
২০২৪ সালের জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা বাতিল নিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন যখন তুঙ্গে করছে, তখন আন্দোলনের পক্ষে একাত্মতা প্রকাশ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব হন দেশের প্রখ্যাত অভিনেতা, প্রযোজক এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা সোহেল রানা (মাসুদ পারভেজ)। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই ছাত্রনেতা শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকারের কণ্ঠে নিজেকে মেলে ধরেন অকুণ্ঠচিত্তে। শিল্পীদের মধ্যে যখন এ নিয়ে বিভাজনের দেয়াল ঠিক তখনই তিনি অবস্থান জাতিকে জানিয়ে দেন স্বৈরাচার শেখ হাসিনার চোখে চোখ রেখে। প্রথম শিল্পী হিসেবে তার এই ঘোষণা গত বছরের ১০ জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ পায়। সুবিধাভোগী, গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানো ক্ষমতার মসনদের পাচাটা কতিপয় শিল্পীর বিপরীতে তার এই সমর্থন রীতিমতো আলোড়ন তোলে। মুহূর্তে গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার্থীরাও দুর্বার শক্তিতে এগিয়ে চলে। সে আন্দোলনে সরকারের পতন হয়ে এসেছে নতুন সরকার। কার্যত বছরপূর্তিতে অনেকের অবদান নিয়ে যখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ তখনই অতসী কাচের নিচে ধরা পড়ে এক যোদ্ধার অবহেলার গল্প। তিনি শিল্পীদের মধ্যে প্রথম কিংবদন্তি শিল্পী সোহেল রানা। যাকে স্মরণ করে এক বছরেও জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বস্থানীয়রা একটি ফোন করেননি।
যদিও এ নিয়ে ভাবছেন না এই অভিনেতা। কণ্ঠে কিছুটা সাবধানতার স্বর, জানিয়ে দিলেন এক বছরে তার বিশ্লেষণ। বলেন- জীবনে অনেক পেয়েছি, অনেক দেখেছি। শিখেছিও কম না, এখনও ভুল হয়, আমি সে ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার চেষ্টা করি। আমার মনে হয় এমনটা সবার করা উচিৎ। অতীত সরকারের পতন যে শিক্ষার্থীদের হাতে হলো তারা যদি সেটাকে অধিকার ভেবে যাচ্ছেতাই করে বসেন তবে সর্বনাশ। কারণ জনতার কাছে জবাবদিহির অপর নাম হচ্ছে অধিকার। এক বছরে সর্বত্রই এই প্র্যাকটিসের অভাব দেখতে পাচ্ছি, এ অবস্থার উত্তরণ জরুরি।
সোহেল রানা বলেন, অনেকগুলো প্রাণ ত্যাগের মাধ্যমে যে পরিবর্তন এসেছে সেটা ঠিকঠাক ধরে এগিয়ে চলতে হবে। যারা ভুল করবে জনগণ তাদের ছুঁড়ে ফেলতে সময় নেবে না। তাই নিজেদের সঠিক প্রমাণ করতে হবে, সময় লাগবে কিন্তু করতে হবে।
প্রসঙ্গত, কোটা প্রথা বাতিলে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন নিয়ে গত বছরের ১০ জুলাই তিনি সামাজিক যোগাযোদ মাধ্যমে একটি পোস্ট দেন। সেখানে তিনি লিখেছেন- ‘সর্বস্তরে এ কোটা সিস্টেম বাতিল করা হোক’। অপর এক পোস্টে বরেণ্য এই অভিনেতা লিখেন- ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাম বারবার বলা হচ্ছে কেন, দেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৩ বছর। তার সঙ্গে যদি আরও ১২ বছর যোগ করা হয়, তাহলে তার বয়স হয় ৬৫। এ বয়সে তো নিশ্চয়ই কেউ চাকরির জন্য চেষ্টা করে না বা স্কুল-কলেজে ভর্তি হয় না। তাদের সন্তানদের বাবার কারণে কোটা সিস্টেমে চাকরি এবং ভর্তি হতে হবে এটা মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করার শামিল। নিজ ম্যারিটের গুণে তারা ভর্তি হবে, পরীক্ষা দেবে এবং চাকরিতেও ইন্টারভিউ দেবে। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা কখনো এ ধরনের সুযোগ চাইনি। সম্মান যখন নেই, তখন এ ধরনের সুযোগ দিয়ে তার সন্তানদেরও সম্মান দেখানো একটা অপচেষ্টা মাত্র। সম্মানি দেওয়া ছাড়া তাদের জন্য আপনারা কি করেছেন মুখে, মুখে? তাদের জন্য মায়াকান্না করেছেন, ড্রেস থেকে শুরু করে চিকিৎসা বা চলাফেরা কোনো কিছুতেই কোনো সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাই আমরা কখনোই কিছু চাইনি। জাতির পিতার নির্দেশে দেশ স্বাধীন করা দরকার ছিল, আমরা সেটাই করেছি। সর্বস্তরে এ কোটা সিস্টেম বাতিল করা হোক এটা দেশের সবার দাবি।’
আরেক পোস্টে তিনি লেখেন, ‘চাষাবাদ করলেও একটি সিআইপি কার্ড পাওয়া যায়। দেশের জন্য যুদ্ধ করে মুক্তিযোদ্ধাদেরও একটি কার্ড দেওয়া হয়। কিন্তু তা কোনো জায়গায় ব্যবহার করার জন্য কাজে আসে না। ভিআইপি বা সিআইপি তো নয়ই। আমরাই নাকি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান!’ এ অভিনেতা আরও লেখেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা সম্মান পেয়েছে, সম্মানি পেয়েছে। ৩০ লাখ শহিদকে আমরা কী দিয়েছি, উত্তর দিয়ে তারপর চিৎকার করুন। আমাদের কথা একটাই, দেশের জন্য দশের জন্য কোটা সিস্টেম বাতিল, সম্পূর্ণ বাতিল।’
আজকালের খবর/আতে