
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ইতিহাসে বাংলাদেশ আজ এক অবিস্মরণীয় নাম। বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনা, পুনর্গঠন এবং মানবিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা আজ অপরিহার্য হিসেবে অবস্থান করছেন। বৈশ্বিক রাজনীতির টানাপোড়েন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং প্রতিকূল জলবায়ু উপেক্ষা করে লাল-সবুজের পতাকাবাহীরা যে বীরত্ব দেখাচ্ছেন, তা আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপন।
১৯৪৮ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রম শুরু হলেও এই গৌরবের মঞ্চে বাংলাদেশের অভিষেক ঘটে ১৯৮৮ সালে। ইরান-ইরাক সামরিক পর্যবেক্ষক মিশনে মাত্র ১৫ জন সদস্য পাঠানোর মধ্য দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, আজ তা মহীরুহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের ১১৯টি দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ দীর্ঘ দিন ধরে শীর্ষস্থান ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থান ধরে রেখেছে। বর্তমানে বিশ্বের ১০টি দেশে 'নীল হেলমেট' মাথায় দিয়ে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা শান্তির পতাকা বহন করছেন।
শান্তি রক্ষা কোনো সাধারণ দায়িত্ব নয়; এটি এক চরম আত্মত্যাগ। যখন বিশ্ব সংঘাত ও অস্থিরতায় টালমাটাল, তখন বাংলাদেশের বীর সন্তানরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে নীল হেলমেট মাথায় দিয়ে শান্তির পতাকা উড়িয়ে চলেছেন।
কিন্তু এই শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ কখনো কখনো হয়ে ওঠে রক্তে রঞ্জিত। ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, শনিবার বিকেলের সেই বিষাদময় মুহূর্তটি আবারও প্রমাণ করল যে, বিশ্বশান্তির জন্য বাংলাদেশ তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করে না। সুদানের তপ্ত মরুভূমিতে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ড্রোন হামলায় শহীদ হওয়া ছয় শান্তিরক্ষীর রক্ত আমাদের জাতীয় পতাকার লাল বৃত্তকে যেন আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। এটি কেবল এক শোকগাথা নয়, বরং বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের অদম্য অঙ্গীকারের এক অনন্য দলিল।
সুদানের অ্যাবেই এলাকায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের (UNISFA) আওতাধীন কাদুগলি লজিস্টিক বেসে গত ১৩ ডিসেম্বর স্থানীয় সময় বিকেল ৩টা ৪০ মিনিট থেকে ৩টা ৫০ মিনিটের মধ্যে এক কাপুরুষোচিত হামলা চালায় একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী। আকস্মিক এই ড্রোন হামলায় দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় শাহাদাতবরণ করেন বাংলাদেশের ছয়জন অকুতোভয় শান্তিরক্ষী। তারা হলেন—কর্পোরাল মো. মাসুদ রানা (নাটোর), সৈনিক মো. মমিনুল ইসলাম (কুড়িগ্রাম), সৈনিক শামীম রেজা (রাজবাড়ী), সৈনিক শান্ত মন্ডল (কুড়িগ্রাম), মেস ওয়েটার মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (কিশোরগঞ্জ) এবং লন্ড্রি কর্মচারী মো. সবুজ মিয়া (গাইবান্ধা)।
এই নৃশংস হামলায় আরও আটজন শান্তিরক্ষী আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট কর্নেল খোন্দকার খালেকুজ্জামান, সার্জেন্ট মো. মোস্তাকিম হোসেন এবং কর্পোরাল আফরোজা পারভিন ইতিসহ আরও কয়েকজন বীর সদস্য রয়েছেন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, গুরুতর আহত সৈনিক মো. মেজবাউল কবিরের সফল অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হয়েছে এবং বাকি আহতরা বর্তমানে শঙ্কামুক্ত ও উন্নত চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এই জঘন্য হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেছে, শহীদদের এই আত্মত্যাগ আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এই শোক কেবল নিহতদের পরিবারের নয়, বরং এটি পুরো জাতির—যারা শান্তির জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিতেও কুণ্ঠিত নয়।
এসময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কেবল দায়িত্ব পালন করেনি, বরং খাদের কিনারা থেকে মানবতাকে রক্ষা করেছে।
রুয়ান্ডা (১৯৯৪): যখন গণহত্যার ভয়াবহতায় অনেক দেশ তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নিচ্ছিল, তখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অসীম সাহসে সেখানে অবস্থান করে হাজার হাজার মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে।
বসনিয়া (১৯৯৫): বসনিয়ার বিহাচ শহরে ইউরোপীয় সেনারা যখন ব্যর্থ হয়েছিল, তখন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা হালকা অস্ত্র নিয়ে অকুতোভয় বীরত্বে গণহত্যা রুখে দিয়েছিল।
সোমালিয়া: বাংলাদেশি সেনাদের পেশাদারিত্বে মুগ্ধ হয়ে মার্কিন সেনারাও তাদের সাথে কাজ করার বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেছিল।
বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা কেবল অস্ত্রধারী সৈন্য নন, তারা মানবতার সৈনিক। তারা কঙ্গো, সুদান, মালি ও দক্ষিণ সুদানে স্কুল, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট নির্মাণ এবং কৃষি উন্নয়নে সরাসরি ভূমিকা রাখছেন।
বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের মানবিক আচরণের কারণেই পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সিয়েরা লিওন 'বাংলা' ভাষাকে তাদের অন্যতম শ্রদ্ধার ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এটি বিশ্বমঞ্চে আমাদের ভাষার এক অনন্য বিজয়।
শান্তির এই পথ রক্তে ভেজা। এ পর্যন্ত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ১৬৮ জন বীর শান্তিরক্ষী জীবন উৎসর্গ করেছেন। এর মধ্যে সেনাবাহিনীর ১৩১ জন, নৌবাহিনীর ৪ জন, বিমানবাহিনীর ৬ জন এবং পুলিশের ২৪ জন সদস্য রয়েছেন। এছাড়া আহত হয়েছেন ২৭২ জন। সুদানে সর্বশেষ ছয় জন সেনার শাহাদাতবরণ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, বিশ্বশান্তির জন্য বাংলাদেশ কতটা চড়া মূল্য দিতে প্রস্তুত।
মুসলিম প্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই প্রথম ২০১০ সালে শান্তিরক্ষা মিশনে নারী পুলিশের দল পাঠিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল।
এ পর্যন্ত ১,৭১৮ জন নারী শান্তিরক্ষী বিভিন্ন মিশনে অংশ নিয়েছেন। জাতিসংঘ যেখানে নারী শান্তিরক্ষীর হার ২২ শতাংশ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে, বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ১৮-১৯ শতাংশ নিশ্চিত করেছে। বর্তমানে কঙ্গো ও দক্ষিণ সুদানে আমাদের নারী পুলিশ ও সেনা সদস্যরা অত্যন্ত সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন।
১৯৮৯ সালে নামিবিয়া মিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশের পদযাত্রা শুরু হয়। এ পর্যন্ত ২৪টি দেশের ২৬টি মিশনে ২১,৮১৫ জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে কঙ্গো ও দক্ষিণ সুদানসহ তিনটি দেশে ১৯৯ জন পুলিশ সদস্য নিয়োজিত আছেন। পাশাপাশি বাংলাদেশের চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরাও তাদের মেধা দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রশংসা কুড়াচ্ছেন।
শান্তিরক্ষী মিশন কেবল আমাদের সামরিক মর্যাদা বাড়ায়নি, বরং জাতীয় অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখছে। এই খাত থেকে বার্ষিক আয় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় শক্তি জোগায়। জাতিসংঘ বাংলাদেশের এই ভূমিকাকে 'শান্তির কূটনীতির মোরসাল' হিসেবে অভিহিত করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়ে ল্যাক্রয় বাংলাদেশের এই অবদানের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান-এর সুদূরপ্রসারী নেতৃত্বে বর্তমানে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সামরিক কূটনীতি আরও শক্তিশালী হয়েছে। প্রথম বারের মতো ডিআর কঙ্গোতে সেনাবাহিনীর তিনটি হেলিকপ্টার মোতায়েন করা আমাদের সক্ষমতার নতুন স্মারক। এমনকি অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যদেরও এই মিশনে যুক্ত করার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
শেষে বলতে চাই; বিশ্বের সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আনা, পুনর্গঠন এবং মানবিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা আজ এক অপরিহার্য নাম।
বৈশ্বিক রাজনীতির টানাপোড়েন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং প্রতিকূল জলবায়ু উপেক্ষা করে লাল-সবুজের পতাকাবাহীরা যে বীরত্ব দেখাচ্ছেন, তা আমাদের জাতীয় ভাবমূর্তির শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞাপন। শহীদের রক্তে ভেজা এই গৌরবগাঁথা কেবল সেনাবাহিনীর নয়, বরং সমগ্র বাংলাদেশের এক অবিনশ্বর অহংকার।
লেখক: সাংবাদিক, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
আজকালের খবর/ এমকে