বসে বসে সামনে উত্তাল সমুদ্র দেখছি। বিশাল বড় বড় ঢেউ সামনে এসে আছড়ে পরছে। এই ঢেউয়ের সুবিধা হলো নদীর ঢেউয়ে মানুষের ঘড়বাড়ি ভেঙে যায়, সমুদ্রের ঢেউয়ে ভাঙে না। আমি ঢেউ গুনছি। এক দুই তিন। কিছুটা নেশা করার এই এক অসুবিধা আমার। সবকিছু গুণতে ইচ্ছে করে। আমি অবশ্য সমুদ্র পাড়ে নই। খুব কাছাকাছি এক নামি দামি হোটেলে আছি। টেবিলে বিয়ারের গ্লাস। চিংড়ি ফ্রাই আর মুরগির ঠ্যাং ভাজা। এখন বিকেল গড়াচ্ছে। একটু পরেই সন্ধ্যা নামবে। সবাই ছুটছে সূর্যাস্তের ছবি তুলতে। বিচ্ছিরি! যে চলে যাচ্ছে তাকে নিয়ে এত হুড়োহুড়ি কেন রে বাবা! যে আসছে তাকে স্বাগত জানাও। আমার মত। আমি রাতকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত হচ্ছি। একটা সঙ্গিনী জোগাড় করতে বলেছিলাম এক জনকে। দালাল। সে ফোন দিয়েছিল। একটা মেয়ে পেয়েছে। ভালো। আমি হাসি। এই লাইনের মেয়ে আবার ভালো! আর আবার জাত বেজাত! কি অবস্থা দেশটার! আমি বলি নিয়ে আসো। একটা হলেই হয়। স্যার, একটু বেশি খরচ হবে কিন্তু।
আরে শালা, আগে আন তো। তারপর তো টাকা। বেশি বকাস না। এমনিতেই মাথা ঝিমঝিম করছে। একজনকে দরকার। বুঝেছিস?
আমার কথার গতি দেখে দালালটা আর কথা বাড়ানোর সাহস করে না। আচ্ছা আনছি বলেই ছেড়ে দেয়। ব্যাটা আমাকে কী মনে করছে? লুচ্চা! হোক গে! এই তিনটা দিন সে যা ইচ্ছা তাই হতে পারে। কে কি ভাবছে তা নিয়ে চিন্তা করার সুযোগ নেই।
কিছুক্ষণ পরেই দরজায় শব্দ হয়। প্রায় টলতে টলতে আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলি। হোটেলের একটা বয় দাঁড়িয়ে আছে।
আপনার সাথে একজন দেখা করতে চায়?
আচ্ছা পাঠিয়ে দাও বলেই দরজা খোলা রেখেই আমি ভিতরে এসে আবারও গ্লাসে চুমুক দিই। আমার পিছনে পিছনেই ঢোকে একটু আগে ফোন করা সেই দালাল আর তার পিছনে একটা মেয়ে।
স্যার এনেছি। আপনি একবার দেখে নিন।
আমাকে দেখতে হবে?
জ্বী দেখে নিলে ভালো হয়।
পছন্দ না হলে বদলে দেবে?
লোকটা ইতস্তত করতে থাকে। আমি পকেট থেকে একতোড়া টাকার নোট বের করে ছুড়ে দিই। লোকটা কিছুটা কুকুরের মত লাফিয়ে ধরে ফেলে। তারপর থু থু দিয়ে গুনতে থাকে। টাকা গোণা শেষ হলে আমি বলি, এবার বিদেয় হও।
কোনা কথা না বলে লোকটা বেরিয়ে যায়। হোটেলের রুমে তখন আমি আর অচেনা সেই মেয়েটা। বিকেলের আলো তখন নিভে আসছে। মেয়েটা ঘরের সোফার এক কোণায় বসে আছে। মুখটার অর্ধেক ঢাকা। চোখ দুটো বেরিয়ে আছে। আমি মেয়েটির চোখের দিকে আড়চোখে তাকালাম। দেখলাম সেও আমাকে দেখছে। দেখতেই পারে। এদেরকে বলা হয় সমুদ্র কন্যা। এসব সমুদ্র কন্যারা আমাদের সঙ্গ দেওয়ার জন্যই ঘুরে বেড়ায়। মাত্র তিনদিনের সঙ্গী সে। সেই এখন আমার প্রেমিকা, আমার বউ। অথচ আমি বিয়ে থা মুক্ত মানুষ। আমার টাকার কোনো শেষ নেই। সেই টাকার কিছু অংশ মাঝে মধ্যেই এসব ছাপপাশ কাজে ব্যয় করি। টাকার অবৈধ ব্যয়! সময়টাও বেশ কাটে! প্রত্যেক বারই একজন সমুদ্র কন্যাকে ভাড়া করি। এতে আমার কোনো লজ্জাবোধ নেই। আমি নির্লজ্জ্ব বলতে পারেন। আর কাকেই বা লজ্জা পাবো! বিয়ে থা করিনি। ঘর সংসার নেই। বাজারে লেখালেখিতে সুনাম আছে। বেশ পসার করেছি। এত সব কোথায় রাখবো? তাই একটু ফূর্তি করে কমাই। আমি গ্লাস হাতে বারান্দা থেকে উঠে এসে মেয়েটির সামনের সোফায় বসি। মেয়েটিকে দেখার চেষ্টা করি। শুধু চোখ দুটো বেরিয়ে আছে। অসম্ভব সুন্দর চোখ দুটো। যেন কতদিনের চেনা। এই চোখ আমি আগেও দেখেছি। মনে হয় কবিতাও লিখেছি।
আপনার চোখ দুটো বেশ সুন্দর।
আমার হঠাৎ করা এই মন্তব্যে মেয়েটি কেমন যেন নড়েচড়ে উঠলো। আড়ষ্ট থেকে জেগে উঠলো। মনে হলো মেয়েটি ভাবনার গভীর সাগরে ডুব দিয়ে ছিল। আমি তাকে টেনে তুললাম।
আমরা কি ঘরেই বসে থাকবো? এবার মেয়েটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল।
অফ কোর্স নট। আমরা এখন সমুদ্রের পাড়ে যাবো। হাত ধরাধরি করে ঘুরবো। তারপর রাতে ডিনার সেরে হোটেল রুমে ফিরবো। চলেন বের হই।
আমরা হোটেল রুম ছেড়ে সমুদ্রের তীরে এসে পৌছাই। পাশাপাশি হাঁটতে থাকি। মেয়েটিই নিরবতা ভাঙে।
আমরা কি শুধু পাশাপাশি হাঁটবো?
আপনি কী চান?
আমি টাকার বিনিময়ে এসেছি। আপনি যা চান সেটাই হবে। আমার চাওয়া বা না চাওয়ার কোনো মূল্য নেই। হোটেলের সাথে আমাদের মত মেয়েদের এরকমই চুক্তি থাকে।
আমি চুপ থাকি। কেন যেন আমার আজ দ্বিধা হচ্ছে। মেয়েটির চোখ আমাকে বেশ ধাঁধায় ফেলে দিয়েছে। কোথায় যেন দেখেছি। কোথায়?
মেয়েটি এবার আমাকে অবাক করে জিজ্ঞ্যেস করে, আজও আপনি কবিতা লিখেন?
আমি আশ্চর্য হই। এখানে আমাকে কেউ চেনার কথা না। এই মেয়েটির তো আরো না।
আপনি কিভাবে জানলেন?
মেয়েটি এবার মুখের উপর থেকে পর্দা সরিয়ে দেয়। আর আমার সামনে ভেসে ওঠে আমার অতীত। বহু বছর আগেই যা হারিয়ে গেছে। ওর নাম অরুণিমা। হ্যাঁ, ও অরুণিমা দাসই। আমার কলেজের এক বছরের জুনিয়র। আমাদের পাঁচ বছরের সম্পর্ক চুকেবুকে যায় এক চৈত্রের বিকেলে।
অরুণিমা তুমি?
মনে আছে তাহলে?
আমি নিরুত্তর। কি জবাব দেব? অরুণিমা হিন্দু জেনেও আমি ভালবাসি। হয়তো অরুণিমাকে পাব না জেনেও আমি এগিয়ে যাই। এখানে বলা ভালো যে আমি আসলে মেয়েটির চোখের প্রেমে পড়েছিলাম। সেখানে থেকেই একজন পূর্ণ অরুণিমাকে ভালোবেসে ফেলি। প্রথমে অরুণিমার তরফ থেকে কোনো সাড়া ছিল না। অনেক চেষ্টার পর মানে অরুণিমার পিছনে ঘোরাঘুরির পর সে সাড়া দিয়েছিল। যদিও আমরা কেউই জানতো না এর পরিণতি আসলে কি হবে। এভাবে পাঁচ বছর চলার পর একদিন অরুণিমা হঠাৎ আমাকে জানায় ওর পরিবার বিয়ে ঠিক করছে। আমার কিছুই বলার ছিল না। শুধু বলেছিলাম অপেক্ষা করতে। কারণ আমি তখনও পড়ালেখাই শেষ করতে পারিনি। অরুণিমার বিয়ে হয়ে যায়। তার কিছুদিন পর আমি দেশের বাইরে চলে যাই। অনেকদিন আর অরুণিমার খোঁজ নেওয়া হয়নি। কি হবে ভেবে আর এগোইনি ও পথে। জানি, অরুণমা তখন অন্য কারও। এটা আমি মানতে পারতাম না তখনও। কিন্তু আমি কি আর জানতাম আজ এতদিন পর হঠাৎ এভাবে অরুণিমাকে পেয়ে যাবো!
একটা প্রশ্ন করি।
অরুণিমা তাকায় আমার দিকে। করো।
তুমি এখানে মানে এভাবে কেন?
ধরো, আমার নিয়তি। তুমি যখন আমাকে ফিরিয়ে দিলে তখন আমার বিয়ে হয়ে যায় বাবা-মা’র পছন্দ করা ছেলের সাথে। কিন্তু ছেলেটি ছিল সবরকমভাবে খারাপ। আমাকে মারধর করতো প্রতিদিন। মানসিক অত্যাচার করতো। ছেড়ে আসতেও চেয়েছি। কিন্তু একটা অ্যাকসিডেন্টে বাবা-মা মারা যাওয়ার পর আর কার কাছে ফিরবো ভেবে ফেরা হয়নি। তোমারও আর কোনো খোঁজ পাইনি। তুমি নাকি বিদেশে গেছ। তারপর আমার স্বামীর চূড়ান্ত খারাপ রূপ দেখলাম। একদিন আমাকে এখানে বেড়াতে নিয়ে এলো। দুদিন একসাথে ঘুরলাম। অনেক কেনাকাটা করলাম। তারপর এক সকালে হোটেলে আমার স্বামী আমাকে একা রেখে পালিয়ে গেল। হোটেলের লোকজন বলল, ও নাকি আমাকে বেঁচে দিয়েছে। তারপর আমাকে আটকে রাখা হলো। না খাইয়ে রাখা হলো। অবশেষে আমি নষ্ট হলাম। সমাজ তোমার অরুণিমাকে নষ্ট করল। অরুণিমার চোখ আজ শুধু তার কাস্টমারদের জন্য। অরুণিমার চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে। আমি মনে করার চেষ্টা করি ঠিক কবে এভাবে আমি অরুণিমাকে কাঁদতে দেখেছিলাম। মনে পড়ে। সেই যেদিন অরুণিমাকে আমি অস্বীকার করেছিলাম। সাগরে ততক্ষণে আঁধার নেমেছে। আমি হাত বাড়িয়ে অরুণিমার চোখের জল মুছে দেই।
আজকালের খবর/আরইউ