রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের প্রাণহানি এবং আহত হওয়ার ঘটনা শুধুই একটি দুর্ঘটনা নয়- এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থার এক নির্মম ও ভয়াবহ ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ।
সরকারি সূত্রে নানা রকম মৃত্যুর কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি কোনো দুর্গম চরে, নদীতে বা পাহাড়ে ঘটেছে?
না, এটা ঘটেছে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, যেখানে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর উপস্থিতি, রোল নম্বর, পরিচয়পত্র কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে থাকার কথা। তাহলে এখনো কেন নির্ভরযোগ্য মৃত্যুসংখ্যা নেই? কেন আহতদের পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করা হয়নি? এই প্রশ্নের উত্তর রাষ্ট্রকেই দিতে হবে।
আমরা কি ভুলে যাচ্ছি? ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার ওপর চালানো দমন-পীড়নেও যারা প্রাণ হারিয়েছেন বা অঙ্গহানি হয়েছেন, তাদের নাম-পরিচয় এখনো অজানা।
সরকারিভাবে তাদের কোনো তথ্য সংরক্ষণ করা হয়নি। এই দায় এড়ানো যায় না। এটি কেবল প্রশাসনিক গাফিলতি নয়- এটি আমাদের রাষ্ট্রের নৈতিক দায়বোধের বিপর্যয়।
রাষ্ট্র যদি সত্যিকারের শোক প্রকাশ করতে চায়, তবে শোককে অর্থবহ করতে হয়। এর মানে হচ্ছে-সত্যকে স্বীকার করা, ভুলকে চিহ্নিত করা, এবং দায়িত্ব নিতে শেখা।
আমরা চাই- এই বিমান দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত সবার একটি সুনির্দিষ্ট যাচাইকৃত তালিকা প্রকাশ করা হোক। এটা প্রশাসনিক স্বচ্ছতার প্রশ্ন নয় শুধু- এটা নিহতদের প্রতি জাতির শ্রদ্ধা জানানোর ন্যূনতম সম্মান।
এই শিশু-কিশোরেরা চোখে স্বপ্ন নিয়ে ক্লাসে গিয়েছিল। তারা কেউ জানতো না, সেদিনই শেষ দিন। তাদের পোড়া শরীর, ছাই হয়ে যাওয়া জামা, শনাক্তহীন মুখগুলো আমাদের ঘুম কেড়ে নিয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্র কি এখনো ঘুমিয়ে আছে?
আমি জানি না কীভাবে বেঁচে আছেন সেই বাবা-মায়েরা, যারা সকালে সন্তানকে বইয়ের ব্যাগ কাঁধে তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু এখন তাদের সেই সন্তান পুড়ে যাওয়া কঙ্কাল হয়ে ফিরে এসেছে হাসপাতালের বারান্দায়।
আমার বুকেও ধাক্কা লাগে যখন শুনি- একজন বাবা ছেলের দাফন শেষ করে হাসপাতালের করিডোরে ফিরে এসে জানতে পারেন- এইবার তার মেয়েটিও আর নেই।
একটি পরিবার, এক দিনেই ইতিহাস হয়ে গেল! একটি মানুষ, এক দিনে দুটি সন্তান হারালেন! দয়া করে বলুন, কীভাবে বাঁচবেন তিনি? কী নিয়ে বাঁচবেন?
এই মানুষগুলো কোনো অপরাধী নয়। তারা শুধু তাদের সন্তানকে শিক্ষার জন্য স্কুলে পাঠিয়েছিল।
আমরা কি এমন রাষ্ট্রে বাস করছি, যেখানে কেউ নিজের সন্তানকে স্কুলেও নিরাপদ রাখতে পারেন না? এই প্রশ্ন আজ শুধু তাঁদের নয়- আমাদের সবার। এই প্রশ্ন আজ রাষ্ট্রের প্রতি।
আরো একটি প্রশ্ন আমার মনে বারবার ঘুরে ফিরে আসছে- কোন যুক্তিতে একজন নতুন প্রশিক্ষণার্থী পাইলটকে তার একক ‘লাস্ট ট্রেনিং ফ্লাইটে’ সুপারসনিক ফাইটার বিমান নিয়ে উড্ডয়নের অনুমতি দেওয়া হলো, তাও ঢাকার মতো ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ঘেরা এলাকার আকাশপথ ধরে? এই সিদ্ধান্ত কে নিয়েছিলেন? কার নির্দেশে এবং কোন মূল্যায়নের ভিত্তিতে এমন ভয়াবহ ঝুঁকির প্রশিক্ষণ একটি কলেজ মাঠ, শিক্ষার্থী এবং হাজারো নাগরিকের জীবনের উপর চাপিয়ে দেওয়া হলো?
তদুপরি, আমরা জানতে চাই- যখন পাইলট নিয়ন্ত্রণ কক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তখন তিনি কোন অবস্থানে ছিলেন? কোন মুহূর্তে তাকে ‘ইজেক্ট’ করতে বলা হয়? তিনি কি সেই নির্দিষ্ট জায়গাতেই ইজেক্ট করেছেন, নাকি অন্য কোথাও?
এই প্রতিটি প্রশ্নের নির্ভুল ও প্রমাণভিত্তিক উত্তর আমাদের জানার অধিকার রয়েছে।সরকারি তথ্য চ্যানেলের মাধ্যমে গণমানুষের কাছে এসব তথ্য স্পষ্টভাবে প্রকাশ করা হোক।
কারণ আমরা জানতে চাই- এটি কি সত্যিই একটি প্রশিক্ষণ ছিল, নাকি আমাদের নাগরিক জীবনের উপর একটি নির্মম পরীক্ষা চালানো হলো?
আমরা দেখি- হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর একটি শহরের বুকের মাঝখানে স্থাপিত। প্রতিদিন হাজারো ফ্লাইট ঢাকার মাথার উপর দিয়ে উড়ে যায়। এই এয়ারস্পেসে প্রায় তিন থেকে চার কোটি মানুষ বাস করে। তাদের নিরাপত্তা কোথায়?
এই এয়ারপোর্ট কি আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কোড অনুযায়ী পরিচালিত হয়?
আমি দুঃখের সঙ্গে বলি- বিশ্বের আর কোনো দেশে আমি এমন উদাহরণ দেখি না। এইভাবে মানুষকে মৃত্যুর মুখে ফেলে রাষ্ট্র গৌরবের পতাকা ওড়াতে পারে না।
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পার হয়ে গেছে। তবু আমরা আজো কোথায় দাঁড়িয়ে আছি? শিক্ষা, নিরাপত্তা, সিভিল এভিয়েশন, স্বাস্থ্য, কোথাও কি আমরা আত্মবিশ্বাস নিয়ে বলতে পারি, হ্যাঁ, এখানে পরিবর্তন হয়েছে?
আমরা কি সত্যিই এমন এক রাষ্ট্রে বাস করছি, যেখানে নিয়ম নেই, নিয়ন্ত্রক নেই, এবং মানুষের জীবনের কোনো মানে নেই?
রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের ভালোবাসা আছে, কিন্তু সেই ভালোবাসার ভিত্তি হলো দায়িত্ব, জবাবদিহি ও ন্যায়বোধ। আর সেই জবাবদিহি যদি না আসে, তবে আমরা প্রশ্ন করতেই থাকব- আর প্রতিবার এই প্রশ্নটা আরও জোরালো হবে।
বি.দ্র.: সামান্য একটু ডান হাত পুড়ে ছয় মাস যন্ত্রণা সহ্য করেছি- কী ভয়ংকর কষ্ট সেটা আমি জানি। তাই আজকের এই ট্র্যাজেডি আমার কাছে শুধু একটি খবর নয়, বুকের ভেতর পোড়া একটা ক্ষত। ওই শিশুদের যন্ত্রণার কল্পনাই শরীর কাঁপিয়ে দেয়। এটা দুর্ঘটনা নয়! এক ভয়াবহ ব্যর্থতা, যেটার দায় এড়ানো যায় না।
পারভেজ আবীর চৌধুরী: চিত্রনায়ক।
আজকালের খবর/আরইউ