সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার শুধু রাষ্ট্রের নীতি নয়, বরং একটি সুস্থ, কল্যাণকর ও টেকসই সমাজ গঠনের অপরিহার্য ভিত্তি। এই তিনটি নীতি নিশ্চিত হলে সমাজে শান্তি, নৈতিকতা ও সুবিচার প্রতিষ্ঠিত হয়। সাম্য নিশ্চিত করার মাধ্যমে সমাজে দারিদ্র্য দূর করা, বৈষম্যহীন জীবনযাত্রা নিশ্চিত করা এবং সকল নাগরিকের জন্য উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব। সাম্য প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হচ্ছে- নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক সুযোগ বৃদ্ধি-সবার জন্য সমান রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ বৃদ্ধি-দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য মানসম্মত শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। নারী ও শিশু সুরক্ষা-নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু অধিকার সংরক্ষণ ও বাল্যবিবাহ রোধ করা। এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন-আদিবাসী, প্রতিবন্ধী ও সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য বিশেষ সুবিধা প্রদান। চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের দীর্ঘদিনের চর্চিত মননপটে নিঃসন্দেহে কিছু পরিবর্তন এনে দিয়েছে। গত এক বছরে অনেক ঘটনাই আমাদের বারবার হতাশার দিকে ঠেললেও কখনো কখনো আশাও জিইয়ে রাখতে হয়। ৫ আগস্ট বহুল প্রতীক্ষিত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’ ঘোষিত হলো। যতটা আশা নিয়ে সবার দৃষ্টি এ ঘোষণাপত্রের দিকে ছিল, সেই আশা-আকাক্সক্ষার পরিসমাপ্তিও ঘটেছে অনেকের আশা-নিরাশার দোলাচলের মধ্য দিয়ে।
যাহোক, ঘোষণাপত্রে কী পেলাম, সেদিকে না গিয়ে গত এক বছরে আমাদের আকাক্সক্ষার জায়গাগুলো খতিয়ে দেখলে বুঝ যায়, কোটা সংস্কারের দাবি থেকেই জুলাই আন্দোলনের সূত্রপাত। খুবই সাধারণ কয়েকটি দাবি কোটার পরিমাণ কমিয়ে মেধার মূল্যায়ন করা, সবার জন্য অভিন্ন বয়ঃসীমা নির্ধারণ, সরকারি চাকরিতে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা, দেশের অনগ্রসর জনগোষ্ঠী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য ন্যায্যতার ভিত্তিতে কোটা সংরক্ষণ রাখা। অর্থাৎ দেশের নাগরিকদের সাম্যের ভিত্তিতে সুযোগ দেওয়া।
জুলাই আন্দোলনের ফলে দেশের পুরো প্রেক্ষাপটই পাল্টে গেছে। পনের বছর ধরে আদিবাসী দিবস পালনে সরকারের বাধা, সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করে ‘আদিবাসী’ শব্দ নিষিদ্ধ করা, মিডিয়ায় আদিবাসী শব্দ ব্যবহার না করার ওপর চাপ ছিল। এই বছর অন্তত সেই ‘চাপ’ এখন পর্যন্ত অনুভূত হচ্ছে না। দেশের সব জনগোষ্ঠী নিয়ে নতুন সংবিধান তৈরি ও তাদের সাংবিধানিক স্বীকৃতির সংকট দূর করার কথা বলছে বর্তমান তরুণ প্রজন্ম। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক এবং জুলাই চেতনার প্রতিফলন। তাদের এই অঙ্গীকারকে সাধুবাদ জানাই। কিন্তু প্রশ্ন হলো জুম পাহাড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে বিদ্যুৎই এখনো পৌঁছায়নি, সেখানে কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চর্চা হবে! একজন জুমিয়া কৃষকের যেখানে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, তার কাছে গিয়ে আপনি যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তার অধিকার ও ভবিষ্যৎ গঠনের কথা বলবেন, তখনকার পরিবেশটার কথা একবার ভাবুন তো! দেশে ‘বাটন মোবাইল’ ব্যবহারের প্রচলন প্রায় উঠে গেছে। অথচ মিটমিট করে পাওয়া মোবাইল নেটওয়ার্কে প্রত্যন্ত পাহাড়ের মানুষ সেই বাটন ফোন দিয়ে যোগাযোগের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কাজেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার চেয়ে বাস্তবতার দিকেই আমাদের মনোযোগ দিতে হবে বেশি। পাহাড়ে প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সরবরাহ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের জন্য সরকারকে আরও অধিক যত্নশীল হতে হবে। অতিবৃষ্টি, খরার সময় পাহাড়ে যে নীরব দুর্ভিক্ষ চলে, সেসব উপদ্রুত এলাকার মানুষদের মৌলিক চাহিদা পূরণে যথাযথ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। শুধু তাই নয়, যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ গড়ে দিতে হবে। দেশে নির্বাচনের মৃদু বাতাস বইতে শুরু করেছে। আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণে ইচ্ছুক সব দলের প্রতি আমাদের আহ্বান থাকবে-তাদের দলীয় নির্বাচনী ইশতেহারে বৈষম্যহীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অঙ্গীকারবিষয়ক সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকতে হবে।
কারণ, জনগণের রায়ে নির্বাচিত হয়ে তারাই আগামীর বাংলাদেশ কীভাবে পরিচালিত হবে, সেটি নির্ধারণ করবেন। তাই জনগণের সামনে তাদের নিজ নিজ দলের ভাবনাগুলো নির্বাচনী ইশতেহারের মাধ্যমে তুলে ধরুক। পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সবার আগে রাজনৈতিক দলগুলোকে সেখানকার মানুষদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। আমরা বিশ্বাস করি, যারা দেশ পরিচালনার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করছেন, তারা আওয়ামী দুঃশাসনের নেতিবাচক দিকগুলোকে স্মরণে রেখে ভবিষ্যতে পাহাড়ে কীভাবে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব, সে বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে ভাববেন। পাহাড়কে অশান্ত রেখে দেশের টেকসই উন্নয়নের গতি বাড়ানো কোনোভাবে সম্ভব নয়। দেশের একাংশের পুরোনো ক্ষত মলম দিয়ে ঢেকে রেখে মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে আর যা-ই হোক রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে না। সরকারের উচ্চ পদে আসীন ব্যক্তিরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ডাম্পিং জোন হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। সমতল অঞ্চলের কোনো কর্মকর্তা দুর্নীতি বা নৈতিকতাহীনতায় জড়িয়ে পড়লে তাঁকে শাস্তিমূলক হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বদলি করা হয়। তারা বোধ হয় ভুলে যান, পার্বত্য চট্টগ্রাম বাংলাদেশেরই অখণ্ডিত ভূখণ্ড।এ ধরনের বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের এটা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে পার্বত্য চট্টগ্রাম সমতলের দুর্নীতিবাজ, নীতিভ্রষ্ট ও চরিত্রহীন কর্মকর্তাদের স্বর্গরাজ্য নয়। অপরাধীকে তার অপরাধের জন্য আইনের আওতায় এনে বিচার করা হোক। বাংলাদেশ একটি বহু জাতি ও বহু সংস্কৃতির দেশ। তাই সব সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে এ দেশের বহুত্ববাদকে গ্রহণ করতে হবে। চব্বিশের জুলাইয়ের পর সংবিধান সংস্কারসহ রাষ্ট্র সংস্কারের কথা বারবার বলা হচ্ছে। সংবিধানে দেশের সব জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গড়তে হবে।
জুলাই অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাওয়া নতুন এই বাংলাদেশে বৈষম্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে স্বপ্ন তরুণ প্রজন্ম দেখছে, সেই স্বপ্নের বীজ যেন কোনোভাবেই বিনষ্ট না হয়, সে জন্য সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বিশ্বের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ, যেখানে নারীরা বিশেষভাবে বেশি প্রভাবিত হয়। উপকূলীয় ও নদীভাঙনপ্রবণ অঞ্চলে বসবাসকারী নারীর বাসস্থান হারানো, জীবিকা সংকট এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবারের জন্য খাদ্য, পানি ও জ্বালানির সংস্থান করতে গিয়ে নারীরা অতিরিক্ত চাপের মুখোমুখি হয়। তবে, নারীরা এই সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। স্থানীয় পর্যায়ে তারা কৃষি, মাছ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব জীবিকা গড়ে তুলছে। কিন্তু তাদের এই অবদান নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে পর্যাপ্ত স্বীকৃতি পাচ্ছে না। জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় নারীকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণভাবে অন্তর্ভুক্ত করা এবং তাদের জন্য বিশেষ সহায়তা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা অপরিহার্য। নারী নেতৃত্বাধীন জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্পগুলোর সম্প্রসারণ প্রয়োজন, যাতে তারা এই সংকট মোকাবিলায় আরও সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন-সংক্রান্ত নীতিমালায় সমতা ও ন্যায্যতাভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এ ছাড়া, জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো গড়ে তোলা, নারীর জন্য বিশেষ বরাদ্দ নিশ্চিত করা এবং অভিযোজন কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ বাড়ানো প্রয়োজন। নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সম্পূর্ণভাবে সম্পৃক্ত করা গেলে তা কেবল তাদের ক্ষমতায়নই নয়, জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় সামগ্রিক সাফল্যও নিশ্চিত করবে। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে ন্যায্যতা ও সমতাভিত্তিক বাজেটিং অপরিহার্য।
২০২৪ সালে বাংলাদেশে গণঅভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় নারীরা আন্দোলন, নীতিগত আলোচনা এবং তৃণমূল পর্যায়ে সংগঠিত হওয়ার মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। তারা সহিংসতা ও হুমকির মুখেও গণতন্ত্র, স্বচ্ছতা এবং মানবাধিকারের জন্য লড়াই করেছে। জুলাই-আগস্ট ২০২৪-এ একটি স্বৈরাচারী সরকার অপসারিত হওয়ার পর নারীদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশগ্রহণের সুযোগ বেড়ে গেছে। তবে নারীর স্বাধীন চলাফেরা ও জনপরিসরে অবস্থান এখনও হুমকির সম্মুখীন। রাজনৈতিক নেতৃত্বে নারীকে গ্রহণ করার মানসিকতা এখনও সমাজে অনুপস্থিত। নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ সুগম করা এখনও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখা দিচ্ছে। আমরা এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে জাতির প্রতিটি নাগরিকের সমান অধিকার থাকবে। যেখানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কেবল ইতিহাস নয় বরং জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বাস্তবতায় প্রতিফলিত হবে। নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে অনুপ্রাণিত করতে হবে, যেন তারা দেশকে আরও উন্নত এবং মানবিক করে গড়ে তোলে। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ ছিল মানবিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য। কিন্তু আজকের বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক বৈষম্য, আর দুর্নীতি আমাদের অগ্রগতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৪ সালের গণআন্দোলন এবং স্বৈরশাসনের পতনের পর, জাতি নতুন করে আশার বাতিঘর খুঁজে পেয়েছে। ১৯৭১ সালের সেই বিজয়ের আলো আবারও আমাদের পথ দেখাচ্ছে। এই নতুন আলো আমাদের ঐক্যবদ্ধ করছে, আমাদের শক্তি এবং সাহস দিচ্ছে একটি উন্নত, দুর্নীতিমুক্ত এবং ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য। বিজয়ের এই চেতনায় আমরা শপথ নিতে পারি, আমরা একটি সুন্দর, মানবিক এবং সাম্যের বাংলাদেশ গড়ব। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি কল্যাণমুখী সমাজ গঠন করা সম্ভব। রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই নীতিগুলো বাস্তবায়ন করলে একটি সমৃদ্ধ, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক বিশ্ব প্রতিষ্ঠিত হবে।
রায়হান আহমেদ তপাদার : গবেষক ও কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ