জাবিতে ১৫ জুলাই 'কালোরাত্রির' হামলার এক বছর: এখনো অধরা বিচার
নাইম খান, জাবি সংবাদদাতা
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১৫ জুলাই, ২০২৫, ৬:০৩ পিএম
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ১৫ জুলাই সংঘটিত হামলার এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে। গত বছর এই দিনে বৈষম্যবিরোধী এই ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত  ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৫ জুলাই বিকেলে শিক্ষার্থীরা একটি বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। তবে শান্তিপূর্ণ এই কর্মসূচিতে হঠাৎ করেই উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।  সেদিন বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা দুই দফায় শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও সাংবাদিকদের উপর বর্বরোচিত সশস্ত্র হামলা চালায়, যাদের অনেকেই গুরুতর আহত হয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া ন্যাক্কারজনক ঘটনাটি শিক্ষার্থীদের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছিল।

এই ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দ্রুত বিচার ও দোষীদের শাস্তির আশ্বাস দিলেও, কালোরাত্রির বিচার এখনো অধরা। হামলাকারীরা এখনো প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা এবং বিচারব্যবস্থার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা বাড়ছে, কারণ তারা দেখছে যে ন্যয়বিচার পেতে তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষা করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, ১৫ জুলাইয়ের হামলার বিচারহীনতা কেবল একটি ঘটনার বিচারহীনতা নয়, বরং  সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে পুরো বিচার প্রক্রিয়ার ওপর আস্থার সংকট তৈরি করছে।

জানা যায়, ১৫ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের পূর্বঘোষিত বিক্ষোভ মিছিল বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বঙ্গবন্ধু হল সংলগ্ন এলাকায় পৌঁছালে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ছাত্রলীগের সভাপতি আকতারুজ্জামান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন হামলার নেতৃত্ব দেন। এতে গুরুতর আহত হন আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুর রশীদ জিতু, মাহফুজ ইসলাম মেঘ, জাহিদুল ইসলাম বাপ্পি, তৌহিদ সিয়াম, রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক আওলাদ হোসেন এবং প্রেসক্লাবের তৎকালীন সভাপতি মোসাদ্দেকুর রহমানসহ অন্তত ৫০ জন।

সেদিন সন্ধ্যায় আহত হয়েছিলেন সরকার ও রাজনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী আনজুম শাহরিয়ার। 

সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৫ জুলাইয়ের মিছিলে ছাত্রলীগের সদস্যরা আচমকা আমাদের ওপর বটতলায় হামলা চালায়। কাপুরুষোচিত সেই হামলায় আমি নিজেও আক্রান্ত হই। হামলাকারীরা আমাদেরই পরিচিত কিছু মুখ, তারা সেদিন হিংস্র জানোয়ারে পরিণত হয়েছিল। মেয়েদের লক্ষ্য করে প্রথম দফার আঘাত আসে। আমরা যারা পাশে ছিলাম, মেয়েদের রক্ষা করতে গিয়ে নিজেরাও মার খেয়ে ছত্রভঙ্গ হই। প্রতিরোধ করতে গিয়ে একপর্যায়ে দেখি আমার বাঁ হাত অবশ হয়ে যাচ্ছে, পিঠে ও কোমরেও তীব্র ব্যথা। সেখান থেকে আমাকে উদ্ধার করে মেডিকেল সেন্টারে নেয়া হয়। সেখানে আহতদের আর্তনাদে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছিল। সেদিনের সেই বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতা আজও তাড়িয়ে বেড়ায়।

এদিকে, সন্ধ্যায় শিক্ষার্থীদের উপর হামলার প্রতিবাদে ১৫ জুলাই রাত ৯টার দিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিচার দাবিতে অবস্থান নেন। রাত ১২টার দিকে ছাত্রলীগ হামলার জন্য আসছে—এমন খবরে আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের বাসভবনের ভেতরে অবস্থান নেন। রাত সাড়ে ১২টার দিকে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা সেখানে চূড়ান্ত হামলা চালায়। শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য করে পেট্রোল বোমা ও ইট নিক্ষেপ করা হয়। অনেকের হাতে ছিল রামদা, চাপাতি, লোহার রড ও লাঠি। উপস্থিত সাংবাদিকদের অনুরোধ সত্ত্বেও সেদিন পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে এবং হামলাকারীদের সুযোগ করে দেয়। একপর্যায়ে হামলার বর্বরতার খবর পেয়ে আবাসিক হলগুলো থেকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে অবরুদ্ধদের উদ্ধার করতে গেলে পুলিশ উলটো তাদের ওপর রাবার বুলেট ও টিয়ার শেল ছোড়ে। এতে প্রায় ৬০ জন শিক্ষার্থী আহত হন। একইসঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালনরত সাংবাদিকদের উপরও হামলা হয়। পরিচয় দেয়া সত্ত্বেও তাঁদের ওপর গুলিবর্ষণ করা হয়।

সেদিন ছাত্রলীগের হামলায় সাংবাদিকদের মধ্যে আহত হন বাংলা ট্রিবিউনের এস এম তাওহীদ, সময়ের আলোর মুশফিকুর রিজওয়ান ও ডেইলি স্টারের সাকিব আহমেদ। পুলিশি গুলিতে আহত হন বণিক বার্তার মেহেদী মামুন, দৈনিক বাংলার সার্জিল, জনকণ্ঠের ওয়াজহাতুল ইসলাম ও বাংলাদেশ টুডের জোবায়ের আহমেদ।

এছাড়াও উপাচার্যের বাসভবনে আটকে পড়েছিলেন বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন। সেদিনের ঘটনার স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ছাত্রলীগ এবং ভাড়াটে সন্ত্রাসীরা উপাচার্যের বাসভবনের মতো সুরক্ষিত জায়গায় কীভাবে হামলার সাহস পেয়েছিল—এর জবাব স্পষ্ট। তৎকালীন প্রশাসন ও উপস্থিত পুলিশের মৌন সম্মতি ছিল। আমরা হতবাক হয়ে তাদের নীরবতা প্রত্যক্ষ করেছি। বারবার তৎকালীন পিশাচ উপাচার্যকে বাসার দরজা খুলে আমাদের আশ্রয় প্রদানের অনুরোধ জানিয়েছি। তার মন একটিবারের জন্যও গলেনি। উপায় না পেয়ে শিক্ষার্থীরা যে যার মতো করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। সেদিন রাতে যদি বিভিন্ন হল থেকে দলবদ্ধভাবে শিক্ষার্থীরা আমাদের উদ্ধারে না আসতো, তাহলে হয়ত জাহাঙ্গীরনগরে জুলাইয়ের রাতে ঘটে যেত ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড। আমি নিজ চোখে ভাই—বোনদের রক্ত ঝরতে দেখেছি। অথচ সেই ভয়াল রাতের এখনও কোনো বিচার হয়নি।

অপরদিকে জুলাইয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার তদন্ত্রে একটি প্রাথমিক তদন্ত কমিটি করেছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেই কমিটির প্রতিবেদনের পর একটি অধিকতর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কার্যক্রম ও বিচারের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান বলেন, জুলাইয়ের হামলার তদন্ত ও বিচারের কার্যক্রম প্রতিদিনই চলছে। আমরা আশা করছি শিক্ষার্থীদের বিচার কার্যক্রম পূর্বঘোষিত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে। শিক্ষকদের বিচার কার্যক্রমও এগিয়েছে। আমরা পরবর্তী মিটিংয়ের সময়ও ঘোষণা করেছি। এই কার্যক্রমে আমাদের প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে।

এদিকে, শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে সম্প্রতি ১৫ জুলাই রাতে ‘কালরাত্রি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ভয়াল এই রাতের স্মরণে নেয়া হয়েছে কর্মসূচি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার আজিজুর রহমানের স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এদিন রাত সাড়ে ১০টায় উপাচার্যের বাসভবনের সামনে জমায়েত, ডকুমেন্টারি প্রদর্শন ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া রাত ১২টায় এক মিনিট বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকবে এবং পরে ঘটনাস্থলে মোমবাতি প্রজ্বলন করা  হবে।

আজকালের খবর/বিএস 








http://ajkalerkhobor.net/ad/1751440178.gif
সর্বশেষ সংবাদ
রাজধানীতে ডিস ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা, আটক ২
গোপালগঞ্জে বৃহস্পতিবারের এইচএসসি ও সমমান পরীক্ষা স্থগিত
শ্রীলঙ্কায় প্রথমবারের মতো সিরিজ জয়, বাংলাদেশের ইতিহাস
এনসিপি নেতার্মীদের হত্যার উদ্দেশ্যে মুজিববাদী সন্ত্রাসীরা হামলা করেছে : নাহিদ ইসলাম
সেই তারেক মাহমুদের চিত্রনাট্যে নাজমুল হুদার নাজিমের ‘ডিস্কো বিবি’
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
ভয় কিসের? আমরাও সাংবাদিক ডেকে নিউজ করাব: জুনিয়রদেরকে নাহিদ
গোপালগঞ্জের নাম বদলাতে আসি নাই: নাহিদ ইসলাম
গোপালগঞ্জে এনসিপির ওপর হামলাকারীদের ছাড় নয়: অন্তর্বর্তী সরকার
গোপালগঞ্জে হামলার প্রতিবাদে শাহবাগ ব্লকেড
গোপালগঞ্জে এনসিপির সমাবেশস্থলে হামলা
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft