নিতুর আজ খুব মন খারাপ। আজ তার বিবাহবার্ষিকী। খুব শখ করে হাসবেন্ড সিয়ামের পছন্দের পিজা অর্ডার করেছে। সিয়াম সব সময় নিতুকে বলতো, কেক টেক আনবে না তো। ভালো লাগে না। কিন্তু নিতুর কেক খুব পছন্দের ছিল। সিয়াম জানতো নিতুর কেক ভালো লাগে। তাই প্রতিবার নিতুকে নিষেধ করে নিজেই কেক আনতো। নিতুর খুশি এতে বেড়ে যেত। ৫৫ বছরের সংসার কতো মায়া, কতো ভালোবাসা জমা আছে। মান অভিমানও তো কম না।
আজ পিজা ডেলিভারি দিতে দেরি হয়ে গেছে রুবেলের। টাকাটা পায় কিনা সন্দেহ। অনেকে দেরি হলে টাকা দিতে যেন কেমন করে। দিলেও হাজার কথা শোনায়।কিছু করার নেই। চাকরিটা খুব দরকার তার। এই চাকরির উপর তার সংসার চলে। তার ছেলেটা আজকে খুব করে বলেছে, বাবা আজ আমার জন্মদিন। আমি পিজা খাবো। অথচ পিজা কেনার টাকা নেই। এদিকে সস্তা একটা দোকান থেকে পিজা নিবে ভেবে ছিল। কিন্তু কাজের চাপে ভুলে গেছে। দোকান বন্ধ হয়ে গেছে সব। ছেলেটা আজ খুব কষ্ট পাবে।
রুবেল পিজা হাতে ডোর বেল বাজালো। নিতু দরজা খুলে দেখলো পিজা ডেলিভারি দিতে এসেছে। নিতু কিছু বলার আগেই রুবেল বলল,ম্যাডাম সরি। দেরি হয়ে গেল। বৃষ্টির জন্য রাস্তায় কাদা। আর প্রচুর জ্যাম।সরি ম্যাডাম।
নিতু হাত নাড়িয়ে বলল, সমস্যা নেই। টাকা নিয়ে এসে রুবেলের হাতে দিল। পিজার প্যাকেটটা তখনও রুবেলের হাতে।নিতু রুবেলকে বলল, খুব ইচ্ছা ছিল পিজা খাওয়ার। কিন্তু পারবো না মনে হয়।
রুবেল বলল, ম্যাডাম খেতে পারবেন সমস্যা নেই।
নিতু আনমনে বলল, আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। কিন্তু যার জন্য আনলাম সেই তো নেই পৃথিবীতে। এটা নিয়ে যান আপনি। রুবেল কী বলবে, বুঝতে পারছিল না। নিতুর চোখে পানি চকচক করছে।
রুবেল হঠাৎ তার ছেলে রনিকে ফোন করে বলল, বাবা আজ তোমার না জন্মদিন। একজন আন্টি তোমার জন্য পিজা গিফট করেছেন। ওনাকে সালাম দিয়ে ধন্যবাদ বলো। আর দোয়া চেয়ে নেও। নিতু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে রুবেলের দিকে।
রুবেল ফোনটা এগিয়ে দিল নিতুর দিকে। নিতু মোবাইল ধরে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, হ্যালো।
ওপাশ থেকে রনি বলল, আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আজ আমার জন্মদিন। আমার জন্য দোয়া করবেন। আর অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
-ওয়ালাইকুমুস সালাম। শুভ জন্মদিন বাবা।ভালো থেকো। দোয়া রইল তোমার জন্য। অনেক বড় আর ভালো মানুষ হও।
-আন্টি আমাদের বাসায় আসবেন। আমার জন্মদিনের দাওয়াত থাকলো।
এবার নিতু একটু হেসে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার কী খেতে ভালো লাগে?
Ñআমি পিজা পছন্দ করি। কিন্তু বাবাকে আনতে বললে, বাবা সবসময়ই ভুলে যায়।
নিতু বুঝতে পারলো। বাবা ভুলে যায় না। ভুলে যাওয়ার অভিনয় করে।
নিতু রনিকে বলল, আজ আর ভুল হবে না। আন্টি দিয়ে দিলাম। ভালো থেকো বাবা।
নিতুর এক ছেলে, এক মেয়ে তারা খুব ব্যস্ত। তাই আসতে পারেনি। মেয়ে অনলাইনে একটা চকলেট কেক অডার করে পাঠিয়ে দিয়েছে। মায়ের পছন্দ তাই। নিতু রুবেলকে কেকটা দিয়ে বলল, এটা আপনার ছেলের জন্য। ও কাটলে আমার কাটা হবে।
রুবেল তাড়াতাড়ি বলল, না ম্যাডাম। তা কী করে হয়? আমি পিজা না হয় নিলাম আপনাকে সম্মান করে। কিন্তু কেক না।
নিতু বলল, এমনিতেও আমি কোক কাটতাম না।নিয়ে যান। আর আমার হাসবেন্ডের জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহ যেন তাকে মাফ করেন।
রুবেল কেক আর পিজা নিয়ে বাসায় ঢোকার সাথে সাথেই ছুটে এলো রনি। পিছনে তার মা। কেক আর পিজা দেখে রনি তো মহাখুশি।
রুবেলের বউ এসব দেখে খুশি হলেও রুবেলকে বলল, এতো টাকা একদিনে খরচ করলে? মাস যাবে কীভাবে?
রুবেল হেসে বলল, পৃথিবীতে আজও ভালো মানুষ আছে জানো রূপা। তারপর সবকিছু খুলে বলল রূপাকে। রূপাও মনে থেকে দোয়া করলো নিতু ও সিয়ামের জন্য। নামাজে বসেও তারা দোয়া করতে ভুলেনি।
সত্যি বলতে আজ সিয়ামের জন্য তার নিজের ছেলে মেয়েরা দোয়া করতে মনে রাখবে কিনা ঠিক নেই। কিন্তু অচেনা অজানা কয়টা মানুষ ঠিকই দোয়া করলো।
আর একাকীত্বের মাঝেও আজ নিতু একটু সুখ পেল।এখন তার মনটা আগের চেয়ে অনেক ভালো। মাঝে মাঝে মানুষ কেন বেঁচে আছে তা ভুলে যায়। বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে পায় না।
পরের দিন হঠাৎ করে নিতুর ছেলে মেয়ে তাদের পরিবার নিয়ে হাজির। আজ শুক্রবার তাই তারা আজ সারাদিন এখানেই থাকবে। মেয়ে আর ছেলের বউ রান্না করে এনেছে। গতকাল যে নিতুর মন খারাপ ছিল তা সে ভুলেই গেল।বেঁচে থাকার জন্য এই অল্প কিছু সুখই যথেষ্ট হয় মাঝে মাঝে।
আসলে বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় কারণ জীবন একটাই। এই জীবন চলে গেলে আর ফিরে আসবে না।যে গেছে সে তো ফিরে আসবে না।আর যে আছে তাকে তো বেঁচে থাকতেই হবে। তাই নিজের জন্য বা অন্যের জন্য কিছু করে আনন্দ নেওয়াই যায়। ছোট ছোট বিষয় থেকে সুখ কুড়িয়ে নিতে হয়। আত্মতৃপ্তির জন্য হলেও অন্যের আনন্দের মুহূর্তের কারণ হতে হয়।
আজকালের খবর/আরইউ