চায়ের দোকানের এক পাশে বসতেই আমি বললাম, কেমন আছেন ফরহাদ ভাই?ভালো নেইরে।
ফরহাদ ভাই ভালো নেই! কিন্তু কেন? চা খেতে বললে ফরহাদ ভাই বললো, তোরা খা। এখন চা খেতে ইচ্ছা করছে না।
ফরহাদ ভাইয়ের চা খেতে ইচ্ছা করে না-এরকম কেনো মুহূর্ত আমরা এর আগে পাইনি।
ফরহাদ ভাই পকেট থেকে এক প্যাকেট ওরস্যালাইন বের করলো। বললো, দুই গ্লাস পানি দে’ ওরস্যালাইন খাবো। ডায়রিয়া চলছে।
আমি বললাম-হঠাৎ ডায়রিয়া কেন?
ভয়ে।
ভয়ে!
ফেকু এগিয়ে গিয়ে ফরহাদ ভাইয়ের গা ঘেষে বসে বলল, সমস্যা কোনো?
হু।
কী সমস্যা? ভাবির সাথে ঝগড়া হয়েছে?
আরে না।
তাহলে।
অন্যরকম সমস্যা।
জটিল খুব?
বলা যায় জীবন-মরণ সমস্যা।
ফরহাদের ভাইয়ের জীবন-মরণ সমস্যা। গতকালও রাত ১০টা পর্যন্ত যে মানুষ তুমুল আড্ডা দিল, আজ তার জীবন-মরণ সমস্যা।
গাব্বু বলল-কী হয়েছে বলেন। আমরা তো আছি।
এখানে তোদের কিছু করার নেই।
দেখি না...। বলেন।
কাল রাত থেকে ফোনে একটা হুমকি পাচ্ছি।
হুমকি! কীরকম?
বলছে আমাকে খুন করে বিয়াল্লিশ ফিট মাটির নিচে পুতে রাখবে।
বিয়াল্লিশ ফিট! এতটা গভীরে পুতে রাখার কী দরকার? তিন/চার ফিটই তো যথেষ্ট। কিন্তু কেন আপনাকে খুন করতে চায়?
ফরহাদ ভাই চুপ করে রইলো। আমি বললাম, ফেসবুকে ধর্ম তেমন কিছু লিখেছেন নাকি? আপনি হয়তো উদারভাবেই সম্প্রীতির একটা কিছু লিখলেন। সেটাই ওদের খারাপ লেগে যাবে। ওরা প্রতিক্রিয়াশীল।
তোরা তো আমার ফেসবুকে এ্যাড আছিস। দেখেছিস সেরকম কোনো লেখা?
না, তা দেখিনি।
পল্টু বলল, জঙ্গিরা সাধারণত খুন করে বিয়াল্লিশ ফিট মাটির নিচে পুতে ফেলতে চায় না। ওদের হাতে ওতো টাইম নাই। ওরা চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে চলে যায়।
ঠিক তখন ফরহাদ ভাইয়ের ফোন বেজে উঠল। ফরহাদ ভাই ফোনের দিকে তাকিয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বলল, সেই নম্বর।
আমি বললাম, ফোন রিসিভ করেন। কেন তারা হুমকি দিচ্ছে স্পষ্ট করে সেটা জানতে চান।
ফরহাদ ভাই ফোন রিসিভ করল। আমরা ইশারায় স্পিকার অন করে কথা বলতে বললাম, যাতে আমরাও শুনতে পাই। ফরহাদ ভাই বলল, হ্যালো...।
তোরে বিয়াল্লিশ ফিট মাটির নিচে পুতে রাখতে চেয়েছিলাম। কথাটা ভুল ছিল। তোরে পয়তাল্লিশ ফিট মাটির নিচে পুতে রাখবো। সেটা জানানোর জন্যই ফোন করেছি।
ফেকু ফিসফিস করে বলল, এ দেখছি আজব লোক। কত ফিট মাটির নিচে পুতে রাখবে সেটাই তার বড় চিন্তা।
ফরহাদ ভাই বলল, আচ্ছা, আমার অপরাধটা ক্লিয়ারলি বলবেন? আমি আসলে কিছু বুঝতে পারছি না।
মনে হচ্ছে, তুই ভাজা মাছ উল্টায়া খাইতে পারোস না।
আমি ভাজা মাছ উল্টে খেতে পারি। কিন্তু আপনাদের বিষয়টা...প্লিজ...।
তুই আমার সুন্দরী বউ লায়লার পথ থেকে সরে যাবি।
লায়লা! লায়লা তো আমার স্ত্রী।
বান্দরের ঘরের বান্দর, লায়লা তোর স্ত্রী? কবে থেকে?
তিন মাস হল বিয়ে করেছি।
আমার চার বছর প্রেমের পর তিন বছর আগে বিয়ে করা বউরে তুই তিন মাস আগে বিয়া করছোস? হারামির ঘরের হারামি, তোরে আমি আটচল্লিশ ফিট মাটির নিচে পুতে রাখবো। আমার ইকোনোমিক্সে অনার্স-মাস্টার্স করা বউ। ওর লেখাপড়ার সব খরচ আমি দিয়েছি।
আপনি লায়লার লেখাপড়ার খরচ দিয়েছেন?
তায়লে কী? প্রেম শুরু হওয়ার পর লায়লা আর ওর বাপের কাছ থেকে এক পয়সাও আনে নাই। সব আমার।
আপনার কথার কোনো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি না।
খুন করে মাটির নিচের দেয়ার পর সবই পাবি।
ফোন রেখে ফরহাদ ভাই মাথা চেপে বসে রইল।
আমরাও হতভম্ব। লায়লা ভাবীর মতো এত সুন্দর, এত ভালো একটা মেয়ের অতীত জীবনে এরকম কিছু থাকতে পারে আমরা তা ভাবতে পারছিলাম না। চায়ের দোকানদার মোশারফ বলল, নারী ঘটিত ব্যাপার। পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল ব্যাপার। পৃথিবীতে অনেক বড় বড় যুদ্ধ হয়েছে সুন্দরী নারীকে কেন্দ্র করে।
ফেকু বলল, ভাবী তো ইকোনোমিক্স এ অনার্স, মাস্টার্স। তার অতীত কিছু লুকানো হয়তো...।
ফরহাদ ভাই বলল, না না, ওর জীবনে এরকম কিছু থাকতে পারে না।
আচ্ছা, আপনি তাকে আবার ফোন করেন। সেই লায়লার বাবা-মায়ের নাম, ঠিকানা এসব জানতে চান। আপনাকে কতটুকু চেনে তাও জানতে চান। অনেক সময় নামে নামে জমে টানে।
ফেকুর প্রস্তাবটা আমার কাছে ভাল লাগল। ফেকু হলো আমাদের সবার মধ্যে বুদ্ধিমান। যে কোনো সমস্যায় মাথা ঠাণ্ডা রেখে ভাবতে পারে।
ফরহাদ ভাই বলল, ফোন করলেই সে কি আমাকে কিছু খুলে বলবে? ফোন ধরেই তো গালাগাল শুরু করে দেয়।
বুঝিয়ে বলুন। কিছুটা যখন বলেছে...।
ফরহাদ ভাই ফোন করল। ওপার থেকে বলল, তোর সাহস তো কম না। তুই আমারে ফোন করছোস!
আচ্ছা, আপনার স্ত্রী লায়লার বাবার নামটা কী?
তুই জানোস না? ভড়ং করোস?
প্লিজ...।
মোজাফ্ফর হোসেনরে তুই চিনোস না?
লায়লার মায়ের নাম?
বিলকিস বেগম।
লায়লার বাড়ি কোথায়?
বরিশাল। বরিশল ব্রজমোহন কলেজে লায়লা পড়েছে। আর কী শুনতে চাস নোয়াখাইল্ল্যা ফরহাইদ্যা?
আর কিছু শুনতে চাই না।
ফরহাদ ভাই ফোন কেটে দিল। বলল, সব তো জানলাম। এতে লাভ কী হলো?
আমি বললাম, এবার ফূর্তি করেন।
ফূর্তি করবো মানে?
লোকটার স্ত্রী লায়লা বরিশালের মেয়ে। আর আমাদের লায়লা ভাবি ঢাকার মেয়ে। তার শ্বশুরের নাম মোজাফ্ফর হোসেন, আপনার শ্বশুরের নাম শফিকুর রহমান। তার শাশুড়ির নাম বিলকিস বেগম, আপনার শাশুড়ির নাম কী?
রেহেনা বেগম।
আচ্ছা, ইকোনোমিক্স ঠিক আছে। সেই লায়লা লেখাপড়া করেছে ব্রজমোহন কলেজে, আর আমাদের লায়লা ভাবি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। লোকটা নোয়াখাইল্ল্যা ফরহাইদ্যারে থ্রেট করতেছে। আপনি তো খুলনার পোলা। ঢাকায় সেটল।
তাইতো! ব্যাপারটা ধরতেই পারি নাই।
আমরা খুব হাসাহাসি করতে লাগলাম। মোশারফ ফরহাদ ভাইয়ের দিকে এক মগ চা এগিয়ে দিয়ে বলল, চা খান। টেনশনের কিছু নাই। এই ঝামেলা শ্যাষ।
ফরহাদ ভাই চা খাচ্ছে। তখন সেই নাম্বার থেকে ফোন। ফরহাদ ভাই হাসতে হাসতে ফোন রিসিভ করল। ওপার থেকে বলল, ভাই, আমি দুঃখিত, খুবই দুঃখিত। একটা ডিজিট ভুল হওয়ায় ফোনটা আপনার কাছে চলে গেছে। আপনার নাম ফরহাদ, আপনার স্ত্রীর নাম লায়লা ঝামেলাটা এখানে হয়েছে। আমি সেই নোয়াখাইল্ল্যা ফরহাদরে পাইছি। আপনে মনে কিছু করবেন না ভাই। মাথা ঠিক নাই। বিয়া করা সুন্দরী স্ত্রীর পথে যদি...।
ফরহাদ ভাই বলল, আমি বুঝতে পেরেছি আপনার মনের অবস্থা। আমি কিছু মনে করিনি। আমার খুব হাসি পাচ্ছে।
হাসি আমারও পাচ্ছে। কিন্তু আমি হাসবো না। ওই নোয়াখাইল্যারে খুন করে পঁয়তাল্লিশ ফিট মাটির নিচে পুতে রাখবো, তারপর হাসবো।
আমি আপনাকে একটা সুপরামর্শ দিতে চাই।
দেন ভাই। আপনে একজন ভালো মানুষ। আপনার সুপরামর্শ আমি শুনতে চাই।
খুন-খারাবি কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে না। উপরোন্ত আপনি ঝামেলায় জড়িয়ে যাবেন। আপনার সুন্দরী স্ত্রীর জীবনটাও নষ্ট হবে। আইনগতভাবে সমস্যার সমাধান করুন।
আপনার পরামর্শ আমার ভালো লেগেছে। দেখি কী করা যায়। ভাই, আপনে মনে কিছু...।
বললাম তো আমি কিছু মনে করিনি।
আজকালের খবর/আরইউ