পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক সূচকেই এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। বিশ্বের খুব কম দেশই এ সাফল্য দেখাতে পেরেছে। ফলে বর্তমান বিশ্বে বাংলাদেশ এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অতি দারিদ্র পরিস্থিতির বেশ উন্নতি হয়েছে। দেশে হতদরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। দশ বছরের ব্যবধানে প্রায় ১ কোটি হতদরিদ্র লোক অতি দারিদ্রসীমার ওপরে উঠেছে। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে অতি দারিদ্র হার কমেছে। এই প্রবণতাকে বাংলাদেশের একটি বড় অর্জন হিসেবে মনে করা হয়। মূলত শিক্ষাক্ষেত্রে লিঙ্গসমতা ও সফল পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচী বাস্তবায়ন এ দেশের দারিদ্র বিমোচনে বড় ধরনের সহায়তা করেছে। কয়েক বছর ধরে সরকারের নেওয়া সমন্বিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কারণে এ সাফল্য এসেছে। সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্রের আওতায় নেওয়া কর্মসূচি ব্যাপকভাবে বাড়িয়েছে সরকার। পাশাপাশি সারা দেশে সড়ক নেটওয়ার্কের ব্যাপক উন্নয়ন হয়েছে। গ্রাম-উপজেলা-জেলাসহ সব ক্ষেত্রে সড়ক অবকাঠামোর ব্যাপক উন্নতি হওয়ায় এর সুফল পাচ্ছে সাধারণ জনগণ।
এখন গ্রামের সাধারণ কৃষক তার উৎপাদিত পণ্য খুব সহজে শহরে আনতে পারছে। এসব কারনে বাংলাদেশে অতি দারিদ্র্য অনেকটাই কমে আসছে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও এসব কর্মসূচি ভূমিকা রাখছে। বাংলাদেশের দারিদ্র কমার প্রধান কারণ, এদেশের মানুষের আয় সক্ষমতা বেড়েছে। বাংলাদেশের মানুষ একসময় দারিদ্রের করালগ্রাসে নিমজ্জিত ছিল, একথা সত্যি। তবে তখন নানা প্রতিবন্ধকতা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রশাসনিক দ্বিধাবিভক্তি, দায়সারা মনোভাব, নেতৃত্বের দৃঢ়তা ও দূরদর্শিতার অভাব, ভুল সিদ্ধান্ত, জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কর্মকাণ্ডের অশুভ তৎপরতা প্রভৃতি বাংলাদেশকে উন্নয়নের পথে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে বারবার বাধাগ্রস্ত করেছে। তবে এখন আগের সেই অবস্থা নেই। ৫ আগস্ট ২০২৪ স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সম্পূর্ণ এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দেশের শাসনকার্য পরিচালনা করছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিদ্যমান আর্থসামাজিক ও পরিবর্তিত এই প্রেক্ষাপটে দেশের শাসনকার্য পরিচালনায় নতুন নতুন অনেক কিছু উন্মোচিত হচ্ছে। স্বৈরাচারী দুঃশাসন দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করে দিয়েছে। দেশের তরুণ প্রজন্ম দেশ নিয়ে একটি নতুন স্বপ্ন দেখেছে। যে স্বপ্ন একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে। তারা এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখছে, যেখানে দেশের আপামর মানুষ তাদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা তাদের জাতিগত পরিচয় নির্বিশেষে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে। সরকার গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার, মানবাধিকার ও বাকস্বাধীনতা সমুন্নত রাখবে। তারা এমন একটি সমাজ ও জাতি চায়, যেখানে সবার জন্য সমান সুযোগ থাকবে। এই প্রজন্ম একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, যেখানে জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে।
আমরা অনেকেই ভাবতে শুরু করেছিলাম, আমাদের জীবদ্দশায় দেশ দুঃশাসনমুক্ত হবে না। দেশ ১৬ বছরের দীর্ঘ স্বৈরাচার, অপশাসন ও নির্যাতন থেকে রাহুমুক্ত হয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে নানা আন্দোলন-সংগ্রাম হলেও তা হালে পানি পায়নি। ছাত্রদের আন্দোলনের সাফল্যের প্রধান কারণ তিনটি। এক. আগের অন্য আন্দোলন-সংগ্রামগুলোর লক্ষ্য ছিল একটি স্থিতাবস্থার পরিবর্তে আরেকটি বিকল্প স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যাতে সবকিছুই আগের মতো থাকবে। কেবল নাটকের কুশীলব পরিবর্তন হবে, নতুন রাজা-রানি, যুবরাজ, পাইক-পেয়াদা দই-মাখন খাবে। শোষণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, ঘুষ, দুর্নীতি ও অপশাসন যথারীতি অব্যাহত থাকবে। এর বিপরীতে ছাত্রদের আন্দোলনের লক্ষ্য ছিলÑখোলনলচে বদলে ফেলা, শোষণ, নির্যাতনমুক্ত গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। আন্দোলনে নেতৃত্বদান ও অংশগ্রহণকারী জেনারেশন জেড বলে অভিহিত ছাত্ররা ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, কোটাবিরোধী আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে ২০২৪ সালের আন্দোলনে উদ্ভাবনী কৌশল প্রয়োগ করেছিলেন এবং জনগণ তাতে সাড়া দিয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক দলের আন্দোলনগুলো ছিল গতানুগতিক। এই প্রজন্ম একটি শোষণমুক্ত, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভোর, যেখানে জনগণের প্রতিবাদের ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার থাকবে। লুণ্ঠন, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছাড়াও গত ১৬ বছরের অপশাসনের সবচেয়ে বড় ক্ষতি হলো বিচার বিভাগ, সংসদীয় ব্যবস্থা, সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন, সাংবাদিকতাসহ সব প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে, অবাধ দুর্নীতির সুযোগের বিনিময়ে এ গুলোয় পদলেহী ও আজ্ঞাবহ দুর্বৃত্তদের শীর্ষ পদে নিয়োগ প্রদান। তাই এখন একটি বড় কাজ হবে, এসব জঞ্জাল অপসারণ ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান নির্মাণ।
১৬ বছরের দীর্ঘ স্বৈরাচার বিদায় হওয়ার পর দিনে দিনে আমাদের উন্নয়নের এবং সমৃদ্ধির গতিপথ বদলাচ্ছে। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে উঠেছে আরো আগেই। এ দেশের মানুষের প্রাণশক্তি অনেক বেশি, তারাই অর্থনীতির চালিকাশক্তি সার্বিক দারিদ্র বিমোচনে এনজিও, সুশীল সমাজের ভূমিকাও আছে। অর্থনৈতিক উন্নতির কারনেই চরম দরিদ্রের সংখ্যা কমেছে। এতো সমৃদ্ধির ও উন্নয়নের পরে দেশে এখনও প্রায় দুই কোটি মানুষ চরম দরিদ্র। সংখ্যার দিক থেকে এটি অনেক বেশি। বাংলাদেশ থেকে দারিদ্র বিদায় নিয়েছে, তেমন দাবি করার সময় আসতে আরো অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে। দারিদ্র সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে-এটা ভাবলে হবেনা। তবে দারিদ্রের চেহারাও বদলেছে। নগর দারিদ্র বেড়েছে, যা নতুন এক চ্যালেঞ্জ। এ ছাড়া বৈষম্যও জোরালো হয়েছে। স্বাধীনতার ৫৪ বছরেরও বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে পারেনি। বঞ্চণা, নিপীড়ন, বৈষম্য,অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতার বেড়াজালে আজও বন্দী দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে আমরা ১৯৭১ এ বিজয় অর্জনের পর যাত্রা শুরু করেছিলাম স্বাধীন বাংলাদেশে। কিন্তু এই ২০২৫ এ এসে আমাদের সবার মনে প্রশ্ন, এখনও কি আমরা যথার্থভাবে স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছি? ১৯৭১ থেকে ২০২৫। ৫৪ বছর পূর্তি হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার। সময় হিসেবে এটা কম নয়। আমরা মহান স্বাধীনতা দিবস এলেই জাতীয় স্মৃতিসৌধে যাই, স্বাধীনতার বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা দল বেঁধে শোভাযাত্রা নিয়ে নানা রঙের ব্যানার নিয়ে নানা শ্লোগানে মুখরিত হয়ে ভিড় জমায়। নেতা-নেত্রী, বুদ্ধিজীবি, সরকার প্রধান থেকে শুরু করে মন্ত্রী, উপদেষ্টামন্ডলীর সদস্যরা মহান মহান বুলি আওড়াই। স্বাধীনতার এতো বছর পরও ঘরে ঘরে স্বাধীনতার সুফল আজও কেন পৌঁছালো না, এজন্য সবাইকে মিলে মিশে কাজ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার জন্য কাজ করে যেতে হবে ইত্যাদি, ইত্যাদি। সেই কবে থেকেই প্রতি বছর মহান স্বাধীনতা দিবস এলেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখছি। কিন্তু আমাদের অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে আজ বলতে হচ্ছে, আসলেই কি স্বাধীনতা অর্থবহ হয়ে উঠেছে দেশের আপামর জনসাধারণের জন্য, সবার ঘরে ঘরে কি স্বাধীনতার সুফল পৌঁছেছে? যে বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তোলার স্বপ্ন নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এদেশের সাধারণ ছাত্র জনতা, কৃষক-শ্রমিক-জেলে-মজুর, পুরুষ-নারী, কিশোর, সেই বৈষম্যহীন, শোষণমুক্ত বাংলাদেশ কি আজও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে?
একটি কথা বিশেষভাবে মানতেই হবে যে, নিচের দিকে থাকা দেশের ৪০ শতাংশ মানুষ যদি প্রবৃদ্ধির সুফল পায়, তবে তা দারিদ্র বিমোচনে বেশি কার্যকর হয়। বাংলাদেশে এ জনগোষ্ঠীর মাথাপিছু ভোক্তা প্রবৃদ্ধির হার জাতীয় ভোক্তা প্রবৃদ্ধির হারের চেয়ে দশমিক ৪৩ শতাংশীয় পয়েন্ট বেশি। যদিও এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ আশেপাশের দেশ পাকিস্তান, ভারত ও ভুটানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে। তবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে আছে। একটি বিষয় সবাইকে লক্ষ্য রাখতে হবে, তা হলো কোনো দেশের অর্থনীতি কীভাবে বাড়ছে, এর ওপর দারিদ্র হার কমার বিষয়টি নির্ভর করে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়, গরিব মানুষ যদি এর সুফল বেশি পায়, তাহলে সেই দেশের দারিদ্র দ্রুত হ্রাস পাবে। কাক্সিক্ষত পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। সামাজিক-অর্থনৈতিক নানা সূচকে একের পর এক উঠে আসছে তারই স্বীকৃতি। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ১৯৭১ এ বাংলাদেশ পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল, বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে বিশ্ব মানচিত্রে ঠাঁই পেয়েছিল। সেই স্বাধীনতার প্রধান কথাই ছিল চরম বৈষম্যের শিকার তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশে দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্রমুক্ত এক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানে দারিদ্র ছিলনা বললেই চলে। আর এখানে অতি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল ৬০ শতাংশের বেশি। শুধু অর্থবিত্ত নয়, শিক্ষায়, কর্মসংস্থানে কিংবা মর্যাদায়ও পাকিস্তানের এই অংশের মানুষ ছিল চরমভাবে বঞ্চিত ও উপেক্ষিত। অত্যন্ত অমানবিক উপায়ে শাসন শোষন নিষ্পেষন চালানো হচ্ছিল এদেশের মানুষের ওপর। এখন সেই পাকিস্তান আমাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়ছে। আগামীতে আরো পিছিয়ে পড়বে ধারণা করা যায় তাদের সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায়। আজ আমাদের উচ্ছ্বাসের বিষয় হলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আজ কথা বলতে শুরু করেছে, স্বাধীনতার যথার্থতা নানা সূচকে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠছে। স্বাধীনতা ক্রমেই তার অর্থ খুঁজে পাচ্ছে। আজ অনেকটা সগৌরবে বলা যায়, মাঝখানে দীর্ঘ একটা সময় দেশ স্বৈরাচারী দুঃশাসনের বেড়াজালে বন্দী ছিল, সেই সময়টাতে দেশ নানাভাবে হোঁচট খেলেও দেশ এখন আবার স্বাধীনতার কাংখিত পথ ধরেই এগিয়ে চলেছে। আমরা দেশের ১৮ কোটি মানুষ এক মনে কামনা করি, বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক এবং অতিদারিদ্র, ক্ষুধা, অপুষ্টি, চিরতরে নির্বাসিত হোক এই প্রিয় ভুখণ্ড থেকে।
জুলাই অভ্যুত্থানে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষ যেসব কারণে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন, তার মধ্যে অন্যতম হলো নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি। নতুন অন্তর্র্বতীকালীন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পরেও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। কাজেই এ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্র্বর্তী সরকারের কাছে দেশের সাধারণ মানুষের অন্যতম প্রত্যাশা হলো নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু অন্তর্র্বর্তী সরকারের দুই মাস পার হলেও নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে তেমন সফলতা দেখা যাচ্ছে না। উল্টো চাল, ভোজ্যতেল, ডিম, মুরগি, চিনি ইত্যাদি পণ্যের মূল্য আরও বেড়েছে। যেকোনো রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণ ও অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটি গিয়ে পড়ে সমাজের প্রান্তিক ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপরে। গত বছরের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের এক বছর পর এসে বেসামাল অর্থনীতিকে অনেকটা লাইনে আনা গেলেও দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যায়নি। অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা থেকে বাদ পড়েছেন অনেক মানুষ। সিন্ডিকেটের কাছে অসহায় কৃষকেরা একের পর এক ফসলে লোকসান গুনছেন। ঋণগ্রস্ত মানুষের আত্মহত্যার ঘটনা এই আর্থসামাজিক বাস্তবতার বাইরের কিছু নয়। গত এক সপ্তাহে রাজশাহীর পবায় স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার পর স্বামীর আত্মহত্যা এবং মোহনপুরে পানচাষির আত্মহত্যার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন না হয়ে পারি না। কেননা এ দুটিকে আমরা বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলতে পারি না। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ফসলে ন্যায্য দাম না পেয়ে ও ঋণগ্রস্ত কৃষকের আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো নাগরিকের অপমৃত্যু ঠেকাতে সরকারের দিক থেকে যে ধরনের জোরালো উদ্যোগ থাকা দরকার, সেটা একেবারেই অনুপস্থিত। ১৬ আগস্ট পবা উপজেলার বামনশিখর গ্রামের কৃষক মিনারুল ইসলাম স্ত্রী ও দুই সন্তানকে হত্যার পর নিজেও আত্মহত্যা করেছেন। ঘরে পাওয়া চিরকুটে লেখা ছিল, ‘ঋণের দায়ে আর খাওয়ার অভাবে আমরা মরে গেলাম।’ অন্যদিকে মোহনপুর উপজেলার ধুরইল গ্রামে ১৮ আগস্ট আকবর হোসেন নামের এক কৃষক ঋণের চাপ ও পান চাষে লোকসানের কারণে আত্মহত্যা করেছেন। আমরা দেখছি যে দুটি ক্ষেত্রেই দারিদ্র্য আর ঋণের চাপ আত্মহত্যা ও স্বজন হত্যার মতো মর্মান্তিক পথ বেছে নেওয়ার অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। প্রতিবেশীরা জানিয়েছেন, মিনারুল অভাব লুকিয়ে রাখতেন, কাউকে কিছু বলতেন না। সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দিতে না পারার যন্ত্রণা শেষ পর্যন্ত তাকে এমন ভয়াবহ পথে ঠেলে দেয়। অন্যদিকে আকবর প্রমাণ করলেন, আমাদের কৃষকদের এখনো কতটা অনিশ্চয়তা ও সুবিধাহীনতার মধ্যে বাস করতে হয়। একদিকে তিনি ১৩টি এনজিওর পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়েছিলেন, অন্যদিকে পান চাষ করে কাক্সিক্ষত দাম না পাওয়ায় লোকসান গুনছিলেন। প্রশ্ন হচ্ছে, কৃষকেরা কেন তাদের উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য পাবেন না। কৃষকদের সুরক্ষা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ করা জরুরি। এ ভূমির কৃষক-প্রজাদের দীর্ঘ লড়াইয়ে কয়েক দশক আগে যে মহাজনি প্রথার উচ্ছেদ হয়েছিল, সে ব্যবস্থা কেন আবার নতুন করে ফিরে আসবে? কৃষকেরা যাতে সহজ শর্তে ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ পেতে পারেন, সে সংস্কার করাটাও জরুরি। সরকারকে অবশ্যই সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে। সরকারকে অবশ্যই কৃষকের পাশে দাঁড়াতে হবে।
মূল্যস্ফীতি এখন বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা। মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের জন্য একটি বড় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারে জিনিসপত্রের দাম লাগামছাড়া। মানুষের আয় বাড়ছে না, কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েই চলেছে। বাজার সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকছে না। কখনো ডিম, কখনো পেঁয়াজ, আলু, সবজি কিংবা কখনো মাছ-মুরগির দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ভোক্তাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের বাজারের হাল দেখে এটিই স্পষ্ট হয় যে বাজারের ওপর কারো কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সাধারণ মানুষের আয় বাড়েনি, কিন্তু বাজারে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে একেকটি নিত্যপণ্যের দাম। সব শ্রেণি-পেশার মানুষই নিত্যপণ্যের লাগামহীন দামে দিশাহারা। কোনো কোনো পণ্যের দাম মাসের ব্যবধানে ১০০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। বাংলাদেশের বাজার ব্যবস্থাপনা মোটেই সংগঠিত নয়। এর সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কোনো কোনো সময় বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেও পণ্যের দাম বাড়ানো হয়। বাংলাদেশের উন্নয়ন অভিযাত্রায় এখন বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা দিয়েছে মূল্যস্ফীতি। মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয় বেড়েছে। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তের জীবনে বেশ চাপ সৃষ্টি করছে। দেশের বাজারে নিত্যপণ্যের দাম না কমাকে দুশ্চিন্তার কারণ হিসেবেই দেখতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত সরকারের যেসব বিভাগ ও সংস্থা রয়েছে, তাদের কার্যক্রম নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানকে আরো দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যেন বাজারকে অস্থির করতে না পারে সেদিকে কঠোর নজরদারি রাখতে হবে। আমদানি ঠিক রেখে সরবরাহ চেইন সচল রাখার মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ ও বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর তাদের সীমিত জনবল নিয়ে বাজারে অভিযান পরিচালনা করছে, কিন্তু এই অভিযানেরও বাজারে কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না। বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে দৃশ্যমান ব্যবস্থা নিতে হবে।
রেজাউল করিম খোকন: অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক।
আজকালের খবর/আরইউ