তীরের গতিতে ছুটে আসছে ছেলেটি। মাথায় লাল ফিতা বাঁধা। ডানহাতের কব্জিতে নীল-সাদা ব্যান্ড। চারিদিকে ছাত্র-শিক্ষক-দর্শকের বাঁধভাঙা উল্লাস। মুহুর্মুহু করতালি। উচ্ছ্বসিত চিৎকারে চারিদিক কাঁপছে। নিমিষেই ‘বিজয় রশি’ স্পর্শ করলো। সকলে বিজয়ীকে ঘিরে ধরলো। চিরায়ত হাসি হেসে অভিনন্দন জানাতে ভুল করলো না বিজয়ী আরমান ভাণ্ডারী। কেবল একহাজার মিটার দৌঁড়েই নয়; ম্যারাথন, হাইজাম্প, লংজাম্প, সাঁতারসহ প্রতিটি ইভেন্টেই তার প্রথম হওয়া চাই। হয়ও তাই। এতেই ছাত্রজীবন সার্থক ভেবে তৃপ্ত হয়। বিজয় মঞ্চের সর্বোচ্চ স্থানে দাঁড়িয়ে প্রধান অতিথি কিংবা প্রধান শিক্ষকের হাত থেকে প্রথমস্থানের পুরস্কার গ্রহণ; বীর সৈনিকের ঢংয়ে কপালে আঙুল ছুঁয়ে স্যালুট জানানোর সার্থকতাই আলাদা। এর চেয়ে গর্বের আর কী আছে? স্কুল বলতে তার কাছে এসব বিশেষ দিনকেই মনে হয়। স্পোর্টসের বিভিন্ন ইভেন্টে পারফরম্যান্স মানেই সার্থকতা। জ্ঞানচর্চার নামে প্রতিদিন স্কুলে যাওয়াটা বরং কারাগার মনে হয়। নির্বিঘ্নে ছুটে চলা নেই। দমবন্ধ হয়ে আসে।
স্পোর্টসের দিনে আরমান স্কুলে আসবেই। পুরস্কারের আশায়! পুরস্কার গ্রহণ শেষ হতেই উধাও! ফলে রেগুলার ছাত্ররা প্রতিবারই বঞ্চিত হয়। এসব তাদের পছন্দ নয়। এমনকি স্বয়ং প্রধান শিক্ষক রাজশেখর মোহন্তেরও নয়। এ বিষয়ে তিনি শিক্ষকদের কাছে একাধিকবার ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ক্লাসে উত্তীর্ণ হওয়ার সময় পীড়াপীড়ি। তা ছাড়া ছাত্রদের কাছে উদ্ভটসব গল্প ফেঁদে বসে। যেমন- স্কুল-প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে মোটেই তার ইচ্ছা নয়; কেবল শিক্ষকদের অনুরোধে অংশ নিতে বাধ্য হয়। তবে একথাও সত্যি- স্কুলের গেমটিচার মুকুল মাস্টার তাকে ঠিকই আস্কারা দেয়। কারণও খুবই সহজ ও স্পষ্ট। প্রতিবছর আন্তঃজেলা প্রতিযোগিতায় স্কুলের মান রক্ষায় তাকে প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে গেমটিচারের কাছে তার গুরুত্ব কম নয়।
সবচেয়ে বড়গুণ শিক্ষকদের প্রতি আরমানের আনুগত্য। সেবার সাঁতার প্রতিযোগিতায় পূর্বপাশের দিঘীতে বিরাট আয়োজন। চারিদিকে উৎসুক জনতা। মুকুল মাস্টার ওপার থেকে সাঁতার স্টার্ট করতে বাঁশিতে ফুঁ দিয়েছেন। স্বয়ং প্রধান শিক্ষক কয়েকজনকে নিয়ে এপাড়ে বিজয়ী নির্ধারণের প্রতীক্ষায়। কিনারে পৌঁছানোর সামান্য মুহূর্ত আগে কেউ একজন শাঁ শাঁ গতিতে কয়েকজনকে টপকে বিজয় নির্ধারণে টানানো লাল ফিতা স্পর্শ করলো। চারিদিকে বাঁধভাঙা চিৎকার। কে এই ছাত্র? এতো জাতীয় পর্যায়ে অংশ নেওয়ার যোগ্য! স্কুলের সুনামতো এর হাতেই রয়েছে। রাজশেখর বাবু উচ্ছ্বসিতভাবে ছুটে গেলেন। এতো সেই আরমান! মুহূর্তেই স্যারের মুখটা ম্লান হয়ে গেল। যে উদ্যমে ছুটে গিয়েছিলেন; সেই গতিতেই ফিরতে উদ্যত হলেন। হৃদয়ভাঙার এমন মুহূর্তটুকু আরমানের চোখেও ধরা পড়ে। ফিরে যাওয়ার মর্মার্থ অনুভব করতে পারে। পাশের বাড়ির সিদ্দিক জানিয়েছিলো- ইরেগুলারিটির কারণে স্পোর্টসে অংশগ্রহণ হেডস্যার ভালো মনে নেন না। কথাটি হেডস্যার ছাত্রদের কাছেও প্রকাশ করেছেন। আরমান দ্রুত গিয়ে স্যারের পা জড়িয়ে ধরে। কেঁদে ফেলে।
-স্যার, আমিতো আপনার আরমান। আমারে বদদোয়া দিয়েন না! আমারে মাইরা ফ্যালান, তা না হইলে মাথায় হাত রাইখা দোয়া করেন, স্যার। আপনার আরমান কথা দিচ্ছে- আজ থেইকা আমি সব পারবো, স্যার। সময় মতো স্কুলে আসবো। এট্টুও ফাঁকি দিবো না। প্লিজ স্যার...।
হয়েছিলোও তাই। সবার আগে স্কুলে আসতো। ফিরতোও সকলের শেষে। ইংরেজি, গণিতে আগ্রহ ছিল না। তবে অন্যান্য সাবজেক্ট সে মন দিয়ে শুনতো। বুঝতে চেষ্টা করতো। হেডস্যার ইংরেজি ক্লাস নিতেন। তবে সুযোগ পেলেই পাক-ভারতের ইতিহাস আলোচনা করতেন। প্রাঞ্জলভাবে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতো আরমান। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন কীভাবে দানা বাঁধলো? ’৪৭-এ দ্বিজাতি তত্ত্বে কোন ধরনের চক্রান্তের আশ্রয় নেওয়া হয়েছে? লাভবান কারা হয়েছে? একই দেশের হাজার মাইল ব্যবধানে দুই ভূখণ্ড! একই শাসনের নামে প্রহসন; কত জঘন্য ষড়যন্ত্রের ফসল এসব! শেখ মুজিবুর রহমানইবা কেন মুক্তির পথ হিসেবে গোটা বাঙালিকে অধিকার আদায়ে স্বোচ্চার হতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। কী এর পরিনাম! স্বদেশি আন্দোলনের সঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তানি বাঙালিদের মুক্তি-আন্দোলনের সাদৃশ্য-বৈশাদৃশ্য কতটুকু- তা তিনি নিখুঁত আলোচনা করতেন।
স্বদেশি আন্দোলনের নায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনের জন্য আরমানের খুব মায়া হতো। লোভের মোহে নেত্র সেন তাকে ইংরেজদের হাতে ধরিয়ে দিলো! বাঙালির এমন বেইমানি মানতে পারে না আরমান। এসব ভেবে ব্যকুল হয় সে। স্যার এসব কথা যেন তার বুকের মধ্যে একটা একটা করে বসিয়ে দিয়েছেন। আপসোস হয়- কেন সে স্কুল ফাঁকি দিয়েছে? আরো কত জ্ঞান থেকে সে বঞ্চিত হয়েছে !
স্যার একদিন তামাশাচ্ছলে বললেন- স্কুলের সঙ্গে আরমানের সম্পর্কটা যেন পশ্চিম-পাকিস্তানের সঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তানের সম্পর্কের মতোই। একই শাসন ব্যবস্থা অথচ দূরত্বে বসবাস। একজনের থেকে অন্যজন বঞ্চিত হয়। শোষণ-শাসন নিয়মের মতোই।
সকলে হেসে উঠেছিল। আরমান অনুভব করে- ‘দূরত্ব যে কতটা ক্ষতির তা এখন হাড়েহাড়ে বুঝি!’
পূর্ব-পাকিস্তানের রাজনীতি তখন স্বাধীনতা লক্ষ্যে ক্রমেই উত্তাল হচ্ছে। আটষট্টির আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচনে বিপুল বিজয়েও ক্ষমতা না পাওয়া; ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার ডাক। দলে দলে মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিংয়ে যাচ্ছে। আরমান, ফয়সাল, সতীশ, খোরশেদ, রতন, পরিবারকে না জানিয়ে ট্রেনিংয়ে অংশ নেয়।
অবিভক্ত পাকিস্তানের দোহাইয়ে রেজাকার, আল-সামস্, আল-বদররা স্বোচ্চার হয়। মুক্তিকামী বাঙালিদের হামলা-মামলায় ফেলতে থাকে। এমনকি গুপ্তহত্যার মতো ঘৃণ্য পথ বেছে নিয়েছে তারা। আরমানের ছোট চাচা রজব আলী ভাণ্ডারী সরাসরি রেজাকার বাহিনীর সঙ্গে জড়িত। একদিন সকালে আরমানের বাবাকে ডেকে স্পষ্ট জানিয়ে দিল-
-আড়কান্দি বাজারে গতকাল সভা হইছে। সেখানের নির্দেশ- ‘মুক্তিযুদ্ধ ট্রেনিংয়ে কেউ অংশ নিলে তার পরিবার শুদ্ধা শ্যাষ করা হবে’। তোমার ছাওয়াল আরমান কই? তোমাদের জইন্যেতো আমার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ খোয়াইবো না। ব্যক্তি সম্পর্কের চাইতে আমার কাছে দল অনেক বড়। ছাওয়ালের সন্ধান করো। তারে কিন্তু বাঁচায়ে রাখতে পারবা না। অই রাজশেখর চাড়ালের নাম তালিকায় উইঠা গ্যাছে। অর মাইয়াডা ডাংরা অইছিলো তা ভাইবাও ডরাইলো না।
আজব আলী তার ভাইয়ের কথায় হতভম্ব হয়। আপন ভাইস্তারে মাইরা ফ্যালবে! ভাবতে থাকে- গেল বছর রজবের ছোটোপোলার টাইফয়েডে অইলো। পোলা যায়যায় অবস্থা। তহন কেউ বাড়ি ছিল না। অই মাস্টার খবর পাইয়া নিজে লইয়া হাসপাতালে যায়। ম্যালা টাহা খরচ গ্যাছিলো। আজও ফেরৎ লয় নাই। এমন ফেরেশতার মতো মাস্টারের নাম তালিকায় তুইলা দিছে! কতডা জঘন্য হইলে মাস্টারের মাইয়াডাও তার নজরে আইছে। আজব আলী ভেবে খুশি হয়- তার ছেলে ট্রেনিংয়ে গেলে খুব ভালো কাজ করছে। অন্তত এই জঘন্য মানুষগুলার প্রতিবাদতো করুক।
ফাল্গুন মাস চলে। আরমান বন্ধু ফয়সালকে সঙ্গে করে রাতের বেলা বাড়িতে আসে। মাকে সালাম করে। দোয়া চায়। রজব আলীর কথাগুলো জানায়। তারা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয় রাজশেখর স্যারকে সেভ করতে হবে। বেরিয়ে যায়। রাজশেখর মোহন্ত রেডিওতে খবর শুনছিলেন। যেন হিন্দু নিধন চলছে। পোড়ানো হচ্ছে সব। কামান দাগা হচ্ছে। আরমান রাজশেখর স্যারকে ডাক দেয়। একডাকেই সাড়া দেন তিনি। বিস্তারিত শুনে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন। মেয়ে পৃথা এবং স্ত্রী অঞ্জলিকে নিরাপদে শ^শুরবাড়ি ভাটপাড়া পৌঁছে দিতে ফয়সালকে নির্দেশনা দেন। সে মতো ওরা রওনা হয়। অন্ধকারময় রাত। মাস্টার তখন সিন্দুকের চাবি খুঁজছিলেন। সম্বল হিসেবে স্ত্রীর কিছু স্বর্ণালঙ্কার। সঙ্গে নিলে নিশ্চয়তা হবে। চাবি পেলেও বারবার চেষ্টাতেও খুলছে না। দরজায় ঠকঠক শব্দ। চমকে ওঠে দু’জন।
-ওই মাস্টার, দরজা খোলো। হ্যাঁ, রজবের গলা! বুঝতে পারে বিপদ আসন্ন। নিঃশব্দে পিছনের দরজা দিয়ে বেরোতে উদ্যত হয়। সেখানেও সশস্ত্র প্রহরা। একসময়ের ছাত্র ‘আজগর’ ও ‘রসুমিয়া’ দুই হাত চেপে ধরে। মাস্টার অস্পষ্ট কণ্ঠে জানতে চায়-
-একি! তোমরা?
-চোপ; শুয়োরের বাচ্চা মালাউন। তুই আমাদের দ্যাশের দুশমন। রাজশেখর মোহন্ত ভাষা হারায়। স্যারের ওপর অনুচিত বাক্যে বাধা দিয়ে কিছু একটা বলতে যেতেই রসু রাজাকার আরমানের গলাটাকে চেপে ধরে। গোঁ গোঁ শব্দ বেরোয়।
রজব আলী ঘর তন্ন তন্ন করে খোঁজে। বাইরে এসেই মাস্টারের গালে সজোরে থাপ্পর।
-অই মাস্টার, তোর মাইয়া-বউ কই? বিকালেও দ্যাখছি। দেহে জ¦ালা খেইলা গ্যাছে। জ¦ালা মিটাইতে অইবে।
এমন নির্দয় মুহূর্তে লজ্জায় মরে যাচ্ছিলেন যেন। অসহায় দৃষ্টিতে আরমানের দিকে তাকায়। শিক্ষকের চোখে চোখ পড়তেই আরমান কেঁদে ওঠে-
-স্যার, আমাকে সূর্য সেনের সেই নেত্র সেন ভাববেন না স্যার! বলেই রজব আলীর দিকে তেড়ে গিয়ে ঘুঁষি মারে।
-শুয়োর, যে হাত দিয়া তুই আমার স্যারেরে থাপ্পর মারছিস তোর সেই হাত আমি কাইটা ফ্যালাবো।
আজগর আরমানকে ঝাপ্টে ধরে। তারপর রাজশেখর স্যারের ব্যবহৃত গামছা দিয়ে একজনের ডান হাত অন্যজনের বামহাত একত্রে শক্ত করে বেঁধে ফেলে। হাঁটতে বাধ্য করে। বাজারের রেজাকার ক্যাম্পের দিকে। অকথ্য গালিগালাজ আর অত্যাচার চলে। ক্যাম্পে কেরামত মোল্যা দলবল নিয়ে বসে আছে। হ্যাজাক লাইটের আলোতে বীভৎস হাসি হাসছে সবাই। রজব আলী হঠাৎই আরমানের ডানহাত টেনে নিয়ে হ্যাজাকের আগুনের উপর চেপে ধরে- খানকির ছাওয়াল, চাড়ালের ওপর দরদ! আমারে ঘুষি মারছিস? হাত কাইটা নিবি? তোর হাত আমি পোড়াইয়া ফ্যালবো। মাংসপোড়া গন্ধ। মাগো বাঁচাও। আরমানের আর্তচিৎকারে চারিদিক কাঁপে।
রাজশেখর মাস্টার বলে ওঠে- রজব, যত পারো আমারে শাস্তি দাও। কিন্তু নির্দোষ বাচ্চাটাকে ছেড়ে দাও।
-না স্যার। (রজবকে উদ্দেশ্য করে) তুই আমারে মাইরা ফ্যাল। আমার স্যাররে মারিস না। বীভস হাসি রজবের। রাজশেখরের কান ধরে একটানা থাপড়াতে থাকে।
-তোর মাইয়া কোহানে? তারে আইনা দে। রাজশেখর মাস্টার বাকুরুদ্ধ। বেদম প্রহার চলে। মুখ থেকে গলগল করে রক্ত বেরোয়।
-চাড়াল তুই মাস্টার নামের কলঙ্ক। পোলাপানরে দেশপ্রেম শিখাস?
আরমানকে চুলের মুঠি ধরে টেনে তোলে- আমার কথা শুনলে তুই ছাড়া পাবি। তোর মুক্তির একটাই শর্ত- এই মাস্টাররে তোর নিজের হাতে পিটাইতে হইবে।
একটা বাঁশের লাঠি আরমানের সদ্য পোড়া হাতের মধ্যে গুজে দেয়। ল মার, মার চাড়ালরে মার। নির্দয় প্রহারে আরমান প্রায় অর্ধমৃত। যন্ত্রণাক্লিষ্ট হাতে শক্ত করে লাঠিটাকে ধরে বসে। আচমকাই রজব আলীর মাথায় প্রচণ্ড বাড়ি মারে। রজব আলী লুটিয়ে পড়ে। অন্যরা একযোগে হাতে হাতবাঁধা শিক্ষক-ছাত্রের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। চলে কিল, ঘুষি। শেষমেশ বুকের উপর লাফিয়ে উল্লাস করে চলে।
পরদিন নদীর উজান মোহনায় ভেসে ওঠে ছাত্র-শিক্ষকের হাতে হাতবাঁধা লাশ।
আজকালের খবর/আরইউ