তিতাস নদীর মাছ; একাল-সেকাল
শাহরিয়ার কাসেম
প্রকাশ: শনিবার, ৯ আগস্ট, ২০২৫, ৫:০৯ পিএম
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বর্তমানে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা প্রায়  ১০০৮টি। তবে এ নদ-নদীগুলোর উপনদী ও শাখানদী রয়েছে। উপনদী শাখা নদীসহ বাংলাদেশের নদীর মোট- দৈর্ঘ্য হলো প্রায় ২২.১৫৫ কিলোমিটার। তবে বাংলাদেশের নদীর সংখ্যা কত এ নিয়ে বেশ বিতর্কও রয়েছে। তবে আজকের লেখাটির মূল বিষয় হল ‘তিতাস নদীর মাছ; একাল-সেকাল’।

বাংলাদেশ নদীবাহিত দেশ হওয়ায় তার মধ্যে তিতাস নদী অন্যতম। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশে প্রবাহমান নদী এটি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রধান নদীও বটে। তিতাস নদীর দৈর্ঘ্য প্রায়- ৫৮ কিলোমিটার। এবং প্রকৃতি সর্পিলাকার।

বাংলাদেশের অন্যতম ও বৃহৎ মেঘনা নদী  হতে তিতাস নদীটি উৎপত্তি লাভ করে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার চুন্টা ইউনিয়ন দিয়ে প্রবেশ করে প্রথমে দক্ষিণ- পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। এবং একই জেলার আখাউড়া উপজেলায় এসে উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়ে নবীনগর উপজেলার পশ্চিম ইউনিয়নের নিকট এসে মেঘনা নদীতে পতিত হয়েছে। 

তিতাস নদী যে শুধু একটি নদীর নাম তা কিন্তু নয়।  তিতাস নদী হলো ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষের এক গর্বের নদী। তিতাস পাড়ের মানুষের সাথে তিতাসের সম্পর্ক যেন ওতপ্রোতভাবে ভাবে জড়িয়ে আছে বহুকাল ধরে। 

‘তার কুলজোড়া জল/বুক ভরা ঢেউ প্রাণ ভরা উচ্ছ্বাস।/স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়’। -অদ্বৈত মল্লবর্মণ 

এই তিতাস নদীর পাড়ের জেলেদের সুখ-দুঃখ নিয়ে বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী ঔপন্যাসিক অদ্বৈত মল্লবর্মণ লিখেছিলেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস। শুধু তাই নয় সত্তর এর দশকে তিতাস নিয়ে নির্মিত হয়েছিল চলচ্চিত্রও। তিতাস আর সেই তিতাস নেই। তিতাস পাড়ের জেলেরা আজ অনেক কষ্টে দিন যাপন করছে। এতে করে দিন দিন মরা খালে পরিণত হয়ে যাচ্ছে তিতাস নদী। যেন দেখার কেউ নেই। যার দরুণ তিতাস নদীতে এখন আর আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। শুধু যে মাছ হারিয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। দিন দিন হারাচ্ছে তিতাসের মূল সৌন্দর্যও। কালজয়ী ঔপন্যাসিক অদৈত মল্লবর্মণের  তিতাসকে তার স্বাভাবিক রূপে ফিরিয়ে আনতে নদী খননের পাশাপাশি নদীর দুই পাড়ের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের দাবি করেন পাড়ের মানুষজন ও নদী রক্ষা সুধীজনেরা। তবু কি তিতাস তার মূল রূপ পায়?  হয়তো না। 

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানুষ কৃষিনির্ভর। তবে তিতাস পাড়ের মানুষজন তিতাস নির্ভরও ছিল একটা সময়। কারণ তিতাসের মাছ ছিল অত্যন্ত সুস্বাদু। তিতাসের মাছের কথা হয়তো জেনে থাকবেন তিতাস পাড়ের মানুষ ও জেলেরা।  শুধু তাই নয়, এ নদীর মাছের উপড় নির্ভর করে চলত তিতাসের জেলেরা। শুধু জেলেরাই মাছ নির্ভর করত তা নয়। তিতাসের ভরা  মৌসুমে অনেকেই মাছের উপড় নির্ভর করে বাঁচত।

গোলাভরা  ধান, গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ। বিস্তর মাঠ জুড়ে সোনালী ধানক্ষেত। মৌসুমি শষ্যের দিনে এ জেলার মানুষ ছিল ধনে ধণ্য। কিন্তু আজ হারাতে বসেছে এ সব  কিছুই। কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে সোনালী দিনগুলো। সাথে হারিয়ে যাচ্ছে তিতাসের পুরোনো মাছও।

গ্রামীণ এই আঞ্চলের চিরচেনা নানা প্রজাতির মাছ যেন দিনের পর দিন হারিয়ে যাচ্ছে। কয়েকটি উপজেলাতেও মিলছে না সেই মাছগুলো। এক সময়ে তিতাস নদীর অতি পরিচিত বিশেষ মাছ ছিল- কৈ, মাগুর, খৈলসা , চাপিলা, শিং, পাবদা, টাকি, চেধুরী, বাইম, রুই, কাতল, মৃগেল, চিতল, রিটা, গুজি আইড়, পাঙ্গাস, বোয়াল, খৈলসার মতো সুস্বাদু দেশীয় মাছ। এখন আর তেমন দেখা যায় না। ফলি, বামাশ, টাটকিনি, তিতপুঁটি, আইড়, গুলশা, কাজলি, গাং মাগুর, চেলা, বাতাসি, রানি, পুতুল, টেংরা, পাবদা, পুঁটি, সরপুঁটি, চেলা, মলা, কালোবাউশ, শোল, মহাশোল, গোঙসা, রায়াক, রয়না, বাতাসি, বাজারি, বেলেসহ প্রায় ৬০ প্রজাতির মাছ আজ বিলুপ্তির পথে। 

তবে উল্লেখ্য যে, একটা সময় এই তিতাস নদীর মাছের শুঁটকি বাংলাদেশের অনেক জেলায় রপ্তানি হতো। যদিও এখন হয় তবে নগন্য। এবার নাসিরনগর উপজেলার ঐতিহ্যবাহ কুলিকুন্ডা শুঁটকির মেলায় গেলে এক শুঁটকি বিক্রেতার সাথে কথা হয়।

(এই শুঁটকি মেলাটি আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। যখন থেকে মুদ্রার প্রচলন ছিলনা বা কম ছিল বলতে পন্যের বিনিময় পন্য কেনার সময়। এক কালে মানুষজন তার উৎপাদিত পেয়াজ, রসুন বা শষ্য দিয়ে মেলার শুঁটকি ক্রয় করত)।

তাকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে আমার বাবা এই শুঁটকির ব্যবসা করেছে। তিনি তার বাবা থেকে করছে। আর এখন আমি করছি।  শুঁটকির ব্যাপারে বললে তিনি বলেন, প্রতি বছর আমরা এই কুলিকুন্ডার বান্নিতে আসি শুঁটকি নিয়ে। এলাকার মানুষের খুব বেশি চাহিদা শুঁটকির। তারা বেশি বেশি করে ক্রয় করে রেখে দেয় সারা বছর খাওয়ার জন্য। বিক্রেতা আরো বলেন, একটা সময় আমি যখন ছোট। বাবার সাথে যখন আমি একটু একটু ব্যবসায় যাই। তখন তিতাস নদীর মাছের শুঁটকি উল্লেখযোগ্য ছিল। এই তিতাস নদীর মাছের শুঁটকি অন্যান্য নদীর মাছের শুঁটকি থেকে বেশি চাহিদা ছিল। কিন্তু এখন তিতাসের অবস্থা ভালো নেই। মাছ কমে গেছে। কিছু মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরো অনেক কথা বলেন। 

জানামতে, বেশিরভাগ মাছ আজ সম্পূর্ণ বিলুপ্তির পথে। কোনো কোনো মাছতো বংশসহ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা এসব মাছ বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কারণ নদীতে স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ না থাকায় নদী গুলো ভরাট হয়ে খালে রূপ নিচ্ছে। এবং শহরের বা ড্রেনের বর্জ্য তিতাসে আসার কারণে মাছের বংশ বিস্তারে ব্যপক বাঁধা হয়ে উঠছে। যার দরুণ মা মাছ গুলো স্বাভাবিক ভাবে ডিম পাড়তে পারছে না। বিধায় তিতাসের অনেক মাছ আজ বিলুপ্তির পথে।  

যদি সরকারি উদ্যোগে এ অঞ্চলের নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, জলাশয় ও প্লাবন ভূমি পুনঃখননের মাধ্যমে পানির ধারণ ক্ষমতা বাড়ানো হলে মাছের উৎপাদন বাড়বে। এবং তিতাসও তার হারিয়ে যাওয়া রূপ ফিরে পাবে। তা না হলে দেশীয় প্রজাতির মাছ বা তিতাস নদীর সেই সব মাছ কোনো একদিন বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

আজকালের খবর/আরইউ








http://ajkalerkhobor.net/ad/1751440178.gif
সর্বশেষ সংবাদ
আসছে পিয়া বৈশ্য’র নতুন গান ‘আমারে কান্দাইয়া তুমি’
আশুগঞ্জ সারকারখানায় শ্রমিক-কর্মচারীদের বিক্ষোভ...
চাঁদাবাজির মামলায় মোজাম্মেল বাবু শ্যোন অ্যারেস্ট
প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরে গুরুত্ব পাবে শ্রমবাজার
প্রবাসী সুরক্ষায় কুয়েত রাষ্ট্রদূতের মাইলস্টোন নজির
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ব্রিটেনে দেউলিয়া হওয়ার পথে সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামানের ৩ কোম্পানি
মুক্তি পেল অজয় দেবের ‘ফেরারী পাখি’
হাসির গল্প
ডেঙ্গুতে প্রাণ গেলো আরও ৩ জনের
শর্তসাপেক্ষে অভিনয়ে ফিরবেন আশীষ বিদ্যার্থী
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft