অডিট আপত্তি, দুর্নীতি নয়
মনিরুজ্জামান মনির
প্রকাশ: সোমবার, ৪ আগস্ট, ২০২৫, ৮:১৩ পিএম
বাংলাদেশের প্রশাসনিক প্রক্রিয়ায় ‘অডিট আপত্তি’ একটি পরিচিত শব্দ। প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ, সংস্থা, এমনকি একটি উপজেলা পরিষদের হিসাবেও অডিট আপত্তি উঠতে পারেÑ এটি নিয়মতান্ত্রিক, সুশাসন-ভিত্তিক ও প্রাতিষ্ঠানিক যাচাইয়ের একটি অংশমাত্র। কিন্তু এই অডিট আপত্তিকে কোনো প্রকার অনুসন্ধান, শোকজ বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ ছাড়াই হঠাৎ ‘দুর্নীতির অভিযোগ’ বলে প্রচার বা অপব্যবহার করা একটি বিপজ্জনক প্রবণতা। এটি শুধু প্রশাসনিক শৃঙ্খলার জন্য হুমকি নয়, বরং ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, পেশাগত মর্যাদা এবং সাংবিধানিক অধিকারকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন অভিজ্ঞ ও নিয়মিতভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অডিট আপত্তিকে কেন্দ্র করে অপসারণ প্রক্রিয়া শুরু করার খবর প্রশাসনিক ও জনসচেতন মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। এই ঘটনার সূত্র ধরেই আমাদের জরুরি প্রশ্ন উঠেছেÑঅডিট আপত্তি কি প্রকৃত অর্থে দুর্নীতি?

এই প্রশ্নের উত্তর শুধু আইন বা নীতিমালায় নয়, বরং একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্রচিন্তা, সাংবিধানিক শুদ্ধতা, এবং আন্তর্জাতিক ন্যায্যতা নির্ধারণ করে দেয়।

অডিট আপত্তি, প্রকৃতি ও প্রক্রিয়া: অডিট আপত্তি হলো নিরীক্ষকদের পর্যবেক্ষণ, যেখানে হিসাবপত্র, অর্থ ব্যয়ের যৌক্তিকতা, প্রক্রিয়াগত স্বচ্ছতা, এবং বিধিবিধানের যথার্থতা পরীক্ষা করা হয়। এই আপত্তিগুলো তিন স্তরে চলে-প্রাথমিক আপত্তি (Preliminary), নিশ্চিত আপত্তি (Confirmed), এবং নিষ্পত্তিযোগ্য আপত্তি (Settleable or Droppable)।

এটি একটি ‘সংশোধনযোগ্য ও আপিলযোগ্য’ প্রক্রিয়া। এটি তদন্ত নয়, অভিযোগ নয়, বরং একটি প্রশ্ন বা সন্দেহ, যার পেছনে হিসাব সংক্রান্ত তথ্যের ঘাটতি, অনুমতির দেরি, অথবা প্রক্রিয়াগত অস্পষ্টতা থাকতে পারে। এটি অধিকাংশ সময়েই সংশ্লিষ্ট অফিস, মন্ত্রণালয় বা হিসাব মহানিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে শুনানির মাধ্যমে নিষ্পত্তি হয়ে যায়।

প্রশ্ন হলো, এই আপত্তির ভিত্তিতে যদি কাউকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ বলে অপসারণ করা হয়, তবে দেশে হাজার হাজার সরকারি কর্মকর্তা ও প্রকল্প পরিচালককে এভাবে দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। অথচ বাস্তবতা হলোÑ ৯০ শতাংশ অডিট আপত্তি প্রশাসনিক পর্যায়ে নিষ্পত্তি হয়, এবং মাত্র ২-৫ শতাংশ  আপত্তি কখনো তদন্ত পর্যায়ে পৌঁছায়।

সরকারি বিধিমালায় অডিট আপত্তির অবস্থান: সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮-তে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে- বিধি ৩(ক): কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হলে লিখিত অভিযোগ,তদন্ত প্রতিবেদন এবং আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে। বিধি ৫: যথাযথ তদন্ত ব্যতীত শাস্তি দেওয়া যাবে না, এবং প্রতিটি অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ‘শোকজ’ বা কারণ দর্শানোর নোটিশ আবশ্যক।

অডিট আপত্তি কখনোই একটি ফৌজদারি তদন্ত নয়, বরং এটি একটি প্রশাসনিক পর্যবেক্ষণ, যেখানে সংশ্লিষ্ট অফিসের নিজস্ব ব্যাখ্যার জায়গা রয়েছে।

সরকারি নথিপত্রে ‘অডিট আপত্তি’ শব্দটি ‘দুর্নীতি’ হিসেবে সংজ্ঞায়িতই নয়। দুদক বা পুলিশের মাধ্যমে তদন্ত ছাড়া কিংবা আদালতের রায় ছাড়া কারো বিরুদ্ধে ‘দুর্নীতির অভিযোগ’ তোলা শুধুই ‘মতামত’ বা ‘রাজনৈতিক ব্যাখ্যা’Ñ যা কোনোভাবে আইনসিদ্ধ নয়।

সংবিধান ও প্রশাসনিক ন্যায়বিচার: বাংলাদেশ সংবিধানের ৩১ ও ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছেÑ ৩১ অনুচ্ছেদ: প্রত্যেক নাগরিক আইনের আশ্রয় লাভে সমান এবং আইনানুগ সুরক্ষার অধিকারী।
৩২ অনুচ্ছেদ: কাউকে জীবন, স্বাধীনতা, দেহ বা সম্পত্তি থেকে আইনবহির্ভূতভাবে বঞ্চিত করা যাবে না।

এই দুটি অনুচ্ছেদের আলোকে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে শাস্তি দেওয়া বা অপসারণ করার জন্য প্রয়োজন- যথাযথ আইনি ভিত্তি, ন্যায্য শুনানি, আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ, যদি অডিট আপত্তিকে সরাসরি দুর্নীতি বলা হয়, তবে তা সাংবিধানিক ন্যায্যতারও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

উচ্চ আদালতের নির্দেশনা, একাধিক দৃষ্টান্ত: হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট বহুবার উল্লেখ করেছেন যে, কোনো তদন্ত ছাড়াই দুর্নীতির অভিযোগে চাকরিচ্যুতি অবৈধ।

একটি দৃষ্টান্ত: Writ Petition No. 7265 of 2022– Secretary, Ministry of Public Administration v. Abdul Quddus

এই মামলায় আদালত পর্যবেক্ষণ করে বলেন- ‘অডিট আপত্তিকে দুর্নীতির অভিযোগ হিসেবে বিবেচনা করা যায় না যতক্ষণ না পূর্ণাঙ্গ তদন্ত ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয়।’

এই রায়ের আলোকে কোনো কর্মকর্তা- যিনি এখনো পর্যন্ত অভিযুক্ত নন, বরং কেবল প্রশ্নবিদ্ধÑ তাকে বরখাস্ত করা এক ধরনের প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচার বলেই প্রতীয়মান হয়।

আন্তর্জাতিক রেফারেন্স: ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার মানদণ্ড-  ILO Convention No. 158, Article 4: A worker shall not be terminated unless there is a valid reason connected with the capacity or conduct of the worker or based on the operational requirements. UN Guidelines on Administrative Justice, 1997


প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে: Hearing rights, Transparency, Opportunity to reply, Independent review.

অডিট আপত্তির ভিত্তিতে যদি শাস্তি দেওয়া হয়, তবে তা আন্তর্জাতিক আইনেও অবৈধ গণ্য হবে।

প্রশাসনিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিততা ও Malafide প্রসঙ্গ: প্রশ্ন ওঠে-হঠাৎ করে কেন একটি অডিট আপত্তিকে ‘দুর্নীতি’ বলে প্রচার করা হলো?

এটা কি একটি পছন্দসই বা সুবিধাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়ার জন্য একটি প্রশাসনিক কৌশল? রেলওয়ের মহাপরিচালকের পদটি কি এখন রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের টার্গেট? প্রতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব ও স্বায়ত্তশাসন কি এখন প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের শিকার?

এসব প্রশ্নের উত্তর না দিলে আমরা প্রজাতন্ত্রের সেবকদের একটি অস্থির ও শঙ্কিত পরিবেশে ফেলছি। পেশাদারিত্ব, নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রশ্নে প্রশাসন যদি রাজনৈতিক খেলার মাঠে পরিণত হয়, তবে এর ফল ভোগ করবে জনগণ এবং রাষ্ট্র নিজেই।

রেলওয়ের বাস্তবতা: নেতৃত্ব সংকট তৈরি হবে: বাংলাদেশ রেলওয়ে একটি কারিগরি ও ভারী অবকাঠামোগত সংস্থা। এর মহাপরিচালক পদে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, প্রকৌশলী ব্যাকগ্রাউন্ডের, প্রশাসনিক দক্ষতা ও নীতিনির্ধারণে অভিজ্ঞ কর্মকর্তার প্রয়োজন। একটি অডিট আপত্তিকে কেন্দ্র করে এমন একজন কর্মকর্তাকে সরিয়ে দিলে- চলমান প্রকল্পের গতি বাধাগ্রস্ত হবে, প্রতিষ্ঠানের ভিতরে অনাস্থা ও ভয় জন্মাবে, নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রকল্প অনুমোদনÑ সবখানে অনিশ্চয়তা তৈরি হবে, অন্যদিকে, অপসারণের মাধ্যমে যদি রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বা প্রশাসনিক আধিপত্য কায়েম করা হয়, তবে রেলওয়ের নিজস্ব স্বায়ত্তশাসন ক্ষতিগ্রস্ত হবে—যা ৫৯ ও ৬০ অনুচ্ছেদেরও পরিপন্থী।

পোষ্য সোসাইটির অবস্থান: আইন ও ন্যায়ের পক্ষে স্পষ্ট ভাষা:

বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি একেবারে সুনির্দিষ্ট ভাষায় বলেছে- অডিট আপত্তি কোনো দুর্নীতির প্রমাণ নয়, আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া অপসারণ চলবে না, প্রয়োজনে উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়া হবে, মহাপরিচালকের স্থিতি মানে রেলওয়ের স্থিতি, এই অবস্থান শুধুই কোনো ব্যক্তি বিশেষের পক্ষে নয়, বরং এটি একটি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্ব, প্রশাসনিক ন্যায্যতা, এবং রাষ্ট্রচিন্তার পক্ষে এক সাহসী ঘোষণা।

দুর্নীতি দমন চাই, কিন্তু আইন ভাঙার ছলে নয়: আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে চাই। আমরা চাই প্রশাসনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও ন্যায্যতা। কিন্তু সেই লড়াই হতে হবে সংবিধান মেনে, আইন মেনে, প্রক্রিয়া মেনে।

অডিট আপত্তি একটি পর্যবেক্ষণ- তথ্য যাচাইয়ের অনুরোধমাত্র। এটি দুর্নীতি নয়, দুর্নীতির প্রমাণ নয়, এবং কোনোভাবেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার যৌক্তিক ভিত্তি নয়।

অতএব, প্রশাসনের প্রতি আমাদের আহ্বান: অডিট আপত্তিকে রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক হাতিয়ার না বানিয়ে, এটিকে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তি করুন। ন্যায্য বিচার, পেশাগত সম্মান এবং রাষ্ট্রচিন্তাÑএই ত্রিভুজেই গড়ে উঠুক আমাদের ভবিষ্যৎ।

মনিরুজ্জামান মনির: সাংবাদিক ও কলামিস্ট এবং  সভাপতি, বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি।

আজকালের খবর/আরইউ








http://ajkalerkhobor.net/ad/1751440178.gif
সর্বশেষ সংবাদ
এশিয়া কাপের প্রাথমিক দল ঘোষণা, দলে ফিরলেন সৌম্য-শান্ত
দেশের মানুষ পরিবর্তন চায়: তারেক রহমান
দেশ নিয়ে একটা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চলছে: মির্জা ফখরুল
গৌরব গাঁথায় ১২ শহীদের উপজেলা দেবীদ্বারে
রামুতে ১৫ ফুট লম্বা অজগর উদ্ধার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
জুলাইয়ে হামলার উসকানিদাতা হয়েও বিচারের বাইরে জাবির দুই শিক্ষক
বরিশালের গৌরনদীতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার
সাবেক সেনা প্রধান হারুন অর রশিদ চট্টগ্রামে মারা গেছেন
সাজিদ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে উত্তাল ইবি, রাবি ও ঢাবি
হুট করে বাড়লো পেঁয়াজ ও ডিমের দাম
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft