
ঢাকার সরদারদের সরদার, উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম সিনেমা হল ব্যবসায়ী মির্জা কাদেরের সহধর্মীনী বেগম নুরুন্নাহার বিবি (৮৬) না ফেরার দেশে চেলে গেছেন। আজ (শুক্রবার) বিকাল পৌনে চারটায় রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয় বলে নিশ্চিত করেছেন লায়ন গ্রুপের চেয়ারম্যান ও লায়ন সিনেমাসের কর্ণধার মির্জা আব্দুল খালেক।
জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন নুরুন্নাহার বিবি। মাঝে অবস্থার অবনতি হওয়ায় অনেক দিন ধরেই রাজধানীর এভারকেয়ারের আইসিইউতে রাখা হয়। কিন্তু অবস্থার উন্নতি হয়নি। অবশেষ আজ শুক্রবার তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমালেন। মৃত্যুকালে তিনি এক ছেলে মির্জা আব্দুল খালেক, তিন নাতিসহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন রেখে গেছেন।
আজ শুক্রাবর বাদ এশা পুরান ঢাকার ইসলাম খা মসজিদে নামাজে জানাযা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাকে শায়িত করা হবে বলে একমাত্র ছেলে লায়ন সিনেমাসের কর্ণধার মির্জা আব্দুল খালেক জানিয়েছেন।
এদিকে প্রয়াত নুরুন্নাহার বিবির প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেছেন উপমহাদেশের কিংবদন্তী অভিনেত্রী শবনম। তিনি বলেন, যেহেতু আমরা পাশপাশি মহল্লাহর ছিলাম তাই তার মত একজন মহীয়শীর কথা আমরা শুরু থেকেই জানতাম। তিনি খুবই ধার্মিক এবং অতিথি পরায়ন ছিলেন। আমি তার আত্মার শান্তি কামনা করছি। প্রদর্শক সমিতির প্রধান উপদেষ্টা মিয়া আলাউদ্দিন। তিনি নুরুন্নাহার বিবিকে একজন অতিথি পরায়ণ হৃদয় হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, পাকিস্তান শাসনামলে রাজনৈতিক মহলে নুরুন্নাহার বিবির ব্যাপক প্রভাব ছিলো। বিশেষ করে তার অতিথি সেবার কথা তখন ঢাকার ঘরে ঘরে ছড়িয়ে পড়েছিলো। সরদার সাহেবের মৃত্যুর পরও তার এই অতিথিসেবা অব্যাহত ছিলো। তার হাতে তৈরি আচারের স্বাধ গ্রহণ করেছেন একে ফজলুল হক, মওলা ভাসানী, আতাউর রহমান, কফিল উদ্দিন চৌধুরী, বদরোদ্দোজা চৌধুরী, শেখ মজিবুর রহমান প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, মেধাবী, বুদ্ধিমান, সমাজসেবক ও প্রভাবশালী মীর্জা আবদুল কাদের মাত্র ২৫ বছর বয়সেই, ঢাকার তৎকালীন নবাব স্যার সলিমুল্যাহর কাছ থেকে ‘সরদার’ হিসেবে উপাধি পান। ১৯০৫ সালে তিনি ছিলেন পুরো ঢাকার, সব মহল্লার সেরা সরদার। চলচ্চিত্র তথা শিল্প-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, একজন সমাজহিতৈষী গুনী মানুষ মীর্জা আবদুল কাদের সরদার ১৯৬৩ সালের ২৭ আগষ্ট, ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর একমাত্র সন্তান মীর্জা আবদুল খালেক, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও পরিবেশক হিসেবে সুপরিচিত। তাঁর ভাই মীর্জা ফকির মোহাম্মদ, নাট্যচর্চা ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনের সাথে জড়িত ছিলেন। মীর্জা আবদুল কাদের সরদারের চার ভাতিজা- নাজির আহমেদ (পূর্ব পাকিস্তান চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা'র, (পরবর্তীতে বিএফডিসি) প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক ছিলেন), আবু নাসের আহমেদ (ছিলেন পূর্ব বাংলা চলচ্চিত্র সংস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা), হামিদুর রহমান (চিত্রশিল্পী, যিনি শহীদ মিনার নির্মাণ করেন), সাঈদ আহমদ (বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব ও লেখক)। সংস্কৃতিমনা মীর্জা আবদুল কাদের সরদার ঢাকার ইসলামপুরের ‘ডায়মন্ড জুবিলী থিয়েটার’ ক্রয় করে ‘লায়ন থিয়েটার’ নাম দিয়ে নাটক মঞ্চায়ন শুরু করেন প্রথমে। পরে চলচ্চিত্র আবিষ্কারের ফলে, এক সময় নাটকের প্রতি মানুষের আকর্ষণ কমে যায়। মীর্জা আবদুল কাদের সরদার তখন ‘লায়ন থিয়েটার’-এ, চলচ্চিত্র দেখাতে শুরু করেন। আর এভাবেই নাট্যমঞ্চ থেকে ‘লায়ন সিনেমা’ হল প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৭ সালে। ১৯৩১ সালে 'লায়ন সিনেমা' হলে স্থাপন করা হয় সবাকচিত্রের যন্ত্রপাতি। তিরিশের দশকে ‘লায়ন সিনেমা’ হলে যেসব চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হয়েছে সেগুলো হলো- বোম্বাই কি বিল্লি, আলী বাবা আওর চল্লিশ চোর, কিং সলোমন'স মাইনস, স্যামসন এ্যান্ড ডেলিলা, জুলিয়াস সিজার, লা পারওয়া, প্রাণ প্রিয়সী, প্রভৃতি। মীর্জা আবদুল কাদের সরদার একজন চলচ্চিত্র পরিবেশকও ছিলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘টাইগার্স ফিল্মস’।
আজকালের খবর/আতে