শতবর্ষে কবর কবিতা; চিরায়ত আবেগ আর বেদনা মিশ্রিত প্রকাশ
অলোক আচার্য
প্রকাশ: শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৫, ৬:৩৩ পিএম
‘ওইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে, ত্রিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে’- কবিতার লাইন দুটি জসীম উদ্দীনের বিখ্যাত কবর কবিতার প্রথম দু’চরণ। সুদীর্ঘ ও আবেবিগক এ কবিতা এত সুপরিচিত যে নতুন করে এর পরিচয় দেবার প্রয়োজন পরে না। এই কবিতাটির একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ঠিক যে ব্যথিত হৃদয়ের ভাবাবেগে কবিতাটি শুরু হয়েছে ঠিক ততখানি ভাবাবেগেই শেষ হয়েছে। পুরো কবিতাটি একটি পারিবারিক ট্র্যাজিক, পরিবারের সদস্যদের হারানোর ব্যাকুলতা, মানব জীবনের গুরুত্বপূর্ণ উপলদ্ধি এবং শোক প্রকাশের মাধ্যমে এগিয়েছে। জসীম উদ্দীন পল্লী গাঁয়ের কবি হিসেবেই সর্বাধিক পরিচিত। মূলত এই শব্দটি দ্বারা কবির কবিত্ব শক্তিকে আবদ্ধ রাখার চেষ্টা হয়েছে বলেই মনে হয়। বিখ্যাত কবিতা কবর ১৯২৫ সালে কল্লোল পত্রিকার তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। কবিতাটি কবির ‘রাখালী’ কাব্যে স্থান পেয়েছিল। জানা যায়, ‘কবর’ কবিতাটি প্রকাশিত হলে যাদের মনোযোগ আকর্ষণ করে, তাদের মধ্যে ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ থেকে বোঝা যায় কবর কবিতাটির শক্তি কতখানি। কালের হিসেবে এবছর কবিতাটি শতবর্ষ পার করছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথে ভাষায়, আজি হইতে শতবর্ষ পরে কে তুমি পড়িছ বসে আমার এ কবিতাখানি। এই যে শতবর্ষ পরেও কবিতাটি পাঠকরা পড়ছেন আগ্রহ সহকারে সেখানেই কবির স্বার্থকতা। সেই সাথে কবিতার স্বার্থকতাও বটে। 

কবি ও কবিতা এ তো ভিন্ন কিছু না বরং এক নিবিড় যোগাযোগ, সম্পর্ক এবং আত্নীয়রুপ। কবির কলমে কবিতার শব্দের জন্ম হয়। তারপর এর মধ্য থেকে কিছু কবিতা পায় অমরত্ব। কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী কবিতাটিও শতবর্ষ পার করেছে। দুই কবিতার আবেদন পাঠকদের কাছে তুমুল জনপ্রিয়। কেবল কবিতাই অমর হয়নি বরং অমরত্ব পেয়েছে কবিরাও। দেবতারা যে অমরত্ব পেয়েছিল সমুদ্র মন্থন থেকে উথিত অমৃতের কলস থেকে, কবর বা বিদ্রোহী হলো সেই অমৃত, কবির কলম হলো সেই অমৃতের কলস আর কবি হলেন স্বয়ং দেবতা। কবর কবিতাটির আবেদন ১০০ বছর আগেও যেমন ছিল এখন সেই আবেদন আরো বেড়েছে বৈ কমেনি একটুও। একজন কবির কবি হতে ঠিক কতটি কবিতা লাগে এমন প্রশ্নের উত্তর নিয়ে দ্বিমত থাকলেও মূল কথা হলো কবর কবিতার মতো একটি কবিতা হলেও কবি বেঁচে থাকেন আজন্মকাল এবং কবির কবিতা সাহিত্য ভান্ডারে রত্নরুপ সমুজ্জ্বল থাকে যুগের পর যুগ। কবিতার নিরিখে কবর সেরকমই একটি কবিতা। একটি দীর্ঘ কবিতাও মানুষের মনে গভীর বেদনার সঞ্চার করে কবর তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ মাত্র। ‘কবর’ জসীম উদ্দীন বিরচিত বাংলা সাহিত্যের একটি বহুল পঠিত কবিতা। এটি মাধ্যমিক স্তরের পাঠ্য পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের কবিতাকে একাকী বর্ণনামূলক কবিতার শ্রেণিতে ফেলা যায়। কবিতাটি শোক কবিতা। বাঙালির প্রাণের আবেগ অতি নিবিড়ভাবে মিশে আছে এ শোক-প্রকাশক কবিতাটির প্রতিটি লাইনে। আছে হৃদয় বিদীর্ণ করা অনুভূতির প্রকাশ। আছে আকুতি, হারানোর। কবর কবিতার শুরুটা এভাবে- 

আমরা মানে সাধারণ পাঠকসকল জসীম উদ্দীনকে কেবল পল্লী কবির খোলসে আবদ্ধ রাখতে চাইলেও গবেষকদের মতে তিনি অত্যন্ত আধুনিক কবি। কবর কবিতাটিই তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।  তার আধুনিকমনা চিন্তা-চেতনার বিকাশ কবির সাহিত্যরাশিতেই প্রমাণ মেলে। পল্লী কবির খুব সহজ ব্যাখ্যা হলো এই যে, জসীম উদ্দীনের অধিকাংশ কবিতাতেই উঠে এসেছে পল্লীর কথা। পল্লী মায়ের রুপ সুনিপুণ ও দক্ষতার সাথে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। পল্লী কবির অন্তরে যেন সদা ধ্বনিত হতো পাঁড়া গায়ের কথা। তিনি ছিলেন একজন বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, গীতিকার ও লেখক। তাকে বাংলার প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাঙালি কবি ও বলা হয়ে থাকে এবং তিনি আবহমান বাংলাকে বাঙালির ঐতিহ্য ও প্রবহমানতার লেখায় খুবই কৃতিত্বের সাথে তুলে এনেছেন। কবি জসীম উদ্দীন ১ জানুয়ারি ১৯০৩ সালে ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে মামার বাড়িতে। জন্মের সময় তার নাম রাখা হয় মোহাম্মাদ জসীম উদ্দীন মোল্লা কিন্তু তিনি বেশি পরিচিত পান কবি জসীম উদ্দীন নামে। তার বাবার নাম আনসার উদ্দিন মোল্লা, কবি জসীম উদ্দীনের বাবা পেশায় একজন স্কুল শিক্ষক ছিলেন আর মা আমিনা খাতুন একজন গৃহিনী তিনি প্রথমে ওয়েলফেয়ার স্কুলে এবং পরবর্তীতে  ফরিদপুরে জেলা স্কুলে লেখাপড়া করেছেন। প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯২১ সালে পাশ করেন। জসীম উদ্দীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা থেকে কৃতিত্বের সাথে ১৯২৯ সালে বিএ এবং ১৯৩১ সালে এমএ পাশ করেন। ১৯৩১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত, পূর্ব বঙ্গ গীতিকার একজন সংগ্রাহক এবং তিনি দীনেশচন্দ্র সেনের সাথে লোক সাহিত্য সংগ্রাহক হিসেবে কাজও করেছেন। তিনি লোক সঙ্গীত সংগ্রহ করেছেন যা ১০,০০০ এরও বেশিতার প্রথম প্রকাশিত কাব্য  ‘রাখালী’ গ্রন্থটিও ১৯২৭ সালে ‘কল্লোল’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । ‘রাখালী’ কাব্যে মোট ১৯টি কবিতা রয়েছে। তিনি নিজে পল্লীর রুপে যেমন মুগ্ধ ছিলেন তেমনি কবিতার ভাষায় অন্যকেও তার গ্রামের সৌন্দর্য দেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। জসীম উদ্দীন বাংলার গ্রামীণ জীবনের ভাষ্যকার। তিনি নিপুনভাবে গ্রাম-সমাজ ও গ্রাম-জীবন তার কবিতার ক্যানভাসে চিত্রায়িত করতে পেরেছিলেন। গ্রামজীবনের প্রতিচিত্র নির্মাণের পাশাপাশি তিনি বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও মানববোধকে লালন ও সমৃদ্ধ করেছেন। বাঙালির প্রাণ হলো গ্রামের সাদামাটা পরিবেশ। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যতা, সহজ-সরল মানুষ, অভাব-আবেগ, গায়ের মেঠো পথ, হিজলের বন।  

জসীম উদ্দীন তার আত্মস্মৃতিতে বর্ণনা করেছেন, দীনেশচন্দ্র সেন একদিন এমএ ক্লাসের সাহিত্যের বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘জসীম উদ্দীনের মতো কবির শিক্ষক হতে পারা তার জন্যে বড় গৌরবের বিষয়। শেলি, কিটস, বায়রন, ওয়ার্ডসওয়ার্থ- বিশ্বসাহিত্যের এই মহারথীদের কবিতার চেয়েও জসীম উদ্দীনের কবিতা তাকে বেশি আকৃষ্ট করেছিল’। কবর কবিতাটি প্রকাশের পর থেকেই ছিল তুমুল আলোচনায়। এখনও রয়েছে। এত দীর্ঘ কবিতা আজকাল আর দেখা যায় না। পাঠও হয় না। কিন্তু কবর কবিতাটি আজও ছাত্রছাত্রীরা বেশ আবৃত্তি করে। প্রিয়জনকে হারানোর এত আবেগী কবিতা যা অতি দীর্ঘও বটে এবং আশ্চর্য বিষয় হলো অতি দীর্ঘ হয়েও কিন্তু পাঠকের মনোযোগ ঠিক ধরে রাখতে পেরেছেন একেবারে শেষ পর্যন্ত। এখানেই কবিতার পূর্ণ স্বার্থকতা। ‘কবর’ কবিতায় বৃদ্ধ পিতামহ একমাত্র জীবিত দৌহিত্রকে তার প্রেমময়ী স্ত্রী, উপযুক্ত পুত্র, পুত্রবধূ, আদরের নাতঈ এবং স্নেহের পুত্তলী মেয়ের বিয়োগান্তক বিদায়ের কথা জানাতে গিয়ে এক দুর্বিষহ জীবনের দুঃস্বপ্নকে বর্ণনা করেছেন। এক দুঃসহ বেদনায় তার অস্তিত্বকে বহন করে বেঁচে থাকার শোকময় বোধের গ্লানি তিনি ব্যক্ত করতে চান। আর তাই দিন-রাত মৃত্যু কামনা তার সব ভাবনাকে তাড়িত করে ‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে/অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে’। ‘কবর’ কবিতায় যে বেদনাবিধুর আর্তি ধ্বনিত হয়েছে, তা কেবল গ্রামীণ জনপদের নয়; বরং এ সব সময়ের আধুনিক-অনাধুনিক, উঁচু-নিচু, বালক-বৃদ্ধ সবার। কবিতা যখন মানব মনে ছেয়ে যায় তখন সেই কবিতার আর কোনো নির্দিষ্ট স্থানে আবদ্ধ থাকে না। তখন সেটি হয় সব মানুষের। কবর কবিতাটির ভাবার্থ এতটাই সত্য যে এটি বিশ্বের সব মানুষের এক অমোঘ সত্য। সে কারণেরই বোধ হয় কবর কবিতটি শতবর্ষ পরেও প্রাসঙ্গিক, জনপ্রিয় এবং সুপাঠ্য। 

আজকালের খবর/আরইউ








http://ajkalerkhobor.net/ad/1751440178.gif
সর্বশেষ সংবাদ
কারাগার থেকে হাসপাতালে সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক
সংবিধানের মূলনীতি থেকে আমরা সরে যাচ্ছি: ড. কামাল হোসেন
হাইকোর্টে ২৫ বিচারক নিয়োগ
মুন্সীগঞ্জে পুলিশ ক্যাম্পে সন্ত্রাসী হামলা, ব্যাপক গোলাগুলি
জুলাইয়ের রাজনৈতিক রূপান্তর বিচার ব্যবস্থার ওপরও গভীর প্রভাব ফেলেছে: প্রধান বিচারপতি
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাংবাদিক সমাবেশ হয়রানির নানা ঘটনায় উদ্বেগ
‌‘বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েট পাস দেওয়ার দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা’
রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে প্রধান উপদেষ্টার ৭ প্রস্তাব
কক্সবাজারে নারী পর্যটকের আপত্তিকর ভিডিও ধারণ, টিকটকার গ্রেপ্তার
গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিল, আটক ৩
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft