বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের অফিস খুলছে-এটা শুধু একটা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, এটা এক বড় ধরনের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বার্তা। সরকার এখন অন্তর্বর্তী পর্যায়ে, এমন সময় এই সিদ্ধান্তে সম্মতি দেওয়া শুধু সাহস নয়, বরং হিসাবি ঝুঁকিও। ইসলামপন্থী দলগুলো বলছে, এটা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অখণ্ডতায় হস্তক্ষেপ, আর বামপন্থীদের চোখে এটা নতুন এক উপনিবেশিক কৌশলের নাম। বিএনপি মুখে কিছু বলছে না, তবে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা এটিকে ইতিবাচক বলায় এক নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ গড়ে উঠছে। ২০২৬ সালের নির্বাচনের আগে জাতিসংঘের এই উপস্থিতি কার জন্য আশ্বাস, আর কার জন্য আশঙ্কা-তা নিয়ে কূটনৈতিক মহলে চলছে হিসাব-নিকাশের তীব্র লড়াই।
এই সিদ্ধান্ত মানবাধিকার ইস্যুর বাইরেও ছুঁয়ে যাচ্ছে দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য, বিচারব্যবস্থা, ধর্মীয় স্পর্শকাতরতা এবং আন্তর্জাতিক অবস্থানের জটিল কনটেক্সটকে। এটাকে কেউ দেখছে নজরদারি হিসেবে, কেউ বলছে-নির্বাচনের নিরপেক্ষতা রক্ষার ছদ্মবেশে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। কেউ বলছে, জাতিসংঘ আসছে সহযোগী হিসেবে, কেউ আবার বলছে-সার্বভৌমত্বের গায়ে লাগছে চপেটাঘাত। প্রশ্ন উঠছে-সরকার কি স্বচ্ছতার বার্তা দিতে চায়, না কি আন্তর্জাতিক চাপ সামাল দেওয়ার পথ খুঁজছে? আন্তর্জাতিক মঞ্চে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি কি এই উপস্থিতির মাধ্যমে জোরালো হবে, না কি এর ছায়ায় আরো বেড়ে যাবে বিদেশি তদারকির ধারণা?
ঢাকার রাজনীতি এখন উত্তপ্ত, জাতীয় নির্বাচন সামনে-এই সময়ে জাতিসংঘের অফিস খোলা নিছক সহায়তা নয়, বরং এক ‘কৌশলগত ঘটনা’। এটি শুধু ভবিষ্যতের নির্বাচন নয়, বাংলাদেশের কূটনৈতিক সক্ষমতা, রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তি ও রাষ্ট্রীয় স্বায়ত্তশাসনের পরীক্ষার ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। তাই প্রশ্ন একটাই-এই নজর কি সমাধান আনবে, না কি আরো নতুন জটিলতা তৈরি করবে? এটি নয়া কূটনৈতিক বাস্তবতা, না কি পুরনো অভিভাবকত্বের নতুন পর্ব সেটাই প্রশ্ন?
জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর যদি বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে কাজ শুরু করে, তাহলে অনেকদিন ধরে চাপা পড়ে থাকা গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পুলিশি হেফাজতে নির্যাতন, সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধসহ নানা অভিযোগের তদন্তে একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পৌঁছানোর সুযোগ তৈরি হতে পারে। এ দেশে বহু বছর ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থাকলেও সেগুলোর অধিকাংশই বিচার-বহির্ভূত বা প্রমাণাভাবে ধামাচাপা পড়ে যায়। জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে থাকলে তথ্যের স্বচ্ছতা, অভিযোগের নিরপেক্ষ যাচাই, এবং আন্তর্জাতিক প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর একটি চাপ সৃষ্টি হবে, যা হয়তো দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পারে। একইসাথে এটি এমন একটি আন্তর্জাতিক বার্তা দেবে যে, বাংলাদেশ মানবাধিকার রক্ষায় আন্তর্জাতিকভাবে দায়বদ্ধ থাকতে চায়।
এটি সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা নয়তো? জাতিসংঘের উপস্থিতিকে অনেকেই দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর এক ধরনের চোখ রাঙানি হিসেবে দেখছেন। বিশেষ করে এমন একটি সংস্থা, যার কাজ মানবাধিকারের লঙ্ঘন খুঁজে বের করে তা আন্তর্জাতিক মহলে উপস্থাপন করা, সেটি যদি স্থানীয়ভাবে থেকে কাজ করে— তাহলে দেশের অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত ও নীতিমালায় বিদেশি প্রভাব অনিবার্য হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি ভবিষ্যতে দেশে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে সরকারের অভ্যন্তরীণ কর্মকাণ্ড কিংবা বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতাও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে জাতিসংঘের তরফ থেকে। এর ফলে রাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত গ্রহণে আত্মবিশ্বাস ও ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার শঙ্কা থেকেই যায়।
ইসলামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো জাতিসংঘের উপস্থিতিকে শুধু একটি মানবাধিকার তদারকির বিষয় হিসেবে না দেখে বরং এটি একটি সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ও ধর্মীয় অনুপ্রবেশ বলেই চিহ্নিত করছে। তাদের প্রধান আশঙ্কা হলো, জাতিসংঘের মানবাধিকার এজেন্ডার অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলোর মধ্যে এলজিবিটিকিউ অধিকার, ধর্মনিরপেক্ষতা, নারীবাদ, এবং ধর্মীয় সমালোচনার স্বেচ্ছাচার রয়েছে, যা বাংলাদেশের ধর্মীয় সমাজব্যবস্থার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। ইসলামপন্থীরা মনে করে, এসব ইস্যুতে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশের মূল্যবোধ ও সামাজিক গঠনকে নড়বড়ে করার চেষ্টা চলবে। ফলে এটি রাজনৈতিক নয়, বরং সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় দ্বন্দ্বেও রূপ নিতে পারে।
আশ্চর্যের বিষয়, বামপন্থীরা যারা দীর্ঘদিন ধরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার, তারাও এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ। তাদের মতে, দেশের সমস্যার সমাধান দেশের ভেতর থেকেই হওয়া উচিত; কোনো আন্তর্জাতিক সংগঠন এসে দিনের পর দিন তদারকি করে যাবে, এটি একধরনের উপনিবেশিক পদ্ধতির আধুনিক রূপ। অনেক বামপন্থী নেতা বলেছেন, জাতিসংঘ যে দেশে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারেনি, সেই জাতিসংঘ এখন বাংলাদেশে ‘পাহারাদার’ হয়ে বসতে চায়। তারা একে ‘সাদা চামড়ার আধিপত্য’ বলেও আখ্যা দিয়েছে। এই আপত্তি থেকে বোঝা যায়, রাজনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে জাতীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে এখনও একটি সম্মিলিত স্পর্ধা কাজ করছে।
এ বিষয়ে বিএনপি সরাসরি কোনো বিবৃতি না দিলেও, দলটির একাধিক শীর্ষ নেতা বেসরকারিভাবে জানিয়েছেন যে, তারা এই সিদ্ধান্তকে ন্যায্য ও সময়োপযোগী মনে করছেন। তাদের মতে, সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়গুলো এতদিন দেশে দমন করা হতো বা অস্বীকার করা হতো। কিন্তু জাতিসংঘের অফিস থাকলে সেগুলো আন্তর্জাতিকভাবে প্রকাশ পাবে, যা সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। তবে দলের ভেতরে একটি অংশ এটিকে দ্বৈত নীতির উদাহরণ হিসেবেও দেখছেনÑ একদিকে জাতীয়তাবাদ, অন্যদিকে বিদেশি হস্তক্ষেপের আশ্রয়। ফলে বিএনপির অবস্থান এখনো পরিপূর্ণভাবে স্পষ্ট নয়, কিন্তু এটাও সত্যি যে তারা পরিস্থিতিকে নিজেদের রাজনৈতিক সুযোগে পরিণত করতে চাইছে।
সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে জাতিসংঘকে অফিস স্থাপনের অনুমতি দিলেও, দলীয় নেতাকর্মী ও নীতিনির্ধারকদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে দ্বিধা রয়েছে। কেউ এটিকে সরকারের উদারতা ও আত্মবিশ্বাসের নিদর্শন হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ কেউ এটিকে জাতীয় নিয়ন্ত্রণহীনতার দৃষ্টান্ত বলে মনে করছেন। সরকার যদি সত্যিই আত্মবিশ্বাসী হয় যে দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নেই, তাহলে জাতিসংঘের উপস্থিতি তার পক্ষে যাবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, অতীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগ জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। ফলে সরকারি মহলে একটা চাপা উদ্বেগ রয়েছে-জাতিসংঘের দপ্তর দেশের ভাবমূর্তিকে বিশ্বমঞ্চে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
বাংলাদেশে জাতিসংঘের দপ্তর গুম-খুনের তদন্তে বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে কি? বাংলাদেশে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ বহুদিন ধরেই আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত। কিন্তু এসব ঘটনায় বিচার প্রায় অনুপস্থিত। জাতিসংঘের অফিস স্থাপিত হলে, নিরপেক্ষ তথ্য সংগ্রহ, সাক্ষ্য প্রক্রিয়া এবং তথ্য যাচাইয়ের পদ্ধতি আন্তর্জাতিকভাবে নিরীক্ষিত হতে পারে। এতে একদিকে যেমন সরকারের ওপর চাপ তৈরি হবে, অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোও একটি আশার আলো দেখবে। তবে এই প্রক্রিয়া কতটা কার্যকর হবে, তা নির্ভর করবে জাতিসংঘের দপ্তরের কাঠামো, ক্ষমতা এবং স্বাধীনতার ওপর। যদি দপ্তরটি কেবল কাগুজে রিপোর্ট তৈরি করে, তবে তাতে লাভ হবে না; কিন্তু যদি সত্যিকারের অনুসন্ধানী কাজ শুরু করে, তবে এটি বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থাকে পরিপূরক করতে পারে।
জাতিসংঘের অফিস যদি স্থানীয় বিচার প্রক্রিয়ায় পর্যবেক্ষণমূলক ভূমিকা রাখতে শুরু করে, তাহলে প্রশ্ন উঠবেÑ এটি কি বিচারব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, নাকি সহায়তা দিচ্ছে? বাংলাদেশের আদালত স্বাধীন হলেও অনেক সময় রাজনৈতিক প্রভাব, প্রশাসনিক চাপ এবং বিচারপ্রার্থী নাগরিকের অসহায়ত্ব বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলে। জাতিসংঘ যদি মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলা, বিচার বিলম্ব, জামিন বঞ্চনা বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রসূত মামলা নিয়ে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ চালায়, তবে আদালতের ওপরও একটি আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা তৈরি হবে। একইসঙ্গে এটি বিচারিক স্বচ্ছতার পথে কিছুটা হলেও সহায়ক হতে পারে। তবে আদালত যদি জাতিসংঘের উপস্থিতিকে হস্তক্ষেপ মনে করে, তাহলে তা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য এক সংকট তৈরি করতে পারে।
জাতিসংঘের অফিস সুশীল সমাজ, মানবাধিকার সংগঠন এবং স্বাধীন মিডিয়ার জন্য একদিকে হতে পারে আন্তর্জাতিক সহায়তার দরজা; অন্যদিকে হতে পারে নতুন পর্যবেক্ষণ ও সন্দেহের কারণ। যারা সত্যিকার অর্থে মানবাধিকারের জন্য কাজ করেন, তাদের জন্য জাতিসংঘ একটি প্ল্যাটফর্ম দিতে পারে যেখান থেকে তারা আন্তর্জাতিক মহলে বক্তব্য তুলে ধরতে পারবেন। কিন্তু একইসঙ্গে ক্ষমতাসীন মহল তাদেরকে ‘বিদেশি এজেন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে, যা তাদের উপর রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক চাপ বাড়াবে। বিশেষত মিডিয়াকে যেভাবে বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ করা হয়, সেখানে জাতিসংঘ-সমর্থিত সংবাদ বা বিশ্লেষণকে ‘বিদেশি হস্তক্ষেপ’ হিসেবে তিরস্কার করা হতে পারে। ফলে সুবিধা ও ঝুঁকি দুই-ই থাকবে।
জাতিসংঘের অফিস স্থাপনের ফলে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অর্থায়নের ক্ষেত্রে একটি ইতিবাচক সিগন্যাল দিতে পারে যে, বাংলাদেশ মানবাধিকার রক্ষায় আন্তরিক। এতে করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নরওয়ে, সুইজারল্যান্ড, কানাডা, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অনেক প্রকল্পে সহায়তা পেতে বাংলাদেশ বাড়তি সুবিধা পেতে পারে। আবার অন্যদিকে, যদি জাতিসংঘের রিপোর্টে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিক প্রমাণ উঠে আসে, তাহলে সেইসব সহযোগী দেশ অনুদান বা বাণিজ্য চুক্তিতে শর্তারোপ করতে পারে। অর্থাৎ এটিকে একসঙ্গে সুযোগ এবং চাপ দুই-ই হিসেবে দেখা যায়।
মানবাধিকার দপ্তর থাকলে যেকোনো নিপীড়িত, গুমের শিকার পরিবার বা নির্যাতিত নাগরিক আন্তর্জাতিক ফোরামে নিজেকে তুলে ধরার সুযোগ পাবে। বিশেষ করে যেসব নাগরিক দমন-পীড়নের শিকার হয়ে জাতীয়ভাবে ন্যায়বিচার পায় না, তারা জাতিসংঘের কাছে সরাসরি অভিযোগ করতে পারবেন। এটি রাজনৈতিক আন্দোলনকারীদের জন্য একপ্রকার মনস্তাত্ত্বিক শক্তি হবে। ফলে সরকার বিরোধী রাজনীতির একটি পরোক্ষ ব্যাকআপ হিসেবে জাতিসংঘ অফিস কার্যকর হতে পারে। তবে এ কারণেই ক্ষমতাসীন মহল এর কার্যক্রমকে সন্দেহের চোখে দেখবে, যা রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়াতে পারে।
২০২৬ সালের জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে জাতিসংঘের এই সিদ্ধান্ত আসা নিছক কাকতালীয় নয়-এমন ধারণা অনেক বিশ্লেষকের। অতীতের নির্বাচনে গুম-খুন, ভোট ডাকাতি, প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব ইত্যাদি অভিযোগ যেভাবে আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিধ্বনি তুলেছে, এবার জাতিসংঘ অফিস সরাসরি মাঠে থাকলে ওইসব অভিযোগের তথ্যপ্রমাণ এবং অনুসন্ধান আরো বেশি দৃশ্যমান হতে পারে। সুতরাং এটি নিছক মানবাধিকার নয়, বরং বাংলাদেশের নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি আন্তর্জাতিক আগ্রহ ও মনিটরিংয়ের ইঙ্গিতবাহী বার্তা। নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও নাগরিক সমাজের তরুণ সদস্যদের মধ্যে একটি বিশাল অংশ গণতন্ত্র, অধিকার ও স্বচ্ছতার বিষয়ে অত্যন্ত সচেতন। জাতিসংঘের অফিস তাদেরকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামো ও চর্চার সঙ্গে যুক্ত হতে অনুপ্রাণিত করতে পারে। তরুণদের মধ্যে যারা মানবাধিকার ও কূটনীতিতে আগ্রহী, তারা এই অফিসের মাধ্যমে ইন্টার্নশিপ, কর্মসূচি বা নেটওয়ার্কিং-এর সুযোগ পেতে পারেন। তবে একইসঙ্গে এটি তরুণদের মধ্যে একটি ‘বিদেশমুখী’ বা ‘আন্তর্জাতিক নির্ভরতামূলক’ চেতনা গড়ে তুলতে পারে, যা জাতীয় রাজনীতির জন্য জটিলতা তৈরি করতে পারে।
এদিকে ভারত, চীন ও রাশিয়া— এই তিন দেশের মধ্যে মানবাধিকারের প্রশ্নে জাতিসংঘকে নিয়ে দীর্ঘদিনের দ্বৈতনীতি রয়েছে। ভারত নিজেই জাতিসংঘের এমন পর্যবেক্ষণ অনেক সময় প্রত্যাখ্যান করে, চীন তো একে ‘পশ্চিমা আধিপত্যবাদ’ বলে খারিজ করে দেয়। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশে জাতিসংঘের অফিস স্থাপন ভারত বা চীনের কাছে কেমন বার্তা পাঠাবে? যদি তারা মনে করে, এ অঞ্চলে পশ্চিমা প্রভাব বাড়ছে, তাহলে বাংলাদেশ তাদের কূটনৈতিক চাপ বা সন্দেহের মুখে পড়তে পারে। বিশেষ করে চীন-পাকিস্তান জোটের দিক থেকেও এটি একটি রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। যদি জাতিসংঘের এই অফিস নিরপেক্ষতা হারায়, পক্ষপাতিত্ব করে বা নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে অতিরিক্ত মেলামেশা করে— তাহলে সেটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘বুমেরাং’ হয়ে ফিরে আসবে। এমনকি জনগণের মধ্যেও জাতিসংঘের প্রতি আস্থা কমে যাবে। অতীতে আফগানিস্তান, ইরাক বা সিরিয়ায় জাতিসংঘ যেভাবে বিতর্কিত ভূমিকা রেখেছে, সেসব অভিজ্ঞতা বাংলাদেশেও তুলনা টানতে পারে। কাজেই জাতিসংঘের নিজেদের ভূমিকা হতে হবে অত্যন্ত পেশাদার, ভারসাম্যপূর্ণ ও প্রমাণনির্ভর। অন্যথায় এটিকে সরকারও ব্যবহার করতে পারে একটি ব্যর্থ আন্তর্জাতিক উদ্যোগ হিসেবে।
বাংলাদেশে জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের অফিস খোলা নিছক কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ঘটনা নয়Ñ এটি এক বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমীকরণের বহিঃপ্রকাশ। একদিকে, এটি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নয়নের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে। অন্যদিকে, বিষয়টি ঘিরে জনমনে যেমন কৌতূহল রয়েছে, তেমনি রয়েছে সংশয় ও প্রশ্নবোধকতা। জাতিসংঘের এমন একটি সংস্থা দেশের ভেতরে কার্যক্রম শুরু করলে স্বাভাবিকভাবেই তা আমাদের প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক পরিসরে একটি প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলতে পারে। তবে এই প্রভাব ইতিবাচক না নেতিবাচক হবে, তা নির্ভর করবে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের অবস্থান ও কার্যক্রমের স্বচ্ছতার ওপর। কেননা, যদি এর কার্যক্রম পক্ষপাতদুষ্ট হয় বা কোনো একক গোষ্ঠীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তবে তা দেশের সার্বভৌমত্ব ও অভ্যন্তরীণ ভারসাম্যের জন্য উদ্বেগজনক হতে পারে।
এই বাস্তবতায় সরকার, বিরোধী দল, সুশীল সমাজ এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের উচিত হবে সংযম ও কৌশলের মাধ্যমে বিষয়টি মোকাবিলা করা। এই অফিস যেন মানবাধিকার উন্নয়নের সহযোগী শক্তি হয়, কোনো গোপন চাপ বা হস্তক্ষেপের মাধ্যম না হয়ে ওঠেÑ তা নিশ্চিত করাই এখন সময়ের দাবি। তা না হলে, জাতিসংঘের পদচারণা যেমন থাকবে, তেমনি থেকে যাবে এক অস্বস্তিকর কূটনৈতিক জটিলতা-যার থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হবে না।
মীর আব্দুল আলীম: সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব-কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।
আজকালের খবর/আরইউ