মাধ্যমিক শিক্ষার নয়টি উপ-পরিচালকের (মাধ্যমিক) কার্যালয় গ্রাস করে নিচ্ছে পরিচালক কলেজ। গত ১০ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখার একটি পত্র অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এই পত্রের আলোকে পরিচালকের (কলেজ) কার্যালয় ও উপ-পরিচালকের (মাধ্যমিক) কার্যালয়- এই দুইটি কার্যালয়ের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা করা হয় পরিচালককে (কলেজ)। এতে ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা একটি কার্যালয়ের ক্ষমতা খর্ব করা হলো।
The Bangladesh Civil Service (Reorganization) Order 1980 ‘The Bangladesh Civil Service (Education: General education) Compositions and Cadre Rules, 1980‘ The Bangladesh Civil Service Recruitment Rules, 1981 School and Inspections Branch- বিধিমালা অনুযায়ী বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের তিনটি শাখার মধ্যে বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখা অন্যতম। বিসিএস নিয়োগ বিধিমালা ১৯৮১ অনুযায়ী বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখার সর্বোচ্চ পদ হলো উপপরিচালক (আঞ্চলিক অফিস)। পদ সৃষ্টির পর থেকে উক্ত কার্যালয়ের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা আঞ্চলিক উপ-পরিচালক। তাদের অধীনে জেলা শিক্ষা অফিস ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ভিন্ন ভিন্ন সময়ে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সংযুক্ত আদেশের মাধ্যমে নির্ধারিত আছে।
ব্রিটিশ আমল থেকেই মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের আঞ্চলিক অফিস হিসেবে ও প্রতিনিধিত্বকারী অধীনস্ত অফিস হিসেবে আঞ্চলিক উপ-পরিচালকের কার্যালয় সুপ্রতিষ্ঠিত। যে অফিসের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হলেন আঞ্চলিক উপ-পরিচালক।
২০১৬ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এমপিও কাজ মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে দেশের নয়টি আঞ্চলিক কার্যালয়কে দেওয়ার মাধ্যমে কাজের বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়। সেই কারণে কলেজের এমপিওর কাজের জন্য সেসিপের অধীনে আঞ্চলিক পর্যায়ে পরিচালক, উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালক পদ সৃষ্টি করে কলেজ থেকে ডেপুটেশনে পদায়ন এবং একটি সহকারী পরিচালক পদে সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষককে পদায়ন করা হয়। সেই থেকে অঞ্চলে আলাদাভাবে দুটি অফিস চালু আছে। যথা- ১. পরিচালক (সেসিপ) তার জনবল নিয়ে কলেজ স্তরের কাজ করেন এবং তিনি এই কার্যালয়ের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন।
২. আঞ্চলিক উপ-পরিচালক তার জনবল নিয়ে স্বতন্ত্রভাবে মাধ্যমিক স্তরের কাজ করছেন। তিনি এই কার্যালয়ের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু বর্তমানে দুটি স্বতন্ত্র অফিসের ডিডিও একজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এটি সরকারের বিকেন্দ্রীকরণ নীতির পরিপন্থী। এটি বিধিসম্মত নয়। এটি বাস্তবায়ন হলে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন এবং শিক্ষা প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে।
‘The Bangladesh Civil Service (Education: General education) Compositions and Cadre Rules, 1980’ অনুযায়ী ষষ্ঠ গ্রেড পর্যন্ত কলেজ শাখা এবং বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখার পদগুলো আলাদা আলাদা থাকবে। পঞ্চম গ্রেড থেকে পদগুলো ইউনিফাইড ক্যাডার হবে যেখানে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পদায়ন হবে। সুতরাং নতুন সৃষ্ট পরিচালক পদে কোন শাখা থেকে পদায়ন বা পদোন্নতির মাধ্যমে নিয়োগ লাভ করবে তা নির্ধারিত হবে ১৯৮১-এর বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখার সংশোধনীর পর। বিধিতে অন্তর্ভুক্তি না করে দুইটি কার্যালয়ের আয়ন-ব্যয়ন কর্মকর্তা একজনকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ নেই। বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের রায়ে ও নির্দেশনায় কোনো কার্যালয়-এর জনবল কাঠামো ও বিধিতে প্রদত্ত বিদ্যমান ক্ষমতা, প্রচলিত সুযোগ সুবিধা কমিয়ে কোনো বিধি প্রণয়নের সুযোগ নেই।
গত ১০ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখার একটি পত্র অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। যেখানে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন নয়টি আঞ্চলিক মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অফিসের ডিডিও আইডি পরিবর্তন করে আঞ্চলিক পরিচালককে দেওয়ার জন্য। এ কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পত্রটি বাতিল করে উপ-পরিচালকের (মাধ্যমিক) আয়ন- ব্যয়ন ক্ষমতা পুনর্বহালের আবেদন করেছে বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতি। এ ছাড়া এই বিষয়ে মাউশি উপ-পরিচালক ও নয়টি অঞ্চলের উপ-পরিচালকরা আলাদা আবেদন জমা দিয়েছেন।
২৬ জুন ২০২৩ তারিখের জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি পত্রের মাধ্যমে সেসিপের তিনটি পদ রেভিনিউতে নিয়ে কলেজ থেকে তিনজনকে পদায়ন করা হয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সম্মতিক্রমে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ও জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমির (নায়েম) শিক্ষা কাঠামোতে যে নতুন পদ সৃজন করা হয়েছে তা বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার হতে নিয়োগযোগ্য এবং এতে বিসিএস নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮১-এর বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) বিধিমালা সংশোধনের শর্তারোপ করা হয়েছে। কিন্তু পদটি এখন পর্যন্ত বিসিএস নিয়োগ বিধিমালা, ১৯৮১-এর বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) বিধিমালাতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। পদ সৃজনের শর্ত পূরণ না করে বিধি বহির্ভূত পদে পদায়নকৃত পরিচালকে তার নিজের কার্যালয়ের আয়ন-ব্যয়ন ক্ষমতার পাশাপাশি স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান উপ-পরিচালক (মাধ্যমিক) কার্যালয়ের আয়ন-ব্যয়ন ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যার কারণে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকরা ক্ষোভে ফুসছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ডিডিও আইডি পরিবর্তন করে আঞ্চলিক পরিচালককে দেওয়ার জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে পত্র পাঠানোর পর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে কোনো আদেশ জারি করার পূর্বেই বিভিন্ন আঞ্চলিক পরিচালক এজি অফিসে যোগাযোগ করে অবৈধোভাবে ডিডিও আইডি নিয়ে নেন। এত উপ-পরিচালক কার্যালয়ের অর্থ সংশ্লিষ্ট সকল কার্যক্রম আটকে যায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে মাধ্যমিক স্তর সকল ক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। যার সর্বশেষ উদাহরণ উপ-পরিচালক (মাধ্যমিক) কার্যালয়ের আয়ন-ব্যয়ন ক্ষমতা পরিচালককে (কলেজ) দেওয়া। এখন আমাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এখন আলাদা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো বিকল্প নেই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক সিনিয়র শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক বলেন, মাধ্যমিক শিক্ষকদের জন্য এন্ট্রি পদ নবম গ্রেড ধরে একটি চার স্তরের পদসোপান, টাইমস্কেল সিলেকশন গ্রেড, এডভান্স ইনক্রিমেন্ট, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার পদে সিনিয়র শিক্ষকদের পদায়ন ইত্যাদি সমস্যায় দীর্ঘদিন ধরে ভুগছে সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষকরা। এই বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নেই মাউশি কর্মকর্তাদের। নতুন করে যুক্ত হয়েছে উপ-পরিচালক (মাধ্যমিক) কার্যালয়ের আয়ন-ব্যয়ন ক্ষমতা পরিচালককে (কলেজ) দেওয়া এবং প্রকল্প থেকে স্থানান্তরিত উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের জেলা শিক্ষা অফিসে পদায়নের অপচেষ্টা। জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ ও জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী মাধ্যমিক শিক্ষার জন্য আলাদা অধিদপ্তর এখন সময়ের দাবি।
নানাবিধ বঞ্চনার ফলে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মাঝে ব্যাপক অসন্তোষ ও ক্ষোভ পরিলক্ষিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পর হতে এ পর্যন্ত যতগুলো শিক্ষা কমিশন, শিক্ষার রিপোর্ট, শিক্ষা আইন দেশে প্রণয়ন করা হয়েছে তার সবকটিতেই মাধ্যমিকের জন্য আলাদা অধিদপ্তরের বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে বলা থাকা সত্ত্বেও এ পর্যন্ত স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর করা হয়নি। অথচ অনেক পূর্বেই প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর আলাদ করা হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে শিক্ষা খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর মাধ্যমিক স্তরের জন্য স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর করা হচ্ছে না। যার ফলে নানা ধরনের বঞ্চনা আর বিশৃঙ্খলায় জর্জরিত মাধ্যমিক শিক্ষা স্তর। নেই কোনো সঠিক নিয়োগ বিধিমালা, নেই যৌক্তিক পদসোপান। দেশের সাত শতাধিক সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে তিন শতাধিক প্রধান শিক্ষক, পাঁচ শতাধিক সহকারী প্রধান শিক্ষকের পদ শূন্য, প্রায় সকল জেলায় জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও সহকারী জেলা শিক্ষা কর্মকর্তার পদ শূন্য। দেশে ২৬ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঝে ২২ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক স্তরের। অথচ শিক্ষাভবনে বিশাল মাধ্যমিক স্তরের জন্য মাত্র তিনজন মাধ্যমিক স্তরের কর্মকর্তা আছেন। যার মধ্যে একজন উপ-পরিচালক ও দুইজন সহকারী পরিচালক। শিক্ষা ভবনে মাধ্যমিকের কর্মকর্তা কর্মচারী সংকটে মুখ থুবড়ে পড়েছে মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসন ব্যবস্থা। শিক্ষাস্তরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও আধুনিকীকরণের মাধ্যমে বিশ্বমানের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অধিদপ্তর আলাদা করার কোনো বিকল্প নেই।
অধ্যাপক তানভীর হাসান: শিক্ষক নেতা।
আজকালের খবর/আরইউ