প্রকাশ: শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩:৫৯ পিএম
তাহাজ্জদ হোসেনের ক্লাস আজ সকাল ১০টায়। তাই সে আজ একটু তাড়াতাড়িই বেড়িয়ে পড়ে। যথাসময়ে ক্লাসে যেতেই হবে। তার বাড়ি হতে কলেজের দূরত্ব ১৬ কিলোমিটার। চাকরির প্রথম দু’বছর ভ্যান, রিকশা বা বাসে করেই গেছে সে। পরে কলেজের শিক্ষকদের বাইক পরিবর্তনের প্রতিযোগিতা দেখে সে হীনমন্যতায় ভুগেছিল। অবশেষে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক হতে পঞ্চাশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছয় মাসের কিস্তিতে একটা চায়না জনসন মোটরসাইকেল কিনেছিল সে। এই মোটরবাইকটি কিনার পর সে নিজের একটা পরিবর্তনও লক্ষ্য করেছিল। কেমন যেন একটা ভাব চলে এসছিল তার। প্রথমেই একটি কালো চশমা কিনেছিল। চশমাটি চোখের চেয়ে কপালেই রাখতে পছন্দ করতো বেশি। আগে ছোট চা-পানের দোকানে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েও চা-পান পাওয়া যেতো না। এখন বাইকে বসে চাইলেও দোকানদার তড়িঘড়ি এগিয়ে দেয়। আগে গ্রামের বিয়ের অনুষ্ঠানে বিয়ের দাওয়াত কমই পেত। আর এখন মোটরসাইকেলে একজন বাড়তি বরযাত্রী যাওয়া যায় বলে, গ্রামের কোনো বিয়েতেই তার নাম বাদ পরে না। দাওয়াত পাওয়ায় সমস্যাও হয়েছে অনেক; যা সামান্য বেতন পায়, তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালানোই কঠিন। তারপরে গ্রামের মানুষ কলেজ শিক্ষক হলেই প্রফেসর বলে। তার নাম পড়ে গিয়েছিল তাহাজ্জদ প্রফেসর। নিজেকে প্রফেসর ভেবে পাঁচশত টাকার কম দানও দিতে পারতো না সে। প্রায় মাসে পনেরশ দুই হাজার টাকার একটা উটকো চাপ পড়েছিল তার ঘাড়ে।
বাবা সবুর আলী ডায়াবেটিসের রোগী। সাথে এজমা, উচ্চ রক্তচাপ। বারমাসেই তের প্রকারের ওষুধ লাগে তার। মা আমেনা খাতুনের শরীরের অবস্থাও ভালো ছিল না। বাড়িটাই যেন ছিল একটা অঘোষিত হাসপাতালের মত। অভাবী মানুষের বুদ্ধি থাকলেও সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হয়। তাহাজ্জদ হোসনে ছিলেন ভুল করার ওস্তাদ। পয়সার অভাবে এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা বাদ দিয়ে মাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ‘তকদির হারবাল’ চিকিৎসালয়ে। হারবাল চিকিৎসায় উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস একেবারে নির্মূল হয়ে যায়। পয়সাও লাগে কম। গ্যারান্টি সহকারে চিকিৎসা। তাই নিয়মিত ওষুধ কেনার সামর্থ্যরে অভাবে হারবাল ট্রিটমেন্টকেই যৌক্তিক মনেকরে সে। যদিও মন সায় দিচ্ছিল না, বউয়ের অতি উৎসাহের কারণে সাহস করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল। চিকিৎসার ফল শুরুতেই পাওয়া গেল। আচমকাই স্ট্রোক করে মা মরে গেলেন।
বউটা অবশ্য কেঁদেছিল খুব। শাশুড়িকে সর্বক্ষণ গঞ্জনা লাঞ্ছনার কথা মনে পড়ে ছিল বোধকরি। মৃত্যুতে একটা অব্যক্ত শোকও বুঝি অনেকের উথলে ওঠে। মহিলাদের আরো বেশি। তাহাজ্জদের মা এ দৃশ্য দেখে যেতে পারলে খুশি হতেন। তার দজ্জাল বউটা কী রকম ভাবে তার পায়ের উপরে পড়ে পাগলের মতো কাঁদছে। মানুষের মন কেমন যেন মেঘের ফাঁকে লুকানো সূর্যের মতো অবস্থান বদলায়। তাহাজ্জদ হোসেন কাঁদে না। তার মায়ের মৃত্যুর জন্য তার নিজেকেই দায়ী মনে হয়। মা বেঁচে থাকতে বউ যখন প্রায়ই তার মাকে ধমকাতো, তখন তাহাজ্জদ হোসেন মায়ের হয়ে কোনদিন কোন কথা বলতে পারেনি। অভাবি পুরুষ আসলে কোন পুরুষই না। সে যতদিন বাঁচে কাপুরুষের মতো বাঁচে।
এখন অবশ্য তার অবস্থা বদলাতে শুরু করেছে। কলেজ সরকারি হওয়ায় বেতন প্রায় দিগুণেরও বেশি হয়েছে। বাবার ওষুধ কিনতে অসুবিধা হয় না। বউও তার স্বৈরাচারী আচরণ পরিবর্তন করতে শুরু করেছে। বাচ্চারাও ভদ্দরলোকের বাচ্চাদের মতো শিশুই থাকতে চাইছে। কে যেন বলে ছিল, অর্থই হল সব কর্মকাণ্ড ও আচার আচরণের মূল প্রভাবক। এই কথাটি প্রমাণ হতে শুরু করেছে তার জীবনে। অর্থের সুযোগ সেও নিয়েছে। পুরোনো জনসন গাড়িটা বিক্রি করে দেড়শো সিসির পালচার কিনেছে একটা। আস্তে চালালেও জোরে চলে এটি। তাহাজ্জদ হোসেন তাই আগের চেয়ে একটু জোরেই চালায়। আজ তাই নয়টাতেই পৌঁছে গিয়েছে কলেজে। পিয়ন ঘণ্টা বাজাচ্ছে। কলেজ শুরুর ঘণ্টা। কলেজের সুন্দরী দু-একজন মেয়ে তাতেই কান চেপে ধরছে। তাহাজ্জদ হোসেন আড়চোখে ছাত্রদের দিকে একবার দেখে নিয়ে টিচার্স রুমে গিয়ে বসল। দশটা বাজতে আরো চল্লিশ মিনিট বাকি। জিন্সের প্যান্টের পকেট হতে আইফোনটি বের করে তাহাজ্জদ। এরপরে ফেসবুকে প্রবেশ করে সুন্দরী নারীদের লেখা কবিতা পড়তে শুরু করে সে।
কবিতার ভেতর দিয়ে সে ফেলে আসা করুণ শৈশবে প্রবেশ করে। মনে পড়ে শীতের সকাল। মা তাকে জামা পরিয়ে, মাথায় সরিষার তেল মাখিয়ে স্কুলে নিয়ে যাচ্ছে। হাতের কাখে তিনটি মলাট লাগনো বই।মা বলছে, ‘তজু, তুই বড় হয়ে মাস্টার হবি। সংসারে কোনো অভাব থাকবে না। আমরা তখন খুব আনন্দ করে ইদ করব। তোর বাবাকে একটা খদ্দেরের পাঞ্জাবি কিনে দিবি। আমাকে দুইটা কানের দুল। জীবন দ্রুতই বাঁকে বাঁকে গতি বদলে ফেলে। তার চাকরি হওয়ার পরে মা আর কানের দুল চায়নি। সংসারের দঙ্গলে একটা দূরত্ব হয়ে গিয়েছিল। মা বোধহয় তার জবজব সরিষার তেল মাথায় দেওয়া ছেলেকে হারিয়ে ফেলেছিলেন।
মায়ের কবর কল্পনা করে তাহাজ্জদ। অনেক দিন সেদিকে যাওয়ার তার সময়ই হয়নি। সে একটি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তার নিজের ছেলে রায়হান চাকরি করছে। বাড়িতে বউ এসেছে। সংসারের ভেতরে গজিয়ে উঠেছে আরেক সংসার। তার নিজের চাকরিও শেষের বেলায়। ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মায়ের কবর হতে তার দূরত্ব বোধহয় কমে আসছে। তাহাজ্জদ প্রফেসর দেখতে পান, মায়ের কানে একজোড়া স্বর্ণের চমৎকার দুল। মা হেসে হেসে বলছে, ‘তজু, আয় কোলে আয় বাবা। সংসারের ভিতরে সংসার আর কদিন থাকে? জীবন হল স্বপ্নের পূর্ণতা আর অপূর্ণতার যোগবিয়োগ। মৃত্যুই তার গন্তব্য।’
আজকালের খবর/আরইউ