প্রতিদিনই স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সেই স্বপ্নগুলোর শরীরে নেমে আসে রাত্রির ঘাম, এক অজানা আতঙ্ক। স্বপ্ন দেখি, তবু আশঙ্কায় কাঁপে মন- বাংলাদেশ, তুমি কি তবে দিশাহারা? ঘুমের দেশে উঁকি দেয় দুঃস্বপ্ন, বাস্তবের মুখোশ খুলে দেয় নাগরিক জীবনের তীব্র বেদনা। একটা দেশ, যে দেশ স্বাধীনতা চেয়েছিল-সেই দেশের সন্তান এখন স্বাধীনতার মানে খোঁজে-চাকরি পাওয়ার লাইনে, চিকিৎসার অপেক্ষায়, শিশু নিরাপত্তায় শিক্ষার অভাব। তবু আমরা স্বপ্ন দেখি। কবির ভাষায় বলতে হয়: ‘এই স্বপ্ন, এই বেদনা, এই রক্তে ভেজা মাটি- আমার বাংলাদেশ।’ তবে প্রশ্ন জাগে: দেশটা কি সঠিক পথে আছে? না কি এই স্বপ্নপূরণ অনিশ্চয়তার ধোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে?
দেশপ্রেম কি শুধুই প্রতীকে? আমরা উৎসবে পতাকা ওড়াই, ফেসবুকে ‘বাংলাদেশ আমার গর্ব’ লিখি। কিন্তু রাস্তায় ময়লা ফেলি, কর ফাঁকি দিই, একটিবারও ভাবি না- আমার আচরণ দেশের ক্ষতি করছে কি না। স্কুল-কলেজে দেশপ্রেম শেখানো হয়, কিন্তু বাস্তব জীবনে তার চর্চা নেই। যে শিক্ষার্থী জাতীয় সংগীত গাইছে, সে-ই বাসে ভাংচুর করছে। দেশপ্রেম মানে শুধু গলার আওয়াজ নয়, তা আচরণে, নীতিতে, ন্যায্যতার চর্চায় প্রকাশ পায়। দেশের জন্য ভালোবাসা মানে নিজের সীমিত সার্থকে দেশের বৃহত্তর কল্যাণের পেছনে বিলিয়ে দেওয়া। এটা আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সবার ভিতরে ঢুকিয়ে দিতে হবে। বাবা-মা যদি ঘরে দেশপ্রেম শেখান, স্কুল তা লালন করে, আর রাষ্ট্র তা সম্মান দেয়-তবেই প্রজন্ম সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হবে। কেবল পতাকা ওড়ানো, গানের লাইন মুখস্থ করলেই দেশপ্রেম জন্মায় না। জন্মায় আত্মত্যাগের শিক্ষা থেকে।
নেতৃত্বের আলো কোথায়? আমরা নেতা চাই না, দরকার একজন দিশারী। যিনি নিজের স্বার্থ নয়, দেশের স্বপ্নে চোখ রাখবেন। আজ বহু জনপ্রতিনিধি আছেন, কিন্তু কেউ জনগণের দুঃখ শোনেন না। দেশের প্রতি ভালোবাসা না থাকলে ক্ষমতা হয় ব্যবসার অস্ত্র। সাধারণ মানুষ নেতা চায় না- সে একজন মা-বাবা চায়, যিনি সুরক্ষা দেবেন, দিশা দেখাবেন, দুর্দিনে পাশে থাকবেন। কিন্তু এখন রাজনীতি হয়ে গেছে পদ-পদবির লড়াই। ক্ষমতার বদলে সেবার মানসিকতা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমাদের দরকার ‘নেতা’ নয়, দরকার এক-একজন আলোকবর্তিকা, যাদের আলোয় জাতি পথ খুঁজে পায়। রাজনৈতিক সাহসিকতা, সৎ সাহচর্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রতিশ্রুতি ছাড়া কোনো নেতৃত্ব টিকবে না। যে দেশে নায়কেরা ইতিহাস রচনা করত, এখন সেখানে প্রচারেই নায়ক তৈরি হয়। এই ধারার পরিবর্তন জরুরি। রাষ্ট্রনায়কের ভূমিকায় যারা থাকবেন, তাদের রক্তে মিশে থাকতে হবে মাটি, মানুষের কান্না আর জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার দায়।
তরুণেরা বেকার, তবু অপরাধে দক্ষ! দেশের ৪৭ শতাংশ শিক্ষিত তরুণ বেকার-এটা শুধু পরিসংখ্যান নয়, একটি জাতির হারিয়ে যাওয়ার সঙ্কেত। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়া তরুণেরা ৫-১০ বছর ধরে চাকরি খুঁজছে। বিসিএসের পেছনে লাখো টাকা খরচ করে হতাশ হচ্ছে। তাদের কেউ কেউ অনলাইন জুয়া, ডেটিং অ্যাপ ব্যবহার করে প্রতারণায়, মাদকে কিংবা বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে পাচারে জড়িয়ে পড়ছে। রাষ্ট্রের তরফে তাদের সঠিক দিকনির্দেশনা, মানসম্মত কর্মসংস্থান, বা উদ্যোক্তা হবার মতো প্রশিক্ষণ দিচ্ছে না। যে তরুণরা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিল, আজকের প্রজন্ম সেই দেশের বুকে বেকারত্বে গুমরে মরছে। এ যেন নতুন এক পরাধীনতা। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে শিক্ষানীতি, কর্মনীতি ও শিল্পনীতিকে এক বিন্দুতে আনা জরুরি। দেশের পলিসি মেকারদের উচিত হবে তরুণদের ডিজিটাল, কৃষি ও সৃজনশীল খাতে কর্মসংস্থান গড়ে তোলা- না হলে আগামী প্রজন্ম শুধু বিদেশমুখী হবে, দেশের মেরুদণ্ড দুর্বল হবে।
শিক্ষা না পণ্য, এখন এক প্যাকেজ! শিক্ষা এখন ব্র্যান্ডেড পণ্য। স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটি মানে টাকা, কোচিং, গাইড, নম্বর। মেধা চাপা পড়ে প্রাইভেট টিউশনের চাপে। শিক্ষক মানে আজকাল প্রশ্নব্যাংক সরবরাহকারী। শিক্ষকের সম্মান হারিয়েছে তার নৈতিক অবস্থা হারিয়ে। শিক্ষা ব্যবস্থায় মানবিকতা নেই, ইতিহাসচর্চা নেই, শিল্প ও সংস্কৃতির অনুশীলন নেই। সব কিছুই চাকরির পেছনে দৌড়ে ন্যূন। সৃজনশীলতা ও যুক্তি চর্চার জায়গা নেই বললেই চলে। শিক্ষা হতে হবে আলোকিত মানুষ গঠনের হাতিয়ার। পাঠ্যবইয়ে নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ, উদারতা, পরিবেশ, বৈশ্বিক নাগরিকত্ব-এসব যুক্ত না করলে, আমরা কেবল ‘ডিগ্রিধারী’ সৃষ্টি করব, নাগরিক নয়। গ্রামে-শহরে শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য, ইন্টারনেট সুবিধার ঘাটতি এবং শিক্ষকদের অবহেলিত অবস্থানÑ এসব দূর না করলে শিক্ষার মান উন্নত হবে না। পাঠ্যসূচির আধুনিকায়ন ও শিক্ষকদের পেশাগত মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করাই হবে বড় দেশপ্রেম।
দেশে চিকিৎসা এখন দুঃস্বপ্ন! সরকারি হাসপাতালে গেলে ওষুধ নেই, বেড নেই। বেসরকারিতে গেলে খরচ সামলানো অসম্ভব। ডাক্তারদের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে, নার্সদের আচরণ নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে। দুর্ঘটনা বা জটিল রোগ হলে বিদেশই একমাত্র ভরসা। অথচ এক দেশপ্রেমিক চিকিৎসক যদি আন্তরিকতা নিয়ে এগিয়ে আসে, পুরো ব্যবস্থা তাকে থামিয়ে দেয়। টেন্ডার, কমিশন, ফার্মার দাপট সবকিছুর উপরে। স্বাস্থ্যখাতের বাজেট বাড়ানো জরুরি। ডাক্তারদের নৈতিক প্রশিক্ষণ, হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা সংস্কার, রোগীকে মানুষ হিসেবে দেখা- এই সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে। মফস্বলের হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার নেই, অ্যাম্বুলেন্স সংকট, জরুরি সেবার মান শোচনীয়। গ্রামের রোগীরা এখনও তাবিজ আর ঝাড়ফুঁকের ওপর নির্ভর করে। এই চিত্র পাল্টাতে হলে বাজেটের চেয়েও বেশি জরুরি হচ্ছে সদিচ্ছা ও জবাবদিহি।
আইন কি কেবল গরিবের জন্য? বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের প্রশ্নে সাধারণ মানুষের আস্থা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। ধনী কিংবা ক্ষমতাবান কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই দেখা যায় মামলা গুম হয়ে যায়, কিংবা নানা অজুহাতে স্থগিত থাকে। আর গরিব চোর, চুরি করুক বা না করুক, আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়, বছরের পর বছর জেল খাটতে হয়। সমাজের প্রভাবশালীরা আইনকে নিজের পকেটের বই মনে করে। তাদের জামিন পেতে ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে না, কিন্তু একজন দরিদ্র মানুষ ছোটখাটো অপরাধ করলেও জামিন পায় না, বরং পরিবারসহ কষ্টে দিন কাটায়। শিশু ধর্ষণ কিংবা নারী নির্যাতনের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধের বিচার হয় না সময়মতো। ভুক্তভোগীর পরিবারকে হুমকি দেওয়া হয়, কখনো চাপ সৃষ্টি করা হয়। ফলে তারা ন্যায়বিচার পাওয়ার আগেই হার মেনে নেয়। আইন সবার জন্য সমান নয়- এমন ধারণা মানুষকে আইন নিজের হাতে তুলে নিতে শেখাচ্ছে। এই বিচারহীনতা রাষ্ট্রের ভিত্তি নষ্ট করছে। আইন কেবল বইয়ে থাকলে কোনো কাজ হয় না। তা প্রয়োগ না হলে সাধারণ মানুষ আর রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস রাখে না।
রাজনীতিবীদদের কাছে ‘দল’ বড়, ‘দেশ’ ছোট। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি এখন এমন যে দলীয় স্বার্থই সর্বাগ্রে, আর দেশের স্বার্থ সবসময় পিছনে পড়ে। সরকার আর বিরোধী দল যেন দুই শত্রুপক্ষের যুদ্ধক্ষেত্র, যেখানে গণতন্ত্রের আসল মূল্যবোধ চাপা পড়ে যাচ্ছে। একে অপরের বিরুদ্ধে অপবাদ, কাদা ছোড়াছুড়ি চলছে; সাধারণ মানুষের সমস্যা সমাধানের জন্য কেউ বসে কথা বলতে চায় না। রাজনীতির উদ্দেশ্য হওয়া উচিত দেশের উন্নয়ন, কিন্তু তা এখন ক্ষমতার লড়াইতে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে। আজ যেকোনো জাতীয় সংকট বা সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক ঐক্য সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল। কিন্তু এখানে দেখা যাচ্ছে, দলের জয় আর হারকে কেন্দ্র করে সমাধানের বদলে সমস্যা আরও জটিল হচ্ছে। গণতন্ত্রের নামে এই দলীয় ক্ষমতার লড়াই সাধারণ মানুষের কাছে হাস্যকর হয়ে উঠেছে। দেশের স্বার্থে না ভেবে দলীয় স্বার্থে সিদ্ধান্ত নেওয়া রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি।
এদেশের কৃষক এখন হাসছে না। বাংলাদেশের কৃষক আজ নিরাশ। ধান বা শাকসবজির দাম এত কম যে অনেক সময় কৃষক তার ফসল বাজারে না নিয়ে ফেলে দেয়। অথচ চাষের খরচ বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে। সারের দাম, কীটনাশক, শ্রমিকের মজুরিÑ সবকিছু মিলিয়ে কৃষকের উৎপাদন খরচ আর বিক্রির দামের সঙ্গে কোনো সঙ্গতি নেই। ফলে কৃষি আর কৃষকের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। আমদানির নামে কৃষিপণ্য বাজারে সিন্ডিকেট চালু হয়েছে। কৃষক নিজস্ব ফসল বিক্রি করতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, অথচ বিদেশি পণ্য আমদানি করে ব্যবসায়ীরা মুনাফা লুটছে। একটা দেশ কৃষিকে অবহেলা করলে কখনো টিকে থাকতে পারে না। কৃষক যদি তার ন্যায্য দাম না পায়, তাহলে খাদ্যনিরাপত্তা ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই কৃষকের মুখে হাসি ফিরিয়ে আনতে হবে—তাদের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
শহর মানে রাস্তায় আটকে থাকা জীবন! ঢাকার যানজট এখন এক ভয়ঙ্কর অভিশাপ। প্রতিদিন লাখো মানুষ তাদের সময়ের অর্ধেকটা রাস্তায় কাটিয়ে দেয়। বাসা থেকে অফিসে যেতে তিন ঘণ্টা লাগে, ফেরার পথে একই দুর্ভোগ। জীবনের মূল্যবান সময় এভাবে অপচয় হয়ে যাচ্ছে। ঢাকার এই যানজট শুধু মানুষের স্নায়ুক্ষয়ই ঘটাচ্ছে না, অর্থনীতিতেও বড় ক্ষতি করছে। জনসংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিন, কিন্তু রাস্তাঘাটের পরিকল্পনা এখনো ১৯৮০-এর দশকের মতোই। যেখানে এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেলের মতো আধুনিক ব্যবস্থা দরকার, সেখানে পরিকল্পনা হয় ধীরগতিতে। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার কথা বলা হলেও পরিবহন খাতে কোনো স্মার্ট গতি নেই। যানজটের কারণে উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে পড়ছে দুঃসহ।
নিঃশ্বাসে বিষ-নদী, গাছ, বাতাস সব দখলে! আমাদের নদীগুলো দখল আর দূষণে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দখলদাররা নদীর ওপর বসতি গড়ছে, কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যে নদীর পানি কালো হয়ে যাচ্ছে। এর ফলে মাছ মরে যাচ্ছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। রাজধানীতে গাছ কেটে জায়গা দখল করে কংক্রিটের শহর বানানো হচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অক্সিজেন কিনে নিতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের কারণে আমাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে। পরিবেশ রক্ষায় শক্ত রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি দরকার। শুধু আইন করলেই হবে না, তার সঠিক প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা দরকার। প্রকৃতিকে বাঁচাতে না পারলে অর্থনৈতিক উন্নয়নও কোনো কাজে আসবে না।
এদেশে সত্য বলা পাপ! বর্তমান সময়ে সাংবাদিকতা যেন এক বিপজ্জনক পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সত্য প্রকাশ করলেই মামলা, জেলে পাঠানো বা তুলে নেওয়ার ভয় থাকে। মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে যে ব্যবস্থা চলছে, তা আসলে গণতন্ত্রকে দুর্বল করছে। যে জাতি তথ্য গোপন করে চলে, সেই জাতি কখনো এগোতে পারে না। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা না থাকলে সাধারণ মানুষ সত্য জানতে পারবে না। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত। আজ এই স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। এর ফলে সমাজে ভীতি, আত্মকেন্দ্রিকতা আর মিথ্যার সংস্কৃতি বেড়ে যাচ্ছে।
সমাজের হৃদয়শূন্যতা বড্ড! আমাদের সমাজে শ্রদ্ধা, সহানুভূতি, সহনশীলতার অভাব দিন দিন বাড়ছে। ছাত্র শিক্ষককে মারছে, সন্তান বৃদ্ধ বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে দিচ্ছে, প্রতিবেশী বিপদে পড়লে সাহায্য করার মনোভাবও কমে গেছে। এই নৈতিক অবক্ষয় রোধে পরিবার, শিক্ষা, সংস্কৃতিÑ সবকিছুর মৌলিক পরিবর্তন দরকার। নৈতিক শিক্ষা থেকে শুরু করে সামাজিক দায়বদ্ধতা শেখানো এখন অত্যন্ত জরুরি। সমাজ যদি হৃদয়হীন হয়ে যায়, তাহলে তা কেবল মানুষের সম্পর্কেই নয়, রাষ্ট্রের উন্নয়নেও মারাত্মক প্রভাব ফেলবে।
সন্তানকে বিদেশে পাঠালেই গর্ব! আজকাল বাবা-মায়েরা গর্ব করে বলেন, ‘ছেলেটা আমেরিকা, কানাডা বা ইউরোপে চলে গেছে।’ মনে হয় যেন বিদেশে যাওয়া মানেই সাফল্যের শিখরে পৌঁছানো। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে দেশের প্রতি অনাস্থা। দেশে ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, চাকরির বাজারের দুর্নীতি, নিরাপত্তাহীনতা, ঘুষের রাজনীতি- সব মিলিয়ে অনেক পরিবারই সন্তানকে বিদেশে পাঠানোকে শ্রেষ্ঠ পথ মনে করে। দেশপ্রেম ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। অথচ সেরা মেধাগুলো যদি দেশেই থাকত, তবে বাংলাদেশ আরও অনেক দ্রুত উন্নতি করত।
তবু কিছু স্বপ্নবাজ মানুষ রয়ে যায়। সব অন্ধকারের মধ্যেও কিছু আলোর মানুষ রয়ে গেছে। দেশের প্রত্যন্ত গ্রামে কেউ এখনো বিনা বেতনে পড়ান, কেউ নিজের রক্ত দান করেন চুপচাপ, আবার কেউ একা দাঁড়িয়ে ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন। এরা স্বপ্ন ফেরিওয়ালা, যারা এই দেশের প্রকৃত উত্তরাধিকার বহন করেন। এদের কারণেই দেশ এখনো বেঁচে আছে। রাষ্ট্র যদি এদের মূল্যায়ন করত, তাহলে সমাজ আরও মানবিক হতো।
সম্ভাবনার নাম বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখনো স্বপ্ন দেখার দেশ। সঠিক পরিকল্পনা, ন্যায়নীতি, স্বচ্ছ নেতৃত্ব এবং নাগরিকদের সদিচ্ছা থাকলে দেশটা একদিন উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। আমাদের রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ, তরুণ শক্তি, কৃষি, শিল্পসহ নানা সম্ভাবনা। কিন্তু প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। নাগরিকদের দায়িত্বশীলতা বাড়াতে হবে এবং রাজনীতিকে দেশমুখী করতে হবে। যদি আমরা সবাই একসঙ্গে কাজ করি, তাহলে বাংলাদেশ এক আদর্শ রাষ্ট্র হয়ে উঠতে বাধ্য।
বাংলাদেশের সমস্যাগুলো যতই জটিল হোক, সমাধান অসম্ভব নয়। প্রয়োজন শুধু সঠিক নেতৃত্ব, নীতি এবং সক্রিয় নাগরিকচেতনা। পরিবর্তন তখনই সম্ভব হবে, যখন প্রতিটি মানুষ মনে করবে-দেশের উন্নয়ন মানেই তার নিজের উন্নয়ন। বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলতে হলে আমাদের ‘দল’ নয়, ‘দেশ’কে বড় করে দেখতে শিখতে হবে।
মীর আব্দুল আলীম: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।
আজকালের খবর/আরইউ