
নার্গিস পারভীন। ৭০ ও ৮০ দশকের বেতার ও টেলিভিশনের এক অনন্য জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ছিলেন নার্গিস পারভীন। অসংখ্য কালজয়ী গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি—যে গানগুলো আজও শ্রোতার হৃদয়ে বেঁচে আছে। তাঁর জাদুমাখা সুরেলা কণ্ঠের মূর্ছনায় এক সময় মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকত কোটি দর্শক-শ্রোতা।
নার্গিস পারভীন ১৯৪৭ সালের ১৩ আগষ্ট, কুষ্টিয়ার আড়ুয়াপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মাহতাব উদ্দিন ছিলেন আইনজীবী, বড় ভাই ও বাবা গান করতেন শখের বশে, তাই পরিবারে একটা সাংস্কৃতিক আবহ বিরাজ করত। সেই আবহে তিনিও ঝুঁকে পরেন গানের দিকে, মূলত বড় ভাই ও বাবার অনুপ্রেরণাতেই শৈশব থেকেই সংগীত চর্চার সঙ্গে বেড়ে ওঠেন নার্গিস পারভীন।
১৯৭২ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাষ্টার্স পাস করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই, রাজশাহী বেতার-এ গান করেছেন।
১৯৭২ সালের ৮ অক্টোবর বিয়ে করেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষককে। নার্গিস পারভীন বিসিআইসিতে উচ্চপদে চাকুরি করলেও সঙ্গীতই ছিল তাঁর ধ্যান জ্ঞান সাধনা।
১৯৭৪ সাল থেকে ঢাকা বেতার-এ গান গাওয়া শুরু করেন নার্গিস পারভীন। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তাঁর উত্থান শুরু হয় ৭০ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে। পুরো ৮০ দশক জুড়ে বেতার ও টেলিভিশনে গাওয়া তাঁর গানগুলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করে। কণ্ঠশিল্পী হিসেবে নার্গিস পারভীনও তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন সব ধরণের দর্শক-শ্রোতাদের কাছে।
বেতার-এ তাঁর গান শুনে প্রখ্যাত সুরকার আলম খান, নার্গিস পারভীনকে সুযোগ করে দেন চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার। আলম খান এর সুর ও সঙ্গীতে 'কন্যাবদল' চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক সিঙ্গার হিসেবে অভিষেক হয় নার্গিস পারভীনের।
আবুল বাশার পরিচালিত ‘কন্যাবদল’ চলচ্চিত্রটি মুক্তিপায় ১৯৭৯ সালে। চলচ্চিত্রের প্রথম গানেই তিনি জনপ্রিয়তা পান, প্রশংসিত হন সূধীমহলে।
নার্গিস পারভীন অল্পসংখ্যক চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন। তিনি যেসব চলচ্চিত্রে গান গেয়েছেন তারমধ্যে- কন্যাবদল, ভালো মানুষ, প্রিন্সেস টিনা খান, শাস্তি, সমর্পণ, ভাগ্যবতি, উল্লেখযোগ্য।
এছাড়াও নার্গিস পারভীন, বেতার ও টেলিভিশনের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন চিত্রের জিঙ্গেলেও কন্ঠ দিয়েছিলেন।
নার্গিস পারভীনের গাওয়া কিছু কালজয়ী জনপ্রিয় গান- ভালবাসা দিয়ে মোরে এত সুখ দিয়েছ..., চাই না আর কিছু চাই না..., আমার চোখে রাত্রি থাকুক..., ময়ুর মহলেও আমার মন বসবে না..., মনে আমার এ কোন ভাবনা..., যে আমার হৃদয় করলো চুরি..., চলো না কোথাও নিরিবিলি..., মাধবী রাতে সুনীল মায়া..., অমাবস্যা পূর্ণিমা কোনটা ভালো..., দুটি মন আর দুটি জীবন..., আমার এই আলতা পরা পা... প্রভৃতি।
সত্তর ও আশি দশকে তিনি ছিলেন বাংলা গানের অবিচ্ছেদ্য অংশ—যার কণ্ঠে অনেকেই খুঁজে পেতেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের ছায়া।
এই প্রতিভাবান কণ্ঠশিল্পী তাঁর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তাকে পিছনে ফেলে এক সময় স্বামীর সাথে বিদেশে চলে যান। কয়েক বছর পর আবার দেশে ফিরে আসেন তাঁর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে। দেশে এসে আবারও গানের জগতে মনোনিবেশ করেন। এক পর্যায়ে স্বামীর সাথে তাঁর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। পরবর্তি সময়ে একমাত্র ছেলেটাও বিদেশে চলে যায়। সে সময়টায়, লাখো-কোটি দর্শকশ্রোতার কাঙ্খিত কণ্ঠশিল্পী নার্গিস পারভীন একেবারেই একা হয়ে যান। জীবনভর যিনি, তাঁর বৈচিত্র্যময়-হৃদয়গ্রাহী সুরেলা কন্ঠের মূর্ছনায় মানুষের মন রাঙিয়েছেন, তাঁর নিজের জীবনের রঙ ফ্যাকাসে হয়েছে কখন, তা তিনি নিজেই বুঝতে পারেননি। সুখ-সুরের মূর্ছনায় রাঙাতে পারেননি নিজের জীবন। নব্বই দশকের শেষের দিকে তিনি গানের জগত থেকে একেবারেই দূরে সড়ে যান।
একাকি নিঃসঙ্গ জীবনে শরীরে বাসা বাঁধে মরণব্যধি ক্যানসার। মরণব্যধি ক্যানসারের সাথে লড়াই করতে করতে পরাজয় বরণ করে চিরবিদায় নেন ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬০ বছর। তিনি নেই, কিন্তু তাঁর গাওয়া গান বাংলা সঙ্গীতের আকাশে চিরকাল বেঁচে থাকবে।
আজকালের খবর/আতে