
যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তায় দাঁড়িয়ে পরবর্তী গন্তব্যের নাম হাঁকছে লেগুনার চালকের সহকারী। ১০ জনের জায়গায় ১৫ যাত্রী নিয়ে ছুটল লেগুনা। ৩০ মিনিটে এবড়োথেবড়ো রাস্তা আর ধুলার রাজ্য পেরিয়ে গন্তব্যে পৌঁছেই বিস্ময় এত বিশাল স্থাপনা রাণীমহল! এক ভবনে দুই প্রতিষ্ঠান রাণীমহল, মতিমহল। সামনে খোদাই করে লেখা, ১৯৬৮।
কাগজে-কলমে এই এলাকার নাম সারুলিয়া। তবে ঠিক যে জায়গাটিতে রাণীমহল সিনেমা হল, গণমানুষের কাছে তা রাণীমহল নামে পরিচিত। এখানে যে স্থানীয় যানবাহনগুলো দাঁড়ায় কিংবা চলে, প্রায় সবগুলোর গায়ে স্টেশন হিসেবে রাণীমহল লেখা। এই পরিচিতি অর্জন করতে প্রতিষ্ঠানটির লেগে গেছে প্রায় অর্ধশত বছর। এখন রাণীমহল স্টেশনটি সরগরম থাকলেও হলটি নির্জীব; যেন নিজের ভার বইতে পারছে না।
এলাকার একাধিক প্রজন্মের স্থায়ী বাসিন্দাদের স্মৃতির একটা বড় অংশে উজ্জ্বল রাণীমহল। ‘আমাদের কৈশোর তারুণ্যে বিনোদনকেন্দ্র বলতে এটিই ছিল প্রধান’- বললেন বাংলাদেশ থিয়েটারের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার শাহ আলম। তিনি থাকেন এই এলাকাতেই। ‘মনে পড়ে এক ঈদের সন্ধ্যায় শাবানা-আলমগীরের মনিহার ছবিটা দেখতে গিয়েছিলাম। বাড়ি ফিরে মিলল বাবার বেতের বাড়ি। সেই দুঃখের অভিজ্ঞতার পাশাপাশি স্মৃতিতে এখনো স্পষ্ট; গরুর গাড়ি নিয়ে ছুটতে ছুটতে শাবানার মুখে সেই গান, ‘বিক্রমপুরে বাপের বাড়ি ছিল একদিন পদ্মার পাড়/ মামার বাড়ি মধুপুরে, নিজের বাড়ি নাই আমার।’ শাহ আলম আরও জানালেন, এই ছবিতেই ছিল ওরে সাম্পানওয়ালা... গানটি।
কোনো এক শুক্রবার দুপুরে রাণীমহলে গিয়ে মিলল ঝকঝকে এক স্থাপনা। এমন ধুলাবালুর রাজ্যে এ প্রতিষ্ঠানের ভেতরে কী করে এতটা পরিচ্ছন্ন! দেয়ালগুলোও সুন্দর, নানা রঙের। দোতলায় সিঁড়িতে উঠতে নানা রকমের ম্যুরাল, হরিণের পাল তাড়া করছে বেঙ্গল টাইগার। তিন পাশে নানান কারুকাজে ষাটের দশকের চিহ্ন। মিলনায়তনের বাইরে বারান্দাটি বেশ বড়। কয়েকজন কিশোর কাছাকাছি এলাকা থেকে সিনেমা দেখতে এসেছে। শো শুরু হতে দেরি আছে; তাই বল নিয়ে দুষ্টুমিতে মেতেছে।
এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম রাণীমহলের প্রথম দিককার স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘এলাকায় এমন একটি বড় ভবন দেখে আমরা অবাক হতাম। কী সুন্দর নকশা। ১৯৬৮ সালের আগে আমি এখানে যাত্রাও দেখেছি। হল চালুর পর আমি প্রথম পরিচালক রহিম নেওয়াজের সুয়োরানি দুয়োরানি ছবিটি দেখি। সুচন্দা, রাজ্জাককে প্রথম দেখেছিলাম পর্দায়। প্রতি শুক্রবার দেখতাম উর্দু ছবি।’
হলের ব্যবস্থাপক আবদুর রাজ্জাক এলেন দুপুরের বেশ খানিকটা পরে। সহকর্মীদের কাছ থেকে হলের চারপাশে ভাড়া দেওয়া দোকানপাটের ভাড়া বুঝে নিলেন। সে কাজ সেরে হলের প্রসঙ্গে কথা শুরু করতেই হতাশা, ‘কী লাভ হলের কথা বলে, এসব দিয়ে কী হবে। হলের ব্যবসা শেষ!’
প্রায় দুই দশক ধরে এ প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন তিনি। আলাপচারিতায় স্পষ্ট, একসময় এলাকার একমাত্র বিনোদনকেন্দ্র হিসেবে জনপ্রিয়তা পাওয়া রাণীমহল নিয়ে এখন তিনি পুরোপুরিই হতাশ। মালিকপক্ষও চাইছে হল বন্ধ করে দিতে। কিন্তু এটি মূলত শিল্প এলাকা। মার্কেট বানালে এখানে সেই অর্থে জমবে না।
দুই হলে বর্তমানে কটি আসন আছে-প্রশ্ন শুনে কিছুটা অপ্রস্তুত মনে হলো ব্যবস্থাপককে। শেষমেশ জানালেন, রাণীমহলে ৫৬৭টি, মতিমহলে ৫৫০টি আসন আছে। সব মিলিয়ে ১ হাজার ১১৭ আসন।
এই আসনগুলো প্রতিদিন অপেক্ষায় থাকে পাশের শিল্পকারখানার কর্মীদের জন্য। কাছাকাছি করিম জুট মিল, লতিফ বাওয়ানী জুট মিলের মতো নামকরা প্রতিষ্ঠান। যদিও শুক্রবার বিকেল আর সন্ধ্যা ছাড়া খুব বেশি দর্শনার্থী মেলে না।
‘কেমনে আসবে মানুষ! বাহির হইয়া দেখেন আশে পাশে চা-দোকান, হোটেল-রেস্টুরেন্টে টিভি বসাইয়া থুইসে। সারা দিন গান, ছবি চলে। পাবলিক সেইখানে ডুইব্বা থায়ে’!-বললেন হলের পুরোনো কর্মী আবদুল ওয়াহাব। হলের মূল প্রবেশপথে দায়িত্বে ছিলেন তিনি। জানালেন, একসময় পরিবার-পরিজন নিয়ে অনেক নারী দর্শক আসতেন। দর্শকদের পদচারণায় মুখরিত থাকত রাণীমহল।
১৯৬৮ সালে হলটির উদ্বোধনের কথা মনে আছে বাদশা মিয়ার। শুরু থেকে এ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি। জীবিকা আর আবেগও এক হয়ে গেছে। তিনি জানালেন, মালিক এম এ সাত্তার সাহেব তার মেয়ে রাণীর নামে হলের নাম রেখেছেন রাণীমহল। ১৯৬৮ সালে খান আতা পরিচালিত, কবরী-আজিম অভিনীত অরুণ বরুণ কিরণমালা দিয়ে যাত্রা শুরু হয়েছিল রাণীমহলের।
তখন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিলেন মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ। অসুস্থতার কারণে কথা বলতে পারেননি। তার মেয়ে শিরীন শবনম বলেন, ‘আমরা হলের ওপরে একটি বাসায় থাকতাম। হলে জোরে গান বাজলে আমাদের বাসায় শোনা যেত।’ তিনি বলেন, ‘বাবার কাছে শুনেছি, ওই সময় নতুন ছবি পাওয়াটা খুব কঠিন ছিল। বাংলার পাশাপাশি উর্দু ছবি চলত। অরুণ বরুণ কিরণমালার পর বেশ কিছুদিন উর্দু ছবি চলেছে। কিছুদিন পর ১৯৬৯ সালের মার্চে এসে এখানে মুক্তি পায় মমতাজ আলী পরিচালিত নতুন নামে ডাকো ছবিটি। ওই ছবির গানটি এখনো মনে আছে ‘নতুন নামে ডাকো আমায়, এই তো ছিল কামনা; রঙের পরশে রাঙিয়ে দিলে, মনের যত বাসনা...।’ একাত্তর সালের পর রাণীমহলের চাকরি ছেড়ে আসেন প্রথম ব্যবস্থাপক শহিদুল্লাহ।
শুরু থেকে বেশ সাড়া ফেলেছিল রাণীমহল। বিশেষ করে এলাকার শিল্পকারখানার কর্মীদের আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল এই হল। এলাকার নারী দর্শকদেরও আগ্রহের কেন্দ্রে ছিল। কারণ, নদী পার হয়ে নারায়ণগঞ্জে যাওয়া কিংবা পথঘাট মাড়িয়ে ঢাকায় যাওয়াটা কঠিন এবং সময়সাধ্য ছিল তখন। দিনে দিনে দর্শকের চাহিদা বাড়তে থাকায় মতিমহল নামে আরেকটি হল চালুর উদ্যোগ নেন মালিক।
প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা জানালেন ১৯৮৯ সালে “বেদের মেয়ে জোসনা” ছবিটি দিয়ে মতিমহল হলটি চালু হয়। ওই সময় থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত দুই প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে ৬০ জন কর্মী ছিলেন। বর্তমানে আছেন ৩৫ জন।
রাণীমহলের প্রতিষ্ঠাতা এম এ সাত্তারের মৃত্যুর পর এখন হলটি চালাচ্ছেন তার দুই ছেলে এম এ লতিফ এবং এম এ বশির। আগের মতো রমরমা ব্যবসা না থাকলেও মূলত বাবার স্মৃতি রক্ষার্থে হলটি চালু রেখেছেন তারা।
হলের ভেতরে সব জায়গায় সিসিটিভি ক্যামেরা। মহিলাদের আলাদা টিকিট কাউন্টার এবং মূল হলের বাইরে বসার জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে।
এমনিতে নতুন ছবির সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। তার ওপর দর্শক কম। বর্তমানে দ্বিতীয় সপ্তাহের মতো চলছে বলো দুগ্গা মাঈ কি... এবং বসগিরি।
হলের সামনে ছোট-বড় বেশ কিছু খাবারের দোকানসহ নানা প্রতিষ্ঠান। সামনেই একটা দোকানের কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘কী ছবি দেখুম হলে গিয়া। এখন আর মালিকেরা ঈদ-চাঁন ছাড়া নতুন ছবি আনে না।’
হল থেকে বের হয়ে রাস্তায় দাঁড়াতেই মিলে গেল লেগুনা। চালকের পাশের আসনটি খালি পেয়ে বসে পড়ি। যাত্রাবাড়ী ফেরার পথে দেখি চালকের মোবাইলটি স্টিয়ারিংয়ের সামনে। বাংলা, হিন্দি ছবির গানের একটার পর একটা ভিডিও বাজছে তাতে। হলের কর্মী আবদুল ওয়াহাবের কথাটি মনে পড়ে গেল, দোকানে, রেস্টুরেন্টে সব জায়গায় টিভি লাগানো। আর মোবাইল তো হাতে হাতে। কেন মানুষ টিকিট কেটে হলে যাবে!- লেখক: নাট্যনির্মাতা
আজকালের খবর/আতে