
আমাদের সন্তানদের ভেতরে ঘুমন্ত সেই শিশুকে বা শিশুর ভেতরে সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে তোলেন মানুষ গড়ার কারিগর মহান শিক্ষকমন্ডলী। আর মানুষ গড়ার সেই কারখানা হচ্ছে পাঠশালা বা প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিংবা কোন মক্তব মাদ্রাসা।
একজন মানব শিশুর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জনের হাতেখড়ি শুরু হয় এই পাঠশালা থেকে। আজকের সভ্য দুনিয়ায় যে যতো বড় শিক্ষিত বা জ্ঞানী-গুণীই হোক না কেন, এই পাঠশালা থেকেই শুরু করেছিলেন শিক্ষা বা জ্ঞান অর্জনের দীর্ঘ অভিযাত্রা।
তাই একজন সুশিক্ষিত মানুষের জীবনে শৈশবের স্মৃতি বিজড়িত পাঠশালার স্মৃতিগুলো জীবনের ডাইরিতে এক অনন্য উজ্জ্বল অধ্যায় হয়ে থেকে যায় সারাটি জীবন। আমার জীবনেও এমন এক স্মৃতিময় প্রিয় পাঠশালা নিয়ে কিছু লিখতে আজকের এই ক্ষুদ্র প্রয়াস...।
নেত্রকোনা জেলার অন্যতম উপজেলা, ভাটি বাংলার রাজধানী খ্যাত মোহনগঞ্জ উপজেলা। জেলা সদর থেকে মাত্র ২৮ কি.মি. দূরত্বে অবস্থিত ছোট্ট একটি মফস্বল শহর মোহনগঞ্জ। সড়কপথ, রেলপথ ও বর্ষায় নৌ পথে যাতায়াত ও যোগাযোগ ব্যবস্থা থাকায় এটি নেত্রকোনা জেলার অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
মোহনগঞ্জ পৌর শহরের অভিজাত আবাসিক এলাকা মাইলোড়া গ্রামে বৃক্ষ তরু শোভিত ছায়া সুনিবিড় পরিবেশে অবস্থিত আমার প্রিয় বিদ্যাপীঠ কেষ্ঠ বাবুর পাঠশালা তথা মাইলোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এটি অত্র অঞ্চলের প্রাচীনতম প্রসিদ্ধ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ব্রিটিশ শাসনামলে এলাকার কয়েকজন শিক্ষানূরাগী ও গুণীজন ব্যক্তিত্বের নিরলস প্রচেষ্টায় ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে স্থাপিত হয়েছিল প্রাচীনতম এই পাঠশালা।
বিদ্যালয়ের ভূমিদাতা ও প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন মাইলোড়া চৌধুরী বাড়ির বাবু কেষ্ঠ কুমার সাহা। এলাকায় তিনি কেষ্ঠ মাস্টার নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। তাঁর নামানুসারেই প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকে এ বিদ্যালয়কে স্থানীয় লোকজন কেষ্ঠ বাবুর পাঠশালা বলেই ডাকতো বলে জানান এলাকার প্রবীন মুরুব্বিগণ। তিনি ছিলেন একজন গুণী শিক্ষানূরাগী ও পরহিতৈষী মানুষ।
নিজের জায়গায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে নিজে শ্রম, ঘাম ও মেধা দিয়ে বিদ্যালয়টিকে টিকিয়ে রাখতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি নিজে বিনা বেতনে বিদ্যালয়ে বাচ্চাদের পড়াতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র সংগ্রহ করতেন। তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন। ভূমি দাতা হিসেবে পরবর্তীতে তাঁদের পরিবারের আরও দু’জনের নাম যুক্ত হয়েছে। তাঁরা ছিলেন - মাইলোড়া গ্রামের বিশিষ্ট ব্যাবসায়ী ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব বাবু ধীরেন্দ্র সাহা রায় চৌধুরী ও রামানন্দ সাহা রায়।
মাইলোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এলাকার বিশিষ্ট শিক্ষানূরাগী ও সামাজিক ব্যক্তিত্ব, সাতুর গ্রামের প্রবীণ শিক্ষক প্রয়াত আবুল কাশেম স্যার। তিনি তাঁর কর্মজীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থেকে অবসর নিয়েছিলেন। এই বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদান অনস্বীকার্য।
পরবর্তীকালে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে ১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দে ১লা জুলাই তৎকালীন সরকারের এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বিদ্যালয়টি পূর্ণাঙ্গ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়।
মাইলোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে অদ্যাবদি পর্যন্ত অত্র এলাকায় অবিরতভাবে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে আসছে। এই বিদ্যালয়ের অনেক কৃতী শিক্ষার্থী বর্তমানে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে দায়িত্ব পালন করছেন। এ বিদ্যালয় শুধু লেখা-পড়ায় নয় বরং সাহিত্য ও শিল্প-সংস্কৃতি চর্চাতেও অনন্য ভূমিকা পালন করছে।
সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে প্রতিযোগিতায় স্থানীয়ভাবে সবার সেরা এ বিদ্যালয়। জেলা ও বিভাগীয় পর্যায় অতিক্রম করে সারা দেশে জাতীয় পর্যায়েও একক অভিনয় ও আবৃত্তিতে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তিও আছে এখানকার শিক্ষার্থীদের অর্জনের ঝুলিতে। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে উত্তীর্ণ হয়ে গত বছর (২০২৪) সালে মাইলোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বিভাগীয় পর্যায়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ বিভাগের শ্রেষ্ঠ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের খেতাব অর্জন করেছে। এ অর্জনের মাধ্যমে বিদ্যালয়টি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের অবস্থান সমুন্নত রেখেছেন বিদ্যালয়ের অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী ও শিক্ষার্থীবৃন্দ।
মোহনগঞ্জ পৌর শহরের মাইলোড়া গ্রামে মাত্র (৩৩) তেতত্রিশ শতাংশ জায়গার উপর স্থাপিত মাইলোড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটি দ্বিতল ভবন ও দুটি একতলা পাকা ভবন রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। মূল দ্বিতল ভবনের সামনে রয়েছে এক চিলতে বাগান ও ছোট্ট একটা মাঠ। বাগানে নানান জাতের ফল ও ফুলের গাছ প্রাকৃতিক শোভা বাড়িয়েছে বিদ্যালয়ের। এছাড়াও বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রয়েছে বিভিন্ন ফলজ ও বনজ বৃক্ষের সমাহার। রয়েছে একটি সুন্দর ছাদ বাগান। সেখানে রয়েছে নানান জাতের সবজি, ফুল ও ফলের গাছ।
দ্বিতল ভবনের নিচ তলায় রয়েছে প্রধান শিক্ষকের কার্যালয়, শিক্ষক মিলনায়তন ও একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরি। লাইব্রেরিতে রয়েছে অনেক মূল্যবান ও সমৃদ্ধ মানের বইয়ের সমাহার। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এখান থেকে বই পড়ার ব্যবস্থা রয়েছে। ভবনের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে সু সজ্জিত শ্রেণি কক্ষ। প্রতিটি শ্রেণি কক্ষ সু পরিসর ও পর্যাপ্ত আলো বাতাসের সুব্যবস্থা রয়েছে।
সামনের একতলা ভবনটি পুরোটাই শ্রেণি কক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। শ্রেণি কক্ষগুলো সু সজ্জিত ও সু প্রশস্ত। পাশের তৃতীয় ভবনে দুটো শ্রেণি কক্ষ শুধুমাত্র প্রাক প্রাথমিকের ছোট্ট সোনা মণিদের জন্যে ব্যবহার করা হয়। এখানে বাচ্চাদের জন্যে রয়েছে বিভিন্ন বিনোদন ও খেলা-ধুলার সামগ্রী। যাতে বাচ্চারা স্কুলে এসে একঘেয়ে অনুভব না করে লেখা পড়াার পাশাপাশি খেলাধূলা ও আনন্দ অনুভব করতে পারে। খেলার ছলে বাচ্চাদের লেখা-পড়া ও স্কুলের প্রতি আগ্রহ তৈরিতে এই কৌশল কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
স্কুলের সামনে ছোট্ট মাঠটিতে শিক্ষার্থীরা শরীর চর্চা ও খেলা-ধূলা করে। শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে বিশুদ্ধ পানীয় জলের ব্যবস্থা ও ছেলে মেয়েদের জন্যে আলাদা ওয়াশরুম। শিক্ষার্থীদের জন্যে এখানে আছে শরীর চর্চা ও বিনোদনের কিছু সরঞ্জাম। বিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীরের ভেতরে প্রধান ফটকের পাশে একটি টিনশেড তৈরি করা হয়েছে, যাতে মর্নিং শিফটে বাচ্চাদের নিয়ে আসা অভিভাবকগণ বসে বিশ্রাম নিতে পারেন বা অপেক্ষা করেন।
এ বিদ্যালয়ে প্রায় ছয়শত (৬০০) শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষার্থীদের সংখ্যাধিখ্যের কারণে বিদ্যালয়টিতে দুই শিফটে পাঠদান পদ্ধতি চালু করা হয়।
মর্নিং শিফটে সকাল নয়টা থেকে বারোটা পর্যন্ত প্রাক প্রাথমিক থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং বারোটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পাঠদান চলে। অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলী অত্যন্ত যত্ন সহকারে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেন। শিক্ষকমণ্ডলী নিরলস প্রচেষ্টা ও দক্ষতার সহিত পাঠ্যসূচির বাইরে চিত্রাঙ্কন, সঙ্গীত ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক বিষয়ে শিক্ষাদান করে শিক্ষার্থীদের মনন ও মেধা বিকাশে সহায়তা করেন। প্রধান শিক্ষকের উদ্যোগে অভিভাবকদের পরামর্শ ও আর্থিক সহযোগিতায় শিক্ষার্থীদের চিত্রাঙ্কন শিখানোর উদ্দেশ্যে দু'জন চিত্রশিল্পীকে চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তারা সপ্তাহে দুই দিন বাচ্চাদের চিত্রাঙ্কন ক্লাস নিয়ে থাকেন।
বর্তমানে এ বিদ্যালয়ে মোট ১১ এগার জন শিক্ষক ও একজন অফিস সহায়ক কাম দপ্তরী কর্মরত রয়েছেন। বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সংখ্যাধিক্য ও উপস্থিতি, সার্বিক ফলাফল ও অন্যান্য দিক বিবেচনায় বিদ্যালয়ের মাঠের জায়গা অপর্যাপ্ত। শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারিরীক বিকাশে ভূমিকা রাখতে পারে এমন একটি আদর্শ খেলার মাঠ অপরিহার্য, যা এ বিদ্যালয়ের একটি অপূর্ণতা।
আমরা আশা করছি, যথাযথ কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে হয়তো এ অপূর্ণতা দূর করা সম্ভব। স্থানীয় সচেতন অভিভাবক মহল ও যথাযথ কর্তৃপক্ষের দক্ষ পরিচালনায় বিদ্যালয়ের অগ্রগতির এ ধারা অব্যাহত থাকুক আজীবন। এভাবেই জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়ুক সর্বত্র।
লেখক :
সুমন মাহমুদ শেখ
কবি ও প্রাবন্ধিক
মোহনগঞ্জ, নেত্রকোনা।
আজকালের খবর/ এমকে