
মাথা ফাটিয়ে হত্যার হুমকী দেয়া হয়েছে ৭০ বছর বয়স্ক সাংবাদিক আ. ফ. ম. কাউসার এমরানকে। ফেসবুকে তিনটি পোষ্টে হত্যার হুমকী ছাড়াও তার পরিবার নিয়ে লেখা হয় আপত্তিকর কথাবার্তা। তিনি বলেন,এরপর থেকে নিরাপত্তাহীনতায় আছি। ঘর থেকে বের হইনা, মসজিদে যেতেও ভয় লাগে। আরেকজন সাংবাদিক আল মামুন বলেন, নিউজ করলেই মামলার ভয় দেখানো হয়, ট্যাগ লাগানো হয়। আমি কখনও ছাত্রলীগ করিনি কিন্তু আমাকে ছাত্রলীগ নেতা বানিয়ে প্রচার করা হচ্ছে। মামলা,গ্রেফতার আরো নানাভাবে সাংবাদিক নির্যাতনের চিত্র উঠে এসেছে রবিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব আয়োজিত এক সমাবেশে।
সভায় জানানো হয়,ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরের ৮ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা হয়েছে বাঞ্ছারামপুর, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানায়। ওই উপজেলার তেজখালীর একটি ঘটনায় জুলাই অভ্যুত্থানের পর দায়ের হওয়া মামলার আসামি হিসেবে গত এক বছর ধরে ঘরছাড়া দৈনিক সমকালের প্রতিনিধি সজল আহমেদ। অথচ মামলায় উল্লেখিত দিনে সেখানে এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। একইভাবে প্রথম আলোর সরাইল প্রতিনিধি বদর উদ্দিনকেও জড়ানো হয়েছে ঢাকার একটি হত্যা মামলায়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরের অন্তত পাঁচজন সাংবাদিককে অভ্যুত্থান পরবর্তী দায়ের হওয়া বিভিন্ন মামলায় জড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি সরাইলের একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয় গাজী টিভির জেলা প্রতিনিধি জহির রায়হানকে। ঢাকার বিমানবন্দর থানায় মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে, কালের কণ্ঠের জেলা প্রতিনিধি বিশ্বজিত পাল ও যমুনার আখাউড়া প্রতিনিধি মহিউদ্দিন মিশুর বিরুদ্ধে। সংবাদ প্রকাশের জেরে মামলা হয়েছে দেশ রূপান্তরের মাঈনুদ্দিন রুবেলের বিরুদ্ধে। আখাউড়ায় দৈনিক যুগান্তর ও আরটিভির দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে চাঁদাবাজি ও মানহানির মামলা। সাংবাদিকদের মামলায় হয়রানি ও নির্যাতনের এসব ঘটনার প্রেক্ষিতেই প্রেস ক্লাবের আয়োজনে ওই সমাবেশ হয়। এতে নানা সিদ্ধান্ত গ্রহন করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেস ক্লাব সভাপতি জাবেদ রহিম বিজনের সভাপতিত্বে সভায় স্বাগত বক্তৃতা করেন প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মো. বাহারুল ইসলাম মোল্লা।
সভায় বক্তব্য রাখেন- দৈনিক ইত্তেফাকের জেলা প্রতিনিধি মোহাম্মদ আরজু, দৈনিক সংবাদের জেলা প্রতিনিধি মো. সাদেকুর রহমান, দৈনিক ইনকিলাবের জেলা সংবাদদাতা খ. আ. ম. রশিদুল ইসলাম, দৈনিক আমাদের সময়ের নিজস্ব প্রতিবেদক দীপক চৌধুরী বাপ্পী, এটিএন নিউজের পূর্বাঞ্চলীয় ব্যুরো প্রধান পীযূষ কান্তি আচার্য, দৈনিক স্বদেশ প্রতিদিনের নিজস্ব প্রতিবেদক শেখ মো. শহিদুল ইসলাম, বাংলাভিশনের জেলা প্রতিনিধি মো. আশিকুল ইসলাম, বাংলা টিভির জেলা প্রতিনিধি আল আমীন শাহীন, দৈনিক জনতার জেলা প্রতিনিধি তোফাজ্জল হোসেন, চ্যানেল আইয়ের জেলা প্রতিনিধি মনজুরুল আলম, দৈনিক কুরুলিয়ার সম্পাদক মো. ইব্রাহীম খান সাদাত, দৈনিক দিনকালের জেলা প্রতিনিধি নিয়াজ মোহাম্মদ খান বিটু, দৈনিক আমার দেশের জেলা প্রতিনিধি মফিজুর রহমান লিমন, দৈনিক ভোরের কাগজের জেলা প্রতিনিধি সৈয়দ রিয়াজ আহমেদ অপু, মোহনা টিভির জেলা প্রতিনিধি মো. শাহজাদা, মাইটভির জেলা প্রতিনিধি আ. ফ. ম. কাউসার এমরান, দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের জেলা প্রতিনিধি মোশাররফ হোসেন বেলাল, দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি ফরহাদুল ইসলাম পারভেজ, দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি মজিবুর রহমান খান, সময় টিভির ব্যুরো প্রধান উজ্জল চক্রবর্তী, দৈনিক ইস্টার্ণ মিডিয়ার সম্পাদক নজরুল ইসলাম ভূঁইয়া, দৈনিক করতোয়ার জেলা প্রতিনিধি শাহজাহান সাজু, একাত্তর টিভির জেলা প্রতিনিধি জালাল উদ্দিন রুমী, একুশে টিভির জেলা প্রতিনিধি মীর মো. শাহীন, দৈনিক আজকালের খবরের জেলা প্রতিনিধি মোজাম্মেল চৌধুরী, দৈনিক প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শাহাদৎ হোসেন, দি এশিয়ান এজের জেলা প্রতিনিধি আশিকুর রহমান মিঠু, আরটিভির জেলা প্রতিনিধি আজিজুর রহমান পায়েল, দৈনিক একুশে আলোর সম্পাদক সেলিম পারভেজ, দৈনিক কালের কণ্ঠের জেলা প্রতিনিধি বিশ্বজিৎ পাল বাবু, যমুনা টেলিভিশনের নিজস্ব প্রতিবেদক শফিকুল ইসলাম, এটিএন বাংলার জেলা প্রতিনিধি ইসহাক সুমন, দৈনিক নয়াদিগন্তের জেলা প্রতিনিধি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, দেশ টিভির জেলা প্রতিনিধি মেহেদী নূর পরশ, দৈনিক যুগান্তরের জেলা প্রতিনিধি মো. ফজলে রাব্বি, এখন টিভির নিজস্ব প্রতিবেদক আজিজুল সঞ্চয়, নাগরিক টিভির জেলা প্রতিনিধি আবুল হাসনাত মো. রাফি, দৈনিক বাংলাবাজারের জেলা প্রতিনিধি আল মামুন, দৈনিক সংগ্রামের জেলা প্রতিনিধি রোকন উদ্দিন, দৈনিক আজকের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্পাদক মো. আবু নাসের রতন, দীপ্ত টিভির জেলা প্রতিনিধি রিফাত আন নাবিল মোল্লা, ঢাকাপোস্টের জেলা প্রতিনিধি মাজহারুল করিম অভি, দৈনিক দেশ রূপান্তরের জেলা প্রতিনিধি মাইনুদ্দিন রুবেল, দৈনিক আমার সময়ের জেলা প্রতিনিধি আল মামুন, দৈনিক প্রতিদিনের বাংলাদেশের জেলা প্রতিনিধি ইফতেয়ার উদ্দিন রিফাত, চ্যানেল ২৪ এর জেলা প্রতিনিধি প্রকাশ দাস, দি মুসলিম টাইমসের জেলা প্রতিনিধি চয়ন বিশ্বাস, স্টার নিউজের জেলা প্রতিনিধি আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, বৈশাখী টিভির জেলা প্রতিনিধি খোকন মিয়া, চ্যানেল এস এর জেলা প্রতিনিধি মোহাম্মদ সাইফুল, মাইটভির সদর উপজেলা প্রতিনিধি নুরুল আরাফাত, সময় টিভির চিত্রসাংবাদিক হৃদয় পাল, স্টার নিউজের চিত্রসাংবাদিক রিফাত হাসান ও দেশ টিভির চিত্রসাংবাদিক জয় আহমেদ। সমাবেশে মফিজুর রহমান লিমন বলেন, ফেসবুকে সাংবাদিকদের মানহানি করা হচ্ছে।

মোজাম্মেল হক বলেন,পেশাদার সাংবাদিকদের ফ্যাসিস্টের দোসর ট্যাগ দিয়ে হয়রানি মূলক মামলায় জড়ানো হচ্ছে। আখাউড়ার মামলা পুলিশ নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য করেছে। সংবাদ বিপক্ষে গেলে ট্যাগ দেওয়াটা হলো ফ্যাসিবাদী চরিত্র।
ইফতেয়ার উদ্দিন রিফাত বলেন, হত্যা, চাঁদাবাজি ও মাদক মামলার আসামিরা এখানে সাংবাদিক পরিচয়ে নানা অপরাধে লিপ্ত।
পীযূষ কান্তি আচার্য বলেন,ওসি তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি ছাড়া চাঁদাবাজির মামলা করতে পারে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এখন পর্যন্ত যতজন সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে- তারা এসব ঘটনায় কোনোভাবেই জড়িত নয়। হয়রানির উদ্দেশ্যে এসব মামলায় তাদেরকে জড়ানো হয়েছে।
রিফাত আন নাবিল মোল্লা বলেন, স্বাধীনতার পর এই প্রথম সাংবাদিকরা হতাশাগ্রস্ত। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ভুয়া সাংবাদিকরা মানুষের চরিত্র হননে নেমেছে। যাকে-তাকে আওয়ামী দোসর ট্যাগ দিয়ে মানসিক ভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে মূলধারার সকল সাংবাদিকদের সোচ্চার হতে হবে।
আবুল হাসনাত রাফি বলেন, এখন নিউজ করতে গেলে ভয় লাগে। কারও বিরুদ্ধে নিউজ গেলেই ফ্যাসিস্টের দোসর ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। কিছু অপরাধী নিজেদের অপকর্ম ঢাকার জন্য এখন জাতীয়তাবাদী ট্যাগ লাগিয়ে সাংবাদিকতায় নেমেছে। বিগত সরকারের আমলে এদের কখনো দেখা যায়নি।
নিয়াজ মোহাম্মদ খান বিটু বলেন,ভূঁইফোড় সাংবাদিকরা সমাজের কীট। বন্ধুত্ব পুলিশের সাথে করবেন আর তারা আপনার সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাবে, তার সঙ্গে দেখা করতে দেবে না; সেটা হয় না।
শাহাদৎ হোসেন বলেন, ৫ আগস্টের পর থেকে মূলধারার সাংবাদিকদের চরিত্র হনন করছে একটি চক্র। তখনই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারলে আজকের পরিস্থিতি তৈরি হতো না। রোকন উদ্দিন বলেন, রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে সাংবাদিকদের তাল মেলানো যাবে না। সাংবাদিকদের সত্য তথ্য তুলে ধরতে হবে- সেটি যত কঠিনই হোক। উজ্জল চক্রবর্তী বলেন, সাংবাদিকতা করুন, নয়তো রাজনীতি- এই নীতি প্রেস ক্লাবের অন্তর্ভূক্ত সকল সাংবাদিকদের জন্য বাস্তবায়ন জরুরি। শফিকুল ইসলাম বলেন, সাংবাদিকদের দোসর ট্যাগ দিয়ে উদ্দেশ্যেপ্রণোদিত হয়রানি করা হচ্ছে।
মোশারফ হোসেন বেলাল বলেন,সাংবাদিকরা বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে প্রচার করছে আমি এর পিএস, ওর পিএস। সেখানে প্রেস ক্লাব নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করেছে। কার চাকরি কীভাবে খাবে- সেই চেষ্টা চলছে। দীপক চৌধুরী বাপ্পী বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে জিডি করা হয়েছে।
খ আ ম রশিদুল ইসলাম বলেন, প্রেস ক্লাব সৃষ্টির পর থেকে এমন সংকটময় পারিস্থিতি আর আসেনি। স্বাধীনতার পর থেকে সকল প্রশাসন আমাদের সহযোগীতা করত। কিন্তু এখন পুলিশ প্রশাসনের সহযোগীতা আমরা পাচ্ছি না। সাদেকুর রহমান বলেন,নামধারী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে প্রেস ক্লাব সচেষ্ট থাকবে।
মঞ্জুরুল আলম বলেন, সৎ সাংবাদিকতা আর সৎ সাহস থাকলে সাংবাদিকদের কেউ দমাতে পারবে না। মোহাম্মদ আরজু বলেন, সাংবাদিকরা ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এই সময়ে সবার ঐক্যবদ্ধ থাকার বিকল্প নাই।
সভায় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে হওয়া হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। এছাড়াও সভায় ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে মূলধারার সাংবাদিকসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের বিরুদ্ধে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে ব্যক্তিচরিত্র হননসহ চাঁদাবাজিতে জড়িত মোছাব্বির হাসান ওরফে সজীব হাসান, কথিত সাংবাদিক ও ছাত্রলীগ নেতা এনামুল হক আরিফ, সোহেল আহাদ ও তৌহিদুর রহমান খান নিটলসহ আরও কয়েকজনের নাম উঠে আসে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য প্রশাসনের নিকট দাবী জানানো হয়।
আজকালের খবর/ এমকে