
১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। দীর্ঘ দুই দশকেরও বেশি সময় পরে প্রশ্নটি এখনও অমীমাংসিত- এই চুক্তি কি সত্যিই পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে? এর উত্তর খুঁজতে হলে চুক্তির অর্জনের পাশাপাশি অপূর্ণতা, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং পরিবর্তিত নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় নিতে হবে।
প্রথমত, স্বীকার করতে হবে যে, শান্তিচুক্তি পাহাড়ে সশস্ত্র সংঘাতের যুগের দৃশ্যত অবসান ঘটিয়েছে। পাহাড়ি এলাকা ছিল রাষ্ট্র ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর দীর্ঘমেয়াদি সহিংস সংঘর্ষের কেন্দ্রস্থল। চুক্তি সেই সহিংসতার সরাসরি চাপ কমিয়ে সাধারণ মানুষের জন্য এক ধরনের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়। প্রশাসন, উন্নয়ন সংস্থা ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি বাড়ে; সামাজিক-অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডও ধীরে ধীরে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এটি ছিল চুক্তির অন্যতম বড় দিক।
কিন্তু প্রশ্ন হলো- এই শান্তি কি পর্যাপ্ত? বাস্তবতা বলছে, পাহাড়ে সহিংসতার ধরণ পাল্টেছে, কিন্তু নিরাপত্তাহীনতা কমেনি। চুক্তির পরবর্তী সময়ে আঞ্চলিক রাজনীতিতে জেএসএস এবং ইউপিডিএফের বিরোধ, দলভিত্তিক সশস্ত্র আধিপত্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ নতুন করে সংঘাতের জন্ম দেয়। ফলে পাহাড়ের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া বারবার ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয়ত, শান্তিচুক্তির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল এবং এখনও আছে- সেটা হলো বাস্তবায়নের ধীরগতি। ভূমি কমিশন অকার্যকর, আঞ্চলিক পরিষদকে পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান-এসব প্রতিশ্রুতির অনেকই আজও আংশিক বা অসম্পূর্ণ। বিশেষ করে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি না থাকায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা সংকট বাড়ছে। সরকারের দৃষ্টিতে নিরাপত্তাজনিত কিছু বাধা বাস্তবায়নকে জটিল করেছে, কিন্তু স্থানীয়দের মতে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতিই মূল সমস্যা।
তৃতীয়ত, উন্নয়ন প্রশ্নে একটি স্থায়ী বিভাজন রয়ে গেছে। সরকার পার্বত্য এলাকায় অবকাঠামো, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যে অগ্রগতি দেখাচ্ছে- তা নিঃসন্দেহে বড় সাফল্য। কিন্তু পাহাড়ি জনগোষ্ঠী উন্নয়ন পরিকল্পনায় যথেষ্ট অংশগ্রহণ করতে না পারার অভিযোগ তোলে। উন্নয়ন যদি ‘উপর থেকে চাপানো’ হয়, তবে শান্তিচুক্তির অন্তর্ভুক্তিমূলক চরিত্র দুর্বল হয়- এমন মত বহু গবেষকের। ফলে উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু তা কি সমতা ও ন্যায্যতার কাঠামো তৈরি করেছে- এ প্রশ্ন রয়ে গেছে।
চতুর্থত, পাহাড়ি এলাকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি চুক্তির ভবিষ্যৎকে আরও জটিল করে তুলেছে। একদিকে দলীয় বিভাজন, অন্যদিকে ‘করিডর কন্ট্রোল’ কেন্দ্রিক সংঘর্ষ- এসব কারণে স্থানীয় মানুষের নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। সশস্ত্র গ্রুপগুলোর আধিপত্য চুক্তির মূল উদ্দেশ্য- রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে স্থায়ী শান্তি- তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। রাষ্ট্রও তাই অনেক ক্ষেত্রে ‘নিরাপত্তা-প্রথম’ নীতি অনুসরণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
পঞ্চমত, রাষ্ট্রের সঙ্গে জনগোষ্ঠীর সম্পর্কও এখনও পুরোপুরি আস্থার জায়গায় পৌঁছায়নি। সরকার মনে করে চুক্তির বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে; কিন্তু পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর বৃহৎ অংশ মনে করে তাদের মৌলিক অধিকার, বিশেষ করে ভূমি ও প্রশাসনিক ক্ষমতায় অংশগ্রহণ যথেষ্ট সুরক্ষিত হয়নি। এই দৃষ্টিভঙ্গির সংঘাত শান্তিচুক্তিকে একটি ‘অসম্পূর্ণ যাত্রা’ হিসেবে তুলে ধরে।
সব মিলিয়ে বলা যায়, শান্তিচুক্তি পাহাড়ে সহিংসতা কিছুটা কমালেও, স্থায়ী ও কাঠামোগত শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। এখন সময় এসেছে সেই শান্তিকে পূর্ণতা দেয়ার জন্য রাষ্ট্র, সমাজ এবং স্থানীয় নেতৃত্বের সমন্বিত প্রচেষ্টা নতুন করে শুরু করার।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আজকালের খবর/বিএস