শীত কালটা এ অঞ্চলের সবার জন্যই বেশ আনন্দের। হেমন্তে নতুন ফসল ওঠে ঘরে। সবার ঘরেই কম-বেশি নতুন ধানের চাল থাকে। পুকুর-ডোবা-নালায় মাছ থাকে। আলান-পালানে সবজি-তরিতরকারিও থাকে। সেই সাথে থাকে খেজুরের রস আর গুড়। পেট ভরে সবজি বা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাওয়ার পাশাপাশি চলে পিঠা-পায়েশ খাওয়ার ধুম। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাস থেকেই অনেকের ঘরে শুরু হবে খাদ্যেও অভাব। সে অভাব চলবে পরের হেমন্তে নতুন ধান না ওঠা পর্যন্তÍ। তবে তা নিয়ে মাথা ঘামায় না কেউ। কী হবে ভেবে? এভাবেই যে চলছে সুদীর্ঘ কাল ধরে।
এ অঞ্চলে যারা ধনী এবং যাদের পাখি মারার বন্দুক আছে, শীত মৌসুমটা তাদের জন্য আনে বাড়তি আনন্দ। যাদের পাখি মারার বন্দুক নেই, কিন্তু মানুষ মারার লাইসেন্সকৃত বন্দুক আছে, তারা সেটি দিয়েই কাজ চালিয়ে নেয়। হাওর-বাওড়ের অঞ্চল। সুদূর সাইবেরিয়া থেকে জীবন বাঁচানোর তাগিদে ওড়ে আসে পরিযায়ী পাখি। আমরা আদোর করে ডাকি অতিথি পাখি। ধনীদের বিকালটা কাটে অতিথিদের শিকারের উত্তেজনায়। সন্ধ্যায় তাদের বাড়ির উঠোনে আহত পাখির ক্রন্দন ও পাখা ঝাপটানি তাদের বউ-ঝিদের আনন্দও বাড়িয়ে দেয়।
রাতে খাবার টেবিলে হাঁসের রোস্ট, ঝাল ফ্রাই। বাড়ির কর্তা ড্রামস্টিক চিবোতে চিবোতে নিজের নিশানার তারিফ করতে থাকে স্ত্রী-পুত্র-কন্যার কাছে। শ্রোতামন্ডলি সে তারিফ শুনে পুলকিত হয়। স্বামী, বাবা, চাচাদের যোগ্যতা-দক্ষতা শুনে গর্বিত হয়।
এ তল্লাটের সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাধর পরিবার হল খান পরিবার। খান পরিবারের প্রধানের নাম লুৎফর রহমান খান। বাঙলো ধরনের বিশাল তাদের বাড়ি। ফটকে তামার পাতে খোদাই করে লেখা-খান ভিলা। বৈঠক খানার সামনে ফুলের বাগান। প্রাচীরের বাইরে আম, নারিকেল আর সুপারির বাগান। তার সামনেই পুকুর। লোকে বলে, খান বাড়ির তালাব। অনুমতি ছাড়া সেই পুকুরে কেউ পা ভেজাতে সাহস পায় না। পুকুর ভরে থাকে রুই-কাতলা-কালবাউস-চিতল আরো অনেক ধরনের মাছে। দিন-রাত তাদের টালা পাড়ার শব্দ। ছুটির দিনে খান সাহেবের ছেলেরা পুকুরে খ্যাপলা জাল ফেলে মাছ ধরে। জাল বেশি বার ফেলতে হয় না। একবার কি দুইবার ফেললেই তিন দিনের মাছ পাওয়া যায়। জাল টেনে তোলার সময় রুই-কাতলা-চিতলের লাফালাফি। মাছের রুপোলি শরীরের সে কি ঝিলিক! দেখার মতো বিষয়। কথায় বলে, তাজা মাছের লাফ আর নারীর নগ্ন শরীর উভয়ই পুরুষকে সমান আকর্ষণ করে।
পুকুরের ওপারে বড় বড় দুটি ঝাউ গাছ। ঝাউ গাছে নিচে নল খাগড়া আর কাশের ঝোপ। খান সাহেবেরও আছে পাখি মারার নেশা। তবে তার পাখি মারার বন্দুক নেই, অথবা আছে তিনি সেটি ব্যবহারের চাইতে মানুষ মারার বন্দুক দিয়ে পাখি মারতেই অধিক আনন্দ পান।
একদিন বিকেল হবার বেশ একটু আগেই-দুপুরের শেষ প্রান্তে কয়েকটা হাঁস এসে বসে সেই ঝাউ গাছে। হাঁসগুলো খুবই হৃষ্ট-পুষ্ট। অনেক দূর থেকে ওড়ে এসেছে তারা। তাদের গন্তব্য আরো দূরে কোনো বিল বা খালের ধারে। এখানে বসেছে একটু বিশ্রামের জন্য। খবরটা চলে যায় লুৎফর রহমান খানের কাছে। যদিও আরো অনেকেই হাঁসগুলোকে দেখেছিল, খান বাড়ির ঝাউ গাছের হাঁসের দিকে গুলি ছুড়তে সাহস হয়নি কারো।
লুৎফর রহমান খান ছুটে আসেন তার মানুষ মারা বন্দুক নিয়ে। মূলত তিনি পাকা শিকারি নন। হাতের নিশানা মোটেও ভালো নয়। তার উপর বয়স হয়েছে। হাত-মাথা একটু কাঁপে যেন। পারকিনসনস রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন কিনা কে জানে।
তিনি অনেকটি সময় নিয়ে নিশানা ঠিক করলেন। তারপর গুলি করলেন। মানুষ মারার বন্দুক। শব্দটা খুব বেশি। আশেপাশের অনেকেই না দেখেও আন্দাজ করে ফেলেছে, গুলি করেছেন খান সাহেব। হাঁসগুলো ওড়ে চলে গেল। যাবার বেলা কয়েকটা পালক ফেলে রেখে গেল। পালকগুলো ফেলে দিয়ে হাঁসগুলো যেন ইচ্ছাকৃতভাবে খান সাহেবকে অপমান করল। ওরা হয়তো ওড়ে যেতে যেতে বলল-তোমার যা হাত! আমাদের তো কিছু করতে পারলে না, এবার ওই পলক দিয়ে কান চুলকাও।
লুৎফর রহমান খান দাঁড়িয়ে রইলেন স্থির। আর তখনই গ্রামের হতদরিদ্র ঈমান শেখ তার দশ বছরের ছেলে ফরিদ শেখকে নিয়ে এসে দাঁড়াল তার সামনে। ঈমান শেখকে ছেলের হাত ধরে খান সাহেবের কাছে আসতে দেখে এলাকার যুবক মোসলেম মিয়াও এল সেখানে। ঈমান শেখ বলল-কাকা সেলাম।
কিছু বলতে চাস? কাকা, আমার পোলাডা বাঁশের ঝাড়ে কঞ্চি কাটতেছিল। আপনে যে হাঁসরে গুলি করছেন, গুলিডা আমার পোলার কানের পাশ দিয়া গেছে। বলিস কী! তারপর খান সাহেব ঈমান শেখের ছেলেটাকে কাছে ডেকে বললেন-ভয় পাস নাই তো?
ডরামু ক্যামনে? আমি কি কিছু বুঝছি? গুলিডা পাকা বাঁশে লাইগা যহন ফিরা আইলো...এই দ্যাহেন গুলি আমি নিয়া আসছি। বাহ! গুলিটা একেবারে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছিস? যাক, ভয় যে পাসনি এটাই ভালো। যা, বাড়ি যা। এতগুলো পাখির একটাও মরলো না, মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। নিজের ওপর খুব রাগ হচ্ছে।
খান সাহেব চলে গেলেন। তার চলার পথে তাকিয়ে রইল ঈমান শেখ আর তার ছেলে। যুবক মোসলেম মিয়া বলল-ঈমান বাই, গুলিডা যদি আপনের পোলার বুকে লাগতো? লাগলে মইরা যাইতো।
তহন কী করতেন? কী আর করতাম? তহনও এই একই বিচার দিতাম-কাকা, আপনের গুলি লাইগা আমার পোলাডা মইরা গেছে। খান সব হয়তো কইতেন-বলিস কী! মরে গেছে, ভয় পায়নি তো? যাক, মরছে মরছে ভয় যে পায়নি এটাই বড় কথা। ঈমান শেখ খান সাহেবে কথাটা তার ভাষায় হুবহু নকল করে শোনালো। মোসলেম মিয়া বলল-এই পর্যন্তই, আর কিছু হইতো না?
আর কী হইবো মোসলেম মিয়া? আমরা কি পারতাম খান সাবের বিরুদ্ধে থানা-পুলিশ করতে? কও পারতাম? হাঁসরে গুলি করছে, মরছে আমার পোলা। হাঁসের চাইতে কি আমার পোলার দাম তাগো কাছে বেশি? ঐ হাঁসগুলান তাও উইড়া যাইতে পারছে খান সাবগো কাছ থিকা, আমরা সেইটাও পারি না। হ হ মোসলেম মিয়া, আর একটু কিছু হইতে পারতো। খান সাব হয়তো কইতো-তোর পোলাটা যখন মরেই গেল, তখন নে এই টাকাটা রাখ-আরে রাখ।
তারপর ঈমান শেখ বড় একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল-বুঝলা মোসলেম মিয়া, আমরা হইলাম পাখনা ভাঙা হাঁস। খান সাবগো কাছ থিকা উইড়া যাওনের ক্ষ্যামতাও আমাগো নাই।
আজকালের খবর/আরইউ