এ মুহূর্তে সুষ্ঠু নির্বাচন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
আনু মুহাম্মদ
প্রকাশ: শনিবার, ৯ আগস্ট, ২০২৫, ৪:৫৬ পিএম
৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি দিন। গত বছর ছাত্র-জনতার মাসাধিককাল চলা সরকারবিরোধী আন্দোলনের সফল পরিণতি ঘটে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের একটানা শাসনের সমাপ্তির মধ্য দিয়ে। গত বছরের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছিল বিস্ময়কর এবং নবচেতনায় উদ্দীপ্ত। ছাত্ররা সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান কোটা সুবিধা সংস্কারের দাবিতে প্রাথমিকভাবে আন্দোলন শুরু করে। পর্যায়ক্রমে সেই আন্দোলন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। পরবর্তীকালে সরকারের অসহিষ্ণু আচরণ ও নির্মম নির্যাতনের কারণে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন বেগবান হয় এবং একপর্যায়ে তা সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলনে পরিণত হয়। সরকার যদি শিক্ষার্থীদের আলোচনায় ডেকে তাদের যৌক্তিক দাবি মেনে নিত, তাহলে হয়তো শিক্ষার্থীদের আন্দোলন এতটা তীব্র আকার ধারণ করত না। সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে শিক্ষার্থীদের দাবি উপেক্ষা করা হয়। ফলে একপর্যায়ে তারা সরকার পতনের একদফা আন্দোলন গড়ে তোলে।

আমাদের দেশে সাধারণত রাজনৈতিক দলগুলোই সরকার পতনের আন্দোলন করে। কিন্তু গত বছর জুলাই-আগস্টে সরকার পতনের যে আন্দোলন হয়েছিল, তার সূচনা হয়েছিল ছাত্রদের মাধ্যমেই। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো সেই আন্দোলনে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়। সরকার আন্দোলন দমনের নামে যতই নির্যাতন চালাতে শুরু করে, আন্দোলন ততই বেগবান হয়। একপর্যায়ে সরকারের পতন ঘটে। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগে বাধ্য হন। গত বছরের শিক্ষার্থী আন্দোলনের একটি বৈশিষ্ট্য ছিল এতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করে। এমনকি কলেজের শিক্ষার্থীরাও আন্দোলনে যুক্তি হয়েছিল।

প্রতিবার গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তিত হলে একধরনের প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়। মানুষ মনে করে, তাদের সমস্যা সম্ভবত এবার নিরসন হবে। গত বছরের আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের নির্মম শাসনের অবসান হলে সব শ্রেণির মানুষের মনে উচ্চ প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়; কিন্তু সেই প্রত্যাশা ইতোমধ্যেই ফিকে হতে শুরু করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার মানুষের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। কোনো ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। প্রতিবার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকার পতন হলে কয়েকদিন আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটলেও অতি দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। কিন্তু এবার এর ব্যত্যয় লক্ষ করা যাচ্ছে। দেশব্যাপী সন্ত্রাস-নৈরাজ্য চলছে। বিশেষ করে মব সন্ত্রাস অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে। সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে অপারেশন ডেভিল হান্ট পরিচালনা করা হয়েছে। কিন্তু এরপরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না। মানুষ ঘর থেকে বের হতে সাহস পাচ্ছে না।

দেশের মানুষের মাঝে বিভাজন ও বৈষম্য সৃষ্টির কারণে শেখ হাসিনার পতন হয়েছে। কিন্তু আমরা কি এখন বিভাজনের রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছি? রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে যে দৃঢ় ঐক্য গড়ে উঠেছিল, তা শিথিল হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে, দেশ আবারও আগের মতো নৈরাজ্যজনক অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে জীবনবাজি রেখে মাঠে নেমেছিল। এমন বিজয় আমরা অতীতেও বারবার দেখেছি। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার কারণে বারবার বিজয় ব্যর্থ হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেভাবে বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে, তার কারণে জুলাই বিপ্লবের উদ্দেশ্যও ব্যর্থ হতে পারে।

অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন অসংগতি নিয়ে কথা বললেই বলা হয় সবকিছু রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। আমরাও জানি সবকিছু রাতারাতি পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা পরিবর্তনের সূচনা দেখতে চাই। কিন্তু সবকিছু আগের মতোই গতানুগতিক ধারায় চলছে। পাহাড় ও সমতলের মানুষ সমানভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। কারও নিরাপত্তা নেই। চব্বিশের আন্দোলন হয়েছিল কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূরীকরণের জন্য; কিন্তু এ সরকারের আমলে কোনো ক্ষেত্রেই বৈষম্য দূর হচ্ছে না। ছাত্র-জনতা শুধু এক সরকারের পরিবর্তে আরেক সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য আন্দোলন করেনি। রাজনৈতিক দলগুলো এখনো সংস্কার প্রশ্নে একমত হতে পারেনি। সরকার মব সন্ত্রাস দমন করতে পারছে না। সরকারের কোনো কোনো কর্তাব্যক্তি মব সন্ত্রাসের পক্ষে সাফাই গাইছেন।

আমাদের দেশে দেখা যায়, যারা বিভিন্ন সময় আন্দোলনে গিয়ে প্রাণ হারায়, তাদের পরিববার পরবর্তীকালে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। এবারও এর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। যারা জুলাই আন্দোলনে শহীদ হয়েছেন, তাদের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। যারা আহত হয়েছেন, তাদের সুচিকিৎসা দিতে হবে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী এবং যেসব পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন, তাদের নিহত হওয়ার প্রেক্ষাপটসহ আহত ও নিহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করতে হবে।

বাংলাদেশের মানুষের অতীতের সব লড়াইকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে সবার উপরে রাখতে হবে। যারা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ছোট করে দেখাতে চায়, তারা গণ-অভ্যুত্থানের প্রতিপক্ষ শক্তি। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগের সম্পত্তি নয়। তাদের কবল থেকে মুক্তিযুদ্ধকে উদ্ধার করে জনগণের মালিকানায় নিয়ে আসতে হবে।

চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানকেও নতুন ধরনের চাঁদাবাজ, দখলদার, সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তি অপব্যবহার করা শুরু করেছে। তাদের কাছ থেকেও এ অভ্যুত্থানকে জনগণের মালিকানায় নিয়ে আসতে হবে। এ অভ্যুত্থানের কোনো নির্দিষ্ট বা একক মালিক নেই। গণ-অভ্যুত্থানের মালিক হচ্ছে জনগণ।

দ্রোহযাত্রা থেকে চলমান আটক ও গ্রেফতার-বাণিজ্য, চাঁদাবাজি, মব সন্ত্রাস, পাইকারি মামলা বন্ধের দাবি জানাই। বাংলাদেশে সব শহীদ ও আহতদের পূর্ণ দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে এবং জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচার যথাযথভাবে করতে হবে।

বৈষম্যহীন সমাজের জন্য চারটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে। এগুলো হলো-শ্রেণিবৈষম্য সৃষ্টিকারী অর্থনৈতিক নীতির পরিবর্তন করতে হবে; ধর্মীয় বৈষম্যের কোনো রীতিনীতি বা ব্যবস্থা রাষ্ট্রের থাকা যাবে না; জাতিগত বৈষম্য নিরসনে বাঙালি ছাড়াও অন্যান্য জাতিরও স্বীকৃতি থাকতে হবে এবং লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে হবে। গণতান্ত্রিক রূপান্তরের মধ্যে জনগণের সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োজিত না হলে এ দেশে বারবার স্বৈরতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের আবির্ভাব ঘটবে।

বিগত সরকার আমলের সাড়ে ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতিকে লুটপাটের মাধ্যমে বিপর্যস্ত করে ফেলা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্যোগে গঠিত শ্বেতপত্র কমিটি তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৮ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তা জনগণকে জানানো প্রয়োজন। যারা ব্যাংক লুট করেছে, শেয়ারবাজার ধ্বংস করেছে, তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনতে হবে। সাম্প্রতিক সময়ে মামলা বাণিজ্য শুরু হয়েছে। যারা বিভিন্ন ধরনের সুনির্দিষ্ট অপরাধ করেছে, তাদের আইনের আওতায় আনা যেতে পারে। কিন্তু ঢালাওভাবে মামলা করা হলে মামলার গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক আলোচনায় বাংলাদেশ সফল হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতির অন্যান্য খাতে অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য উল্লেখ করার মতো নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন মুদ্রানীতিতে পলিসি রেট ১০ শতাংশে অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এটা করা হয়েছে মূলত উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য। বিগত সরকারের তুলনায় মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানোর নামে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বেশি হলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ বিঘ্নিত হবে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার এখন অত্যন্ত নিুপর্যায়ে রয়েছে। ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বৃদ্ধি না পেলে আগামী দিনে অর্থনীতিতে স্থবিরতা নেমে আসতে পারে। চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি প্রত্যাশার চেয়ে অনেকটাই কম হবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ মুহূর্তে জিডিপি প্রবৃদ্ধির চেয়ে বিনিয়োগ ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনীতিকদের মধ্যে বিভেদ লক্ষ করা যাচ্ছে। একটি জাতি বিভক্ত হয়ে পড়লে তা কোনোভাবেই সুফল দেবে না। এ মুহূর্তে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি এবং চলামান প্রক্রিয়া। তাই সংস্কারের নামে সবকিছু বন্ধ করে বসে থাকা উচিত হবে না। অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের সূচনা করতে পারে; নির্বাচিত সরকার এসে সংস্কার সম্পন্ন করবে। নির্ধারিত সময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের দায়িত্ব শেষ করতে পারে। বিগত সরকার আমলে ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে দেশের মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। আগামী দিনে তারা যেন সঠিকভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে, এর ব্যবস্থা করতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, সুযোগ বারবার আসে না। জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে রাষ্ট্র সংস্কারের যে সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, একে কাজে লাগাতে হবে। 

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।  

আজকালের খবর/আরইউ








http://ajkalerkhobor.net/ad/1751440178.gif
সর্বশেষ সংবাদ
রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়ালো ৩০.২৫ বিলিয়ন ডলারে
প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরে ৫ সমঝোতার সম্ভাবনা
ইসির প্রাথমিক বাছাইয়ে উত্তীর্ণ এনসিপিসহ ১৬ দল
ভিত্তিহীন সংবাদে ক্ষুব্ধ এফপিএবি ও জিসিসি প্রকল্প কর্মকর্তাদের প্রতিবাদ
ভারতে একের পর এক স্থগিত বিদেশি অর্ডার, চলে যাচ্ছে বাংলাদেশ-পাকিস্তানে
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
আজ খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে ইসি
ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তায় পুলিশের জন্য আসছে ৪০ হাজার বডি ক্যামেরা
প্রধান উপদেষ্টার মালয়েশিয়া সফরে গুরুত্ব পাবে শ্রমবাজার
ডিএমপির সাবেক কমিশনারসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা
এইচএসসির ‘মিস করা’ পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন না সেই আনিসা
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft