
বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া সবসময়ই উত্তেজনাপূর্ণ, কিন্তু এ বছর পরিস্থিতি বিশেষভাবে চ্যালেঞ্জিং। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়েছে, আর দেশের রাজনৈতিক দলগুলো এরইমধ্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। কোনো কোনো দল প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে, প্রার্থীরা মাঠে নেমেছেন এবং জনমতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার চেষ্টা করছেন। এই সময়েই শরীফ ওসমান হাদির ওপর সশস্ত্র হামলার ঘটনা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি করেছে। এমন পরিস্থিতি দেখা দেয়ার পরও দেশের নির্বাচন আয়োজনের বিকল্প নেই; দীর্ঘদিন ধরে মানুষ সুষ্ঠু নির্বাচনের অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিল, এখন তারা ভোট দিতে মুখিয়ে আছে।
বাংলাদেশে ভোটের অধিকার শুধু একটি সাংবিধানিক অধিকার নয়; এটি জনগণের রাজনৈতিক শক্তি এবং গণতন্ত্রকে দৃঢ় রাখার মূল স্তম্ভ। বিগত নির্বাচনগুলোতে সহিংসতা, হুমকি, নিরুৎসাহ, ভোটাধিকার হরণের মতো ঘটনা মানুষকে স্বাভাবিকভাবে নিরুৎসাহিত করেছে। কিন্তু বর্তমানে জনগণ ভোট দিতে চায় এবং তারা একটি জনবান্ধব নির্বাচন চাইছে। জনবান্ধব নির্বাচন মানে- নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং নিরাপদ ভোটের পরিবেশ। এই পরিবেশ তৈরি করা শুধু রাজনৈতিক নেতৃত্বের দায়িত্ব নয়; দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীর ওপরও এ ক্ষেত্রে বিশেষ দায়িত্ব অর্পিত।
সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা বাংলাদেশে নির্বাচনকে স্থিতিশীল ও নিরাপদ রাখার ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। যখনই সেনাবাহিনী নিরপেক্ষভাবে মাঠে উপস্থিত হয়েছে, তখন ভোটের পরিবেশ জনবান্ধব হয়ে উঠেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, অতীতের কিছু নির্বাচন যেখানে সেনাবাহিনী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেছে, সেই নির্বাচনগুলোতে জনগণ নিরাপদে ভোট দিতে সক্ষম হয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বীরা মাঠে স্বাচ্ছন্দ্যে অংশগ্রহণ করেছেন এবং ফলাফল গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
তবে, শুধু উপস্থিতি যথেষ্ট নয়। সশস্ত্র বাহিনীকে নির্বাচনী পরিবেশে সক্রিয়, দৃঢ় এবং নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখতে হবে। জনগণ দেখতে চায়, সেনাবাহিনী কেবল মাঠে দাঁড়িয়ে নয়; বরং তারা প্রতিটি ভোট কেন্দ্র, প্রতিটি এলাকার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সক্ষম। এই দায়িত্ব পালন করতে গেলে সেনাবাহিনীকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি, পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি এবং মানবসম্পদ সবকিছুই ঠিকভাবে ব্যবহার করতে হবে।
বর্তমানে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেও নিখুঁত নয়। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ধরনের সহিংস ঘটনা ঘটছে, যার মধ্যে অন্যতম হল শরীফ ওসমান হাদির ওপর হামলা। এমন ঘটনা শুধু আইন-শৃঙ্খলার জন্যই নয়, নির্বাচনের জন্যও ভয়ঙ্কর সংকেত বহন করে। যদি এই ধরনের ঘটনা অব্যাহত থাকে, তবে জনগণ নির্বাচনকে নিরাপদ মনে করবে না, প্রার্থীরা মাঠে নামতে সাহস হারাবেন এবং পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
এই ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিরাপত্তা প্রদানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকা নয়। তাদের কাজ হচ্ছে নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ ও জনবান্ধব পরিবেশে আনা। জনগণ চাইছে যে, ভোটের দিনগুলোতে কোনো প্রার্থী বা দলের প্রভাব বা সহিংসতার কারণে তাদের ভোটাধিকার ক্ষুণ্ণ হবে না। তারা চাইছে, নির্বাচন কেন্দ্রে স্বচ্ছতা বজায় থাকবে, প্রতিটি ভোট গণনা হবে সঠিকভাবে এবং নির্বাচনের ফলাফল গ্রহণযোগ্য হবে।
তথ্য অনুযায়ী, সেনাবাহিনী এরইমধ্যে নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ হিসেবে মাঠে রয়েছে। তবে মাঝেমধ্যেই কিছু উদ্বেগজনক দুর্ঘটনা ঘটছে। এটি বোঝায়, শুধু উপস্থিতি যথেষ্ট নয়; কৌশলগত, পরিকল্পিত এবং মনিটরিং-ভিত্তিক ভূমিকা প্রয়োজন।
সেনাবাহিনীকে নিশ্চিত করতে হবে যে, প্রতিটি এলাকা, প্রতিটি ভোট কেন্দ্র নিরাপদ এবং নির্বাচনী কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চলছে। এছাড়া, তাদের উপস্থিতি এমনভাবে অনুভূত হতে হবে যাতে জনগণ আত্মবিশ্বাসী হয়, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা নিরাপদে কাজ করতে পারেন এবং নির্বাচনের পরিবেশ প্রভাবিত না হয়।
নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কৌশল তৈরি করছে। এটি স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ।
তবে সেই প্রক্রিয়াকে সুষ্ঠু রাখতে হলে দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও সশস্ত্র বাহিনীকে দৃঢ়, নিরপেক্ষ এবং কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। জনগণ মনে রাখতে চায়- যে নির্বাচন তারা অংশগ্রহণ করবে, সেটি সুরক্ষিত, স্বচ্ছ এবং গ্রহণযোগ্য। এখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কেবল রক্ষাকারী নয়, বরং নির্বাচনী পরিবেশের নির্ধারকও বটে।
অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, দেশের মানুষ সেই নির্বাচনকে মূল্যায়ন করে যেখানে সেনাবাহিনী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করেছে। জনগণ সচেতন এবং নির্বাচনের মাধ্যমে নিজের মতামত প্রকাশ করতে চায়। এটি দেশের গণতন্ত্রকে দৃঢ় করে, সরকারের প্রতি বিশ্বাস বাড়ায় এবং রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে কার্যকর রাখে। অতএব, সশস্ত্র বাহিনীকে নির্বাচনকালীন ভূমিকা শুধু রক্ষাকারী হিসেবে নয়, বরং নির্বাচনকে জনবান্ধব ও শান্তিপূর্ণ রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত হতে হবে।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সতর্কতা এবং সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। শুধু সেনাবাহিনী নয়, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সকল স্তরের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব হলো-নির্বাচনী পরিবেশকে সুষ্ঠু ও নিরাপদ রাখার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ নেয়া। প্রার্থীরা যাতে নির্ভয়ে মাঠে অংশ নিতে পারে, জনগণ যাতে স্বাচ্ছন্দ্যে ভোট দিতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা সরকারের এবং সশস্ত্র বাহিনীর মূল দায়িত্ব।
শেষ পর্যন্ত স্পষ্ট হয়ে যায়- নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পর দেশের আইন-শৃঙ্খলা এবং সশস্ত্র বাহিনীর কার্যক্রমের মান নির্ধারণ করবে নির্বাচনের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা। জনগণ চায় একটি নির্বাচন, যেখানে ভোটের অধিকার সুরক্ষিত, প্রতিটি কেন্দ্রে শান্তি বজায় তাকবে এবং নির্বাচনী পরিবেশ হবে জনবান্ধব। এই প্রত্যাশা পূরণ করতে হলে সশস্ত্র বাহিনীকে নিরপেক্ষ, দৃঢ় এবং সক্রিয়ভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা কেবল নির্বাচনের স্বাভাবিকতা নষ্ট করবে না, বরং জনগণের বিশ্বাস ও দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
বাংলাদেশের জনগণ বহু বছর ধরে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে। তারা ভোট দিতে মুখিয়ে আছে। এই পরিবেশকে ধরে রাখতে হলে সরকার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং সশস্ত্র বাহিনীকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। নির্বাচনী পরিবেশকে স্থিতিশীল, স্বচ্ছ এবং জনবান্ধব করা এখন দেশের প্রধান চ্যালেঞ্জ। এবং সেই চ্যালেঞ্জে সশস্ত্র বাহিনীর ভূমিকা হবে কেন্দ্রীয় ও নির্ধারক।
অতএব, জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং দেশের মানুষ তা চাইছে। তবে সেই নির্বাচন যেন জনবান্ধব, নিরাপদ এবং গ্রহণযোগ্য হয়- সেটি নিশ্চিত করার দায়িত্ব কেবল সরকারের নয়, সশস্ত্র বাহিনীরও। দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের অধিকার ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ রক্ষার জন্য এই দায়িত্ব পালন অপরিহার্য।
লেখক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আজকালের খবর/ এমকে