‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে...।’ ভূপেন হাজারিকার গানের মানবিক এই শ্লোকের গুরুত্ব, মাহাত্ম্য, মর্মার্থ এখনও সমভাবে বহমান। উত্তরার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনের উপর বিমান বিধ্বস্ত হয়ে হতাহতের ঘটনায় ভূপেন হাজারিকার এই গানের মর্মার্থের যথার্থতা কিংবা এর প্রতিফলন ঘটেছে। এই স্কুলেরই একজন শিক্ষিকা একে একে ২০টি শিশু শিক্ষার্থীর নিশ্চিত মৃত্যর হাত থেকে রক্ষা করে নিজে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে নিলেন। তার জীবন দান জাতির জন্য এক বিরল দৃষ্টান্ত এবং অনন্য নজির। তিনি জাতির শ্রদ্ধা, ভালোবাসার পাত্র এবং জাতীয় বীর। শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগ কেবল এক ব্যক্তির আত্মত্যাগ নয়, এ আত্মত্যাগ হয়ে রইল সাহস, দায়িত্ববোধ এবং ভালোবাসার অনন্য এক উদাহরণ হয়ে। তিনি বাঁচাতে চেয়েছিলেন তার শিক্ষার্থীদের। মধ্য দিয়ে নিজের জীবনটা অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছেন। আজ সেই মা, শিক্ষিকা , সংগ্রামী নারীকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
প্রয়াত শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী নিজের দুই সন্তানের মায়া, নিজের ছাত্রছাত্রীদের জন্যও অমোঘ মায়া। হেরে গেলেন মা মাহেরীন, জিতে গেলেন শিক্ষিকা মাহেরীন ম্যাডাম। ‘জিতিয়ে গেলেন শিক্ষকতার মতো মহান পেশাকে। অনিয়মের দেশে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির চেয়ে আরও ভয়াবহ অনেক কিছুই চলে আসবে সামনে, আমাদের নিয়তি এমনই। ভবিষ্যতের আলো বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টায় নিজেই পরপারে চলে গেলেন মাহেরীন চৌধুরী।’ তার কথায়, ‘নিয়তির নিষ্ঠুরতাকে ব্যতিক্রম প্রমান করে মা, বাবা, শিক্ষক এই তিন-এ কোনো পার্থক্য রাখতে দেননি দ্য সিক্রেট সুপারস্টার ম্যাম মাহেরীন। বিনম্র শ্রদ্ধা, শোক পরিণত হোক শক্তিতে। আকস্মিক ঝড়ে ঝরে যাওয়া সব ফুলগুলো প্রস্ফুটিত হোক জান্নাতের বাগানে, আমিন।’
এ প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আরেকটি বিষয় যেটি সে দিন এই মর্মান্তিক ঘটনার সময় উপস্থিত অনেকের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল সেসম্পর্কে আলোকপাত করা প্রয়োজন। আগুনে পুড়ে যাওয়া শিশু শিক্ষার্থীসহ অন্যরা যখন যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে এবং পানি পানি করে আর্তনাদ করছে তখন উপস্থিত অভিভাবক ও অন্যরা পাশ্ববর্তী দোকানে পানি কিনতে গিয়ে অমানবিক এবং অবিশ্বাস্য ঘটনায় ক্ষোভ ঘৃণার জন্ম দিয়েছে। তা হচ্ছে পানি ব্যবসার নামে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অতি এবং অবিশ্বাস্য মুনাফার অমানবিক দৃশ্য ফুটে ওঠেছে। এক লিটারের পানির বোতলের দাম নিয়েছে আড়াই থেকে তিনশ আর দুই লিটারের পানির বোতলের দাম নিয়েছে ছয়শ টাকা। একই ভাবে অগ্নিদগ্ধদের নিকটস্থ হাসপাতালে নেয়ার জন্য রিকশা, সিএনজি, অটো, মাইক্রোর ভাড়া আদায় করেছে আনুমানিক ভাড়ার পঞ্চাশ থেকে একশ গুন বেশী হারে। একই ঘটনায় একজন শিক্ষিকার স্বেচ্ছায় আত্মত্যাগ, আত্মাহুতি আর অন্য দুটো ঘটনা কতটা অমানবিক, পশু সূলভ আচরণ এটা জাতির জন্য, আমাদের সমাজের জন্য দু:খের, লজ্জার এবং ঘৃণার জন্ম দেয়।
মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় এমনিতে পুরো দেশের সর্বস্তরের মানুষ গভীর শোকে শোকাহত। সরকারি ভাবে ২১ জুলাই’র মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের স্বরনে এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্য লাভে জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে এই ঘটনায় নিহতদের যথাযথ স্মৃতি সংরক্ষণ এবং আহতদের চিকিৎসায় সর্বাত্মক সহায়তার আশ্বস দেওয়া হয়েছে। সরকার গৃহীত এসব ব্যবস্থা সাময়িক। তবুও কথা থাকে যেসব শিশু কিশোর শিক্ষার্থীর জীবন প্রদীপ নিভে গেলে পৃথিবীকে জানবার, বুঝবার আগেই। তাদের ঘিরে পরিবারের স্বপ্ন ছিল একদিন তারা বড় হয়ে শিক্ষা অর্জন শেষে পরিবারের, রাষ্ট্রের হাল ধরবে তা মুহূর্তেই মাটিতে মিশে গেলো। মুহূর্তেই জ্বলে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেলো। রাজধানীর উত্তরাস্থ দিয়াবাড়ির মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ ভবনের উপর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হলে ঘটে স্বরণকালের মর্মান্তিক এবং ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। এতে হতাহতের চূড়ান্ত হিসেব এখনো বলা যাচ্ছে না। এই বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় ৩৪ জন নিহত হয়েছে এবং শতাধিক রোগী এখনো জীবন মৃত্যুর প্রহর গুনছে বিভিন্ন হাসপাতালে। এই ভয়াবহন বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার করুণ ট্র্যাজেডির গত ২৩ জুলাই আইএসপিআর, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় কর্তৃক আয়োজিত সংবাদ সম্মেলন থেকে তথ্য প্রকাশ করেছে। উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ চত্বর এখন আর কোলাহলমুখর শিক্ষাঙ্গন নয়। এখন তা যেন এক নির্বাক স্মৃতিস্তম্ভ- যেখানে পড়ে আছে পোড়া খাতা, ছেঁড়া ব্যাগ, পুড়ে যাওয়া টিফিন বক্স আর ছোট ছোট জুতা। প্রতিটি বস্তুই যেন একটি করে না বলা গল্প- ভয়াবহ এক বাস্তবতার নীরব সাক্ষী।
ঘটনার আগের দিন সকালে মা হয়তো উঠে দাঁড়িয়েছিলেন ভোর ৬টায়, ছেলের জন্য বানিয়েছিলেন প্রিয় খিচুড়ি বা পোলাও। বলেছিলেন, ‘বাবা, আজ তোকে ভালো খাবার দিয়ে দিলাম।’ সেই খাবার আর কারো মুখে তোলা হয়নি, টিফিন বক্স খুলেও দেখা হয়নি। রান্না করা সেই ভালোবাসার খাবার আজ পড়ে আছে পোড়া ভবনের ধ্বংসস্তূপে।
আগুনে দগ্ধ হয়ে যেসব শিশু কিশোর শিক্ষার্থী মারা গেছে তাদের এই অসময়ে পৃথিবী থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে তাদের আত্মার মাগরফেরাত কামনা করছি। এবং শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি।
এই ঘটনায় হাসপাতালে মুমূর্ষু অবস্থায় চিকিৎসাধীন থাকা শিক্ষিকা মাহেরীনের স্বামী মাহেরীনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তোমার নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না! সে বলেছিল, ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি? অনেক মায়ের সন্তানকে বাঁচিয়ে চলে গেলেন মাহেরীন, ঘরে রইল তার মা-হারা দুই সন্তান। নিহত শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীর স্বামী মনসুর হেলাল একবুক কষ্ট নিয়ে এ কথাগুলোই বলছিলেন। ভাই মুনাফ চৌধুরী জানান, ওখানে যারা ছিলেন, তারা আমাদের বলেছেন, মাহেরীন ইচ্ছা করলে বের হতে পারতেন, কিন্তু হননি। উনি বাচ্চাদের আগে বের করার চেষ্টা করেন।
২০ জুলাই সোমবার দুপুরের এ বিভীষিকায় মুহূর্তেই প্রাণ হারায় অনেক শিশু। তাদের সঙ্গে মারা যান তাদেরই প্রিয় শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী, যিনি মাইলস্টোনের ওই শাখায় সমন্বয়ক ছিলেন। সেখানে থাকা এবং পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা বলেন, শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে মাহেরীন নিজে বের হতে দেরি করেন। সোমবার দুপুরের এ বিভীষিকায় মুহূর্তেই প্রাণ হারায় অনেক শিশু। আগুনের লেলিহান শিখার মাঝখানে দাঁড়িয়ে মাহেরীন চেষ্টা করছিলেন তার শিক্ষার্থীদের বের করে আনতে। নিজের জীবন দিয়ে যেন অনেক মায়ের কোল রক্ষা করে গেলেন তিনি। গুনের ভেতরেও তিনি মানবতা এবং মাতৃত্বের, সহানুভূতির আলো জ্বালিয়ে রেখেছিলেন।
তার ভাই মুনাফ মুজিব চৌধুরী বলছিলেন, ‘উনার মানসিক জোর ছিল অদ্ভুত রকমের। বার্ন ইউনিটে পৌঁছেও আমরা তাকে জীবিত পেয়েছিলাম। কথা বলছিলেন। কিন্তু অবস্থাটা খুবই খারাপ ছিল। পরে চিকিৎসকেরা জানান, তার শ্বাসনালি পুরোপুরি পুড়ে গিয়েছে।’ চিকিৎসকরা জানান, মাহেরীনের শরীরের প্রায় ১০০ শতাংশই দগ্ধ হয়েছিল। তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়, কিন্তু সোমবার রাত ৯টার কিছু আগে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
এদিকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগমুহূর্তে স্বামী মনসুর হেলালের সঙ্গে কিছু সময়ের জন্য কথা হয় মাহেরীনের। তিনি বলেন, ‘স্কুল ছুটির পর বাচ্চাদের নিয়ে বের হচ্ছিলেন মাহেরীন। সেই সময়েই গেটের সামনেই বিমানটা বিধ্বস্ত হয়। তখনও সে চেষ্টা করেছে বাচ্চাদের বাঁচাতে। নিজে দগ্ধ হয়েও।’ মাহেরীনের সংসারে রয়েছে দুটি সন্তান একজন নবম শ্রেণিতে পড়ছে, বয়স ১৪ অন্যজন ও লেভেলের শিক্ষার্থী, বয়স ১৫ বা ১৬। স্কুলগামী সেই দুই শিশুর জীবন থেকে মাত্র এক ঝলকেই হারিয়ে গেল তাদের সবচেয়ে বড় আশ্রয় তাদের মা। নীলফামারীর জলঢাকার বগুলাগাড়িতে তার দাফন সম্পন্ন হয়। এদিকে দুর্ঘটনার পর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর জানায়, এফ-৭ বিজিআই মডেলের ওই প্রশিক্ষণ বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিয়েছিল। কিন্তু সেই ত্রুটির প্রকৃতি, এবং একটি জনবহুল এলাকার ওপর দিয়ে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট চালানোর যৌক্তিকতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন এখন ঘুরে বেড়াচ্ছে লাখো মানুষের মনে। রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয়েছে শোক, কিন্তু ক্ষতগুলো থেকে যাবে আরও অনেক দিন। প্রত্যাশা থাকবে বিমান উড্ডয়নের জন্য বিমান বন্দরসহ সংশ্লিষ্ট এলাকাকে এয়ার মার্ক করে সেসব এলাকায়, সব রকম আবাসিক, অনাবাসিক, বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বহুতল ভবন স্থাপন সম্পূর্ণ ভাবে বন্ধ রাখা। একই ভাবে প্রশিক্ষণ বিমানসহ যাত্রিবাহী বিমান চলাচলের জন্য সব রকম আবাসিক, অনাবাসিক, বাণিজ্যিক, বহুতল ভবন, বাণিজ্যিক ভবন সংলগ্ন এলাকাকে অব মুক্ত রাখা উচিত। কিন্তু দু:খজনক হলেও সত্য এসব নিয়ম নীতি বাস্তবায়, অনুসরণ ও পালনে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, বেসামরিক বিমান পরিবহন কর্তৃপক্ষ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা নিয়ে অভিযোগ রয়েছে নগরবাসির। একই সঙ্গে প্রত্যাশা করছি এরকম দুর্ঘটনায় আর কোনো মায়ের বুক খালি হবে না। আর কাউকে এভাবে জীবন দিতে হবে না।
মোতাহার হোসেন: সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।
আজকালের খবর/আরইউ