
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে অনলাইন জুয়া বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ক্রিকেটের আসর আইপিএল ও বিপিএল (বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ) চলাকালে তা আরও বেড়ে যায়। পাশাপাশি শোবিজ অঙ্গনের তারকারাও অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া গেছে।
গত বছরের ডিসেম্বর-ফেব্রুয়ারির বিপিএলের পাশাপাশি ওই সময় আইপিএলে একই প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, গুগলে বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বিজ্ঞাপন চলছে অবাধে। বাংলাদেশের শীর্ষ তারকারা অর্থের বিনিময়ে এসব বিজ্ঞাপনের প্রচারণায় অংশ নিচ্ছেন। এতে সমাজে বাজে বার্তা যাচ্ছে। তরুনরা কৌতুহলী হয়ে উঠছে। এ অবস্থার উত্তরণে অবশেষে অনলাইন জুয়া, জালিয়াতি ও প্রতারণার ক্ষেত্রে অপরাধী ব্যক্তি দুই বছরের কারাদণ্ড বা এককোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এমন বিধান রেখে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫ জারি করেছে। তথ্য অধিদপ্তর থেকে সদ্য জারি হওয়া এক তথ্যবিবরণী প্রকাশে এ তথ্য জানা গেছে।
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে- কোন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, কোম্পানি বা অন্য কোন সংস্থা সাইবার স্পেসে জুয়া খেলার নিমিত্ত কোন পোর্টাল বা অ্যাপস্ বা ডিভাইস তৈরি করেন বা পরিচালনা করেন বা জুয়া খেলায় অংশগ্রহণ করেন বা খেলায় সহায়তা বা উৎসাহ প্রদান করেন বা উৎসাহ প্রদানের জন্য বিজ্ঞাপনে, অনলাইনে, ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার টিকটকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অংশগ্রহণ এবং প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রচার বা বিজ্ঞাপিত করেন তাহলে তা দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে।
সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ-২০২৫ এর ধারা ২০ অনুযায়ী বর্ণিত অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে অনধিক দুই বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। এছাড়া, অনলাইন জুয়া বন্ধে প্রয়োজনীয় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য হাইকোর্ট বিভাগের নির্দেশনা রয়েছে।
জুয়া খেলায় সহায়তা বা উৎসাহ প্রদান বা উৎসাহ প্রদানের জন্য বিজ্ঞাপনে অংশগ্রহণ এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রচার বা বিজ্ঞাপিত করা থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে এবং অপরাধ দমন ও সাইবার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে অনলাইন জুয়ার সকল গেটওয়ে, অ্যাপ্লিকেশন, লিংক, ওয়েবসাইট এবং বিজ্ঞাপন জনস্বার্থে জরুরিভিত্তিতে বন্ধ, ব্লক বা অপসারণের জন্য সংশ্লিষ্ট সকল ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে অবহিত করা হচ্ছে।
সাকিব-বুবলী-পিয়া-অপুসহ তারকাদের অনলাইন জুয়ার অবাধ প্রচারণা-
মডেল পিয়া বিপিএলের গত বিপিএল আসরে অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন। এ ছাড়া আইপিএলের আসরেও তিনি অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়েছিলেন। পিয়ার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ঘেঁটে দেখা যায়, তিনি চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ‘বাবু ৮৮’ ও ‘ভাগ্য’ নামের দুটি অনলাইন জুয়ার প্রতিষ্ঠানের ১২টি প্রচারণা চালিয়েছেন।
চিত্রনায়িকা শবনম বুবলী নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে চলতি বছর ‘মেগা ক্রিকেট ওয়ার্ল্ড’ নামের একটি জুয়ার প্রতিষ্ঠানের তিনটি বিজ্ঞাপন প্রচার করেছেন। এ ব্যাপারে চলতি বছরে গণমাধ্যমে বেশ হইচই পড়েছিলো।
অভিনয়শিল্পী সামিরা খান মাহি নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে চলতি বছর ‘বাবু ৮৮’ নামের জুয়ার দুটি প্রচারণা চালিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছিলো গত এপ্রিলে।
এ ছাড়া অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া, অপু বিশ্বাস, মাহিয়া মাহিসহ দেশের শীর্ষ অনেক তারকা বিভিন্ন সময় অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালিয়েছেন বলে খবর প্রকাশ পায়।
ক্রিকেট ঘিরে অনলাইন জুয়ার প্রচার-প্রচারণায় ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের নাম একাধিকবার এসেছে। ১ কোটি ৬০ লাখ অনুসারী থাকা নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে গত ২২ মার্চ সাকিব ‘ওয়ানএক্সবেট’ নামের অনলাইন জুয়ার প্রচারণা চালান। এর আগে ২০২২ সালে ‘বেটউইনার’ নামের একটি অনলাইন জুয়ার প্রতিষ্ঠানের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বেটউইনার নিউজের শুভেচ্ছাদূত হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন তিনি।
এ ছাড়া ভারতে বেটিং অ্যাপ (অনলাইনে বাজি ধরার অ্যাপ) কেলেঙ্কারির তদন্তে সাকিবের বোন জান্নাতুল হাসানের নাম আসে। গত বছরের মার্চে ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়, ‘১১ উইকেটডটকম’ নামের একটি বেটিং অ্যাপে সাকিবের বোন বিনিয়োগ করেছেন।
অনলাইন জুয়ার বাজার কত টাকার-
বাংলাদেশে অনলাইন জুয়ার বাজার কত টাকার, তার সঠিক হিসাব নেই। তবে দেশের কত মানুষ অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত, তার একটি আনুমানিক হিসাব গত বছরের ২৪ জুন দিয়েছিলেন তৎকালীন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক। তখন তিনি বলেছিলেন, দেশের প্রায় ৫০ লাখ মানুষ অনলাইন জুয়ার সঙ্গে জড়িত।
অন্যদিকে গত বছরের ২০ জুন ভারতের সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডেতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটিতে অবৈধ অনলাইন বাজির বাজার বছরে ১০০ বিলিয়ন ডলারের মতো অর্থ সংগ্রহ করে।
২০২৪ সালের ১৩ মে ভারতের সংবাদমাধ্যম মিন্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির পাবলিক গ্যাম্বলিং অ্যাক্ট ১৮৬৭ অনুযায়ী জুয়া নিষিদ্ধ। তারপরও দেশটিতে অনলাইনে জুয়ার প্রচারণাসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ড থেমে নেই। ভারতে জুয়ার বাজার বছরে তিন বিলিয়ন ডলারের সমান হবে। বিশ্বে অনলাইন গেমিং বাজারে চীনের পরে রয়েছে ভারত। আইপিএল ও নির্বাচনের সময় ভারতে অনলাইন জুয়ার প্রসার ঘটে।
তথ্যব্যবস্থায় প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে বাংলাদেশি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ডিজিটালি রাইট লিমিটেডের (ডিআরএল) তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ ডিসমিসল্যাবের অনলাইনে জুয়ার বিজ্ঞাপন ও প্রচারণা নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন আছে।
জুয়ার বিজ্ঞাপন দেখা যায়, এমন ওয়েবসাইট ব্লকের নির্দেশ-
২০২৪ সালের এপ্রিলে ‘নীতি লঙ্ঘন: বাংলাদেশিদের লক্ষ্য করে মেটার প্ল্যাটফর্মে হাজার হাজার জুয়ার বিজ্ঞাপন’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেসবুকের মূল এই প্রতিষ্ঠানের (মেটা) প্ল্যাটফর্মগুলোয় বছরে জুয়ার বিজ্ঞাপনে ব্যয় আনুমানিক ১৫ কোটি টাকা। তবে প্রকৃত ব্যয় আরও বেশি হতে পারে।
অনলাইন জুয়ার উৎস হিসেবে ক্রিকেট-সংশ্লিষ্ট জুয়ার প্রতিষ্ঠানের ভারতীয় নাম দেখে সেগুলোকে সে দেশ থেকে আসা বলে মনে হয়। বিশেষ করে তাদের ক্রিকেটের অন্যতম বড় আসর আইপিএলের সময়ে অনলাইন জুয়া বেড়ে যায়। তবে জুয়ার সাইট বা অ্যাপ ভারত ছাড়া অন্য দেশেও হোস্ট করা থাকতে পারে।
শক্ত আইন ও তদারকি নেই-
ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের প্রসারে জুয়া খেলার ধরন পাল্টে গেছে। এখন অনলাইন জুয়ার বেশির ভাগই মুঠোফোনে খেলা হয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও অনলাইন জুয়ার বড় বাজার গড়ে উঠছে।
আজকালের খবর/আতে