকে জানার এবং বোঝার গভীর স্পৃহা কাজ করছে। সুলতানের শিল্পকর্মকে অনুধাবনের প্রয়াস তাদের মধ্যে আরো তীব্র হচ্ছে।
এস এম সুলতান [১৯২৩ - ১৯৯৪] ছিলেন একজন কিংবদন্তী বাংলাদেশী চিত্রশিল্পী, যিনি তার অনন্য শিল্পশৈলী এবং প্রকৃতির প্রতি গভীর মমত্বের জন্য বিখ্যাত ছিলেন। তার কাজের মধ্যে গ্রামীণ জীবন, কৃষক এবং সাধারণ মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে, যা দর্শকদের মুগ্ধ করে। তার কাজের মাধ্যমে তিনি সমাজের অবহেলিত মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলেছেন এবং প্রকৃতির সৌন্দর্যকে নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন। তাই, তার কাজের প্রতি আকর্ষণ এবং তার জীবনদর্শন সম্পর্কে জানার আগ্রহ থেকেই মানুষ বারবার তার কাছে ফিরে যেতে চায়।
সুলতানের কাছে বারবার ফিরে যেতে হয়। এই যাওয়া মানে শেকড়ের কাছে যাওয়া। গুরুর ১০৩তম জন্মদিনের ক্ষণে অতল শ্রদ্ধা।