১৮ হাজারের বেশি ঘেরে পানি নিষ্কাশনের পথ নেই
ভবদহের তীব্র জলাবদ্ধতায় জনজীবন দুর্বিষহ
মিজানুর রহমান মুন, যশোর
প্রকাশ: সোমবার, ৪ আগস্ট, ২০২৫, ৮:৩০ পিএম
ভবদহ পাড়ের বাসিন্দা অলক মণ্ডল। দুই সন্তান, স্ত্রী আর বৃদ্ধা মাকে নিয়েই তার সংসার। ভিটে বাড়ি ছাড়াও মাঠে রয়েছে ১৭ শতক আবাদি জমি। এক সময় সেই জমিতে সব ধরনের ফসলই ফলতো। কিন্তু জমির আশপাশে একের পর এক মাছের ঘের নির্মাণে পানি নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ হওয়ায় সেই জমিতে এখন সারা বছরই থাকে জলাবদ্ধ। ফসল না ফলায় নিজে জমি থাকতেও এখন সংসার চালাতে পরের জমিতে করতে হচ্ছে দিনমজুরের কাজ।

অলক মণ্ডল বলেন, ‘আমার জমিতে তিন ফসলি ফসল ফলতো। তিল পাট ধান সবই ফলতো। এখন সেই জমিতে মাঝা সমান জল থাকে। আশপাশে মাছের ঘের কাটাতে জল সরার লাইন নেই। ফলে এখন আর ফলন হয় না। বাধ্য হয়ে পেট বাঁচাতে পরের জমিতে দিনমজুরি করতে হচ্ছে।’  

শুধু অলক মণ্ডল নয়; যশোরের দুঃখখ্যাত ভবদহ এলাকায় হাজারোও মানুষের জীবনের গল্প একই। নিজের জমি জায়গা থাকলেও বেঁচে থাকতে পরের জমি কিংবা শহরে করতে হচ্ছে দিনমজুরের কাজ।

যশোরের অভয়নগর, মনিরামপুর, কেশবপুর এবং খুলনার ডুমুরিয়া ও ফুলতলা উপজেলার অংশবিশেষ নিয়ে ভবদহ অঞ্চল। দুই দশক আগেও এই অঞ্চলে মাঠের পর মাঠ ভরে যেত তিন ফসলি আবাদে। এই অঞ্চলের পানি নিষ্কাশনের মাধ্যম মুক্তেশ্বরী, টেকা, শ্রী ও হরি নদীতে পলি পড়ে নাব্যতা কমতে থাকে। ভবদহ এলাকায় দুই দশক আগে শুরু হয় মাছের ঘের তৈরি। পানির সহজলভ্যতায় দিনের পর দিন বাড়ছে অপরিকল্পিত মাছের ঘের। ঘের স্থাপনে নীতিমালা থাকলেও মানছে না কেউ। যার ফলে বর্ষায় ঘের এলাকা প্লাবিত হয়ে পানি নিষ্কাশনের পথ রুদ্ধ হওয়ায় সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতায়। ফলে বছরের পর বছর অচল জীবনযাত্রা। এমন পরিস্থিতিতে ঘের স্থাপনে নীতিমালা তৈরি করে নিবন্ধনের ব্যবস্থা করেছে সরকার। কিন্তু ঘেরমালিকরা সেই নীতিমালা মানছেন না। অনেকে বিষয়টি জানেনও না। এতে ভবদহের জলাবদ্ধতার সংকট আরো প্রকট হচ্ছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, ভবদহ এলাকায় অন্তত ৫২টি ছোট-বড় বিল আছে। বিলের ভেতর দিয়ে মুক্তেশ্বরী, টেকা, হরি ও শ্রী নদ-নদী প্রবাহিত। এগুলোর জোয়ারভাটার সঙ্গে এলাকার বিলের পানি ওঠানামা করে। জলাবদ্ধতা নিরসন করে পরিকল্পিতভাবে মৎস্যঘের স্থাপন; সরকারি খাল, নদী ও জমি অবৈধ দখল থেকে উদ্ধার করে খাল ও নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য ২০১৯ সালে মৎস্যঘের স্থাপন নীতিমালা প্রণয়ন করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। কিন্তু কোনো ঘের ব্যবসায়ীই নীতিমালা মানেনি। দুই ঘেরের মাঝে আড়াই ফুট করে মোট পাঁচ ফুট জায়গা পানি নিষ্কাশনের জন্য ফাঁকা রাখার কথা থাকলেও কেউই ঘেরে জায়গা রাখেন না। ফলে বছরের পর নিজেদের কৃত্রিম সংকটেই নিজেরাই ডুবছে।

অভয়নগরের ডুমুরতলা এলাকার বাসিন্দা ও স্থানীয় একটি বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক শিব পদ বিশ্বাস বলেন, ‘আসলে ভবদহ এলাকায় জলাবদ্ধতার জন্য অপরিকল্পিত ঘের অবশ্যই দায়ী। কারণটা হচ্ছে যখন পাশাপাশি দুটি ঘের নির্মাণ করা হচ্ছে; একটি ঘেরের পাশে পানি প্রবাহ জন্য কোনো জায়গা রাখা হচ্ছে না। দুটি ঘিরের মধ্যে যদি সঠিক জায়গা রাখা হতো; তাহলে এই সমস্যার সৃষ্টি হতো না।’

বিল কেদারিয়ায় সাড়ে ৯৩ হেক্টর জমি ইজারা নিয়ে মাছের ঘের করেছেন পরেশ চন্দ্র মণ্ডল। তিনি এখনো ঘেরের নিবন্ধন করেননি। তিনি বলেন, ‘ফসল হয় না বলেই ঘের কেটেছিলাম। ঘেরের নিবন্ধন করার বিষয়ে আমি জানি না। আজই জানলাম। আমি মৎস্য অফিসে নিবন্ধনের ব্যাপারে খোঁজ নেব।’

২০১৯ সালে মৎস্যঘের স্থাপন নীতিমালায় বলা হয়, ঘের করতে হলে সংশ্লিষ্ট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার দপ্তর থেকে নিবন্ধন নিতে হবে। কেউ নীতিমালা ভঙ্গ করলে নিবন্ধন কর্মকর্তা তার নিবন্ধন বাতিল করবেন। সরকারি খাল, সরকারি জমি, নদীর পাড় ও নদীর মধ্যে ঘের স্থাপন করা যাবে না। নদী, খাল ও খাসজমি ইজারা নিয়ে করা ঘেরের ইজারা বাতিল ও ঘের অপসারণ করে পানির প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি ঘেরের আয়তন হবে সর্বোচ্চ ১৫ হেক্টর, সমবায় সমিতির ক্ষেত্রে ৫০ হেক্টর। ঘেরমালিক ঘেরের চারদিকে নিজ খরচে বাঁধ বা পাড় দেবেন, বাঁধের সঙ্গে সরকারি রাস্তা থাকলে বাঁধের উচ্চতা রাস্তার থেকে কম হবে। পানি নিষ্কাশনের সুবিধার্থে প্রত্যেক মালিককে ঘেরের বাঁধের বাইরে কমপক্ষে আড়াই ফুট করে জায়গা ছাড়তে হবে। উভয় ঘেরের পাড়ের মাঝে পানি নিষ্কাশনে অন্তত পাঁচ ফুট জায়গা থাকবে। সরকারি রাস্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধকে ঘেরের বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।

মৎষ্য বিভাগ বলছে, ভবদহ এলাকায় ১২ হাজার ৯৮৬ হেক্টর জমিতে ১৮ হাজার ২৪০টি মাছের ঘের আছে। এর মধ্যে মাত্র ৩২ জন ঘেরের নিবন্ধন রয়েছে।

সরেজমিন বিল বোকড়, বিল খুকশিয়া, বিল কেদারিয়া, বিল কপালিয়া, বিল ডুমুর, বিল পায়রা, বিল ঝিকরা ও চাতরার বিল ঘুরে দেখা গেছে, যত দূর চোখ যায় শুধু মাছের ঘের। অধিকাংশ ঘের নীতিমালা মেনে করা হয়নি। ঘেরগুলোর আয়তন দশমিক ১৭ হেক্টর (১ বিঘা) থেকে শুরু করে ২০৪ হেক্টর পর্যন্ত। শুধু চাতরার বিলে সমবায় ভিত্তিতে ১০২ হেক্টরে ঘের করা হয়েছে; যা নীতিমালার ৫০ হেক্টরের দ্বিগুণের বেশি। দুই ঘেরের মাঝে আড়াই ফুট করে মোট পাঁচ ফুট জায়গা পানি নিষ্কাশনের জন্য ফাঁকা রাখার কথা থাকলেও তেমন কোনো জায়গা নেই। পাশাপাশি দুই ঘেরের জন্য এক বাঁধ। মনিরামপুর উপজেলার পাঁচবাড়িয়া, নেবুগাতী, আলীপুর, কুলটিয়া ও লখাইডাঙ্গা এলাকায় মুক্তেশ্বরী নদী; বয়ারঘাটা ও বালিধা এলাকায় টেকা নদী এবং খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার চেঁচুড়ি, দোহাকুলা ও রুদাঘরা এলাকায় হরি নদীর দুই পাড় মাছের ঘেরের বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যদিও নীতিমালায় নদ-নদীর বাঁধকে ঘেরের বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করতে নিষেধ করা হয়েছে। এ ছাড়া অভয়নগরের ডুমুরতলা, মনিরামপুরের হাটগাছা, সুজাতপুর এলাকায় নওয়াপাড়া-কালীবাড়ি সড়ক এবং কেশবপুরের কাটাখালী এলাকায় কালীবাড়ি-চুকনগর সড়কের দুই পাশ ঘেরের বাঁধ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।

ভবদহ পানি নিষ্কাশন সংগ্রাম কমিটি আহ্বায়ক রণজিত বাওয়ালী বলেন, ‘ভবদহ অঞ্চলের জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ অপরিকল্পিত মৎস্যঘের তৈরি। এ বিষয়ে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ তাদের দায়িত্ব পালন করছে না। এ জন্য ভবদহের জলাবদ্ধতার সংকট আরো তীব্র হয়েছে। আমরা আন্দোলনও করেছি কোনো কাজ হচ্ছে না। অপরিকল্পিত ঘের বন্ধ করতে হবে আর। আর জলাবদ্ধতা স্থায়ী সমাধানে টিআরএম চালু করতে হবে।’

পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী পলাশ কুমার ব্যানার্জী বলেন, ‘জলবদ্ধতার অন্যতম কারণ ঘের। জেলা মৎস্য বিভাগকে চিঠি দিয়েছি। জলাবদ্ধতা দূর করণে সম্বনিত উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।’ 

যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এই সমস্যা যতটা না প্রাকৃতিক, তার চেয়ে বেশি মানুষ্য সৃষ্টি প্রতিবন্ধকতা ঘের তৈরি। দীর্ঘদিন এখানে ঘের নির্মাণের নিতিমালা ছিলো না। সম্প্রতি একটি নীতিমালা হয়েছে। সেই নীতিমালা অনুযায়ী ঘের নির্মাণ করতে হবে। ঘের ব্যবসায় লাইসেন্স নিতে হবে। সকল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা, মৎস্য কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।  সেই নীতিমালা অনুযায়ী ঘের পরিচালনা করতে হবে। নতুন করে ঘের নির্মাণ করতে না পারে; সেটিও নির্দেশনা রয়েছে।’

আজকালের খবর/ওআর








http://ajkalerkhobor.net/ad/1751440178.gif
সর্বশেষ সংবাদ
এশিয়া কাপের প্রাথমিক দল ঘোষণা, দলে ফিরলেন সৌম্য-শান্ত
দেশের মানুষ পরিবর্তন চায়: তারেক রহমান
দেশ নিয়ে একটা ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত চলছে: মির্জা ফখরুল
গৌরব গাঁথায় ১২ শহীদের উপজেলা দেবীদ্বারে
রামুতে ১৫ ফুট লম্বা অজগর উদ্ধার
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
জুলাইয়ে হামলার উসকানিদাতা হয়েও বিচারের বাইরে জাবির দুই শিক্ষক
বরিশালের গৌরনদীতে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার
সাবেক সেনা প্রধান হারুন অর রশিদ চট্টগ্রামে মারা গেছেন
সাজিদ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে উত্তাল ইবি, রাবি ও ঢাবি
হুট করে বাড়লো পেঁয়াজ ও ডিমের দাম
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft