শনিবার ১৯ এপ্রিল ২০২৫
গিয়াসউদ্দিন সেলিম বললেন- ‘এটা স্রেফ অরাজকতা’
কপালভাঁজ করা প্রশ্নের মুখে ‘অপারেশন জ্যাকপট’
আহমেদ তেপান্তর
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২৩, ৬:৩৬ PM আপডেট: ০১.০১.২০২৪ ৬:২৩ PM
মুক্তিযুদ্ধের সময় অপারেশন জ্যাকপট নামের এক অভিযানে চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্র বন্দর, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জে একযোগে গেরিলা অপারেশন চালানো হয়েছিল। সেই অভিযানে পাকিস্তান ও অন্য আরও কয়েকটি দেশ থেকে অস্ত্র, খাদ্য  ও তেল নিয়ে আসা ২৬টি জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধারা। নৌ-সেক্টর কর্তৃক পরিচালিত এই গেরিলা অভিযানের বীরত্বের গল্প এবার উঠে আসছে সিনেমার পর্দায়। ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামেই নির্মিত হচ্ছে সিনেমাটি। যেটার অর্থায়ন করছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। ছবিটির বাজেট ধরা হয়েছে ২১ কোটি টাকা। বিশাল ক্যানভাসের বিগ বাজেটের এই ছবি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সর্বাধিক সিনেমার পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু (বাংলাদেশ) ও রাজিব কুমারকে (ভারত)।  

আগামীকাল ২৯ ডিসেম্বর থেকে বিএফডিসি থেকেই শুরু হচ্ছে ছবিটির শুটিং। এই লটের চিত্রায়ন চলবে ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত। এরপর দ্বিতীয় লটের শুটিং হবে ফেব্রুয়ারিতে। কাজ শেষে কবে নাগাদ মুক্তির পরিকল্পনা, সেটা অবশ্য এখনই জানাননি সংশ্লিষ্টরা।

বুধবার (২৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় একটি সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ছবিটির বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়। যেখানে উপস্থিত ছিলেন ছবির প্রযোজক স্বপন চৌধুরীসহ আরও অনেকে।

এরআগে দরপত্রে কিবরিয়া ফিল্মস সম্ভাব্য পরিচালক হিসাবে দেলোয়ার জাহান ঝন্টু (বাংলাদেশ), স্বপন চৌধুরী (বাংলাদেশ), জেপি দত্ত (ভারত) এবং অনিরুদ্ধ রায় (ভারত) এর নাম উল্লেখ করলেও অবস্থার প্রেক্ষাপটে স্বপন চৌধুরী (বাংলাদেশ), জেপি দত্ত (ভারত) এবং অনিরুদ্ধ রায় (ভারত) নাম নেই। অপরদিকে বিবিসি বাংলাকে সিনিয়র পরিচালক দেলোয়ার জাহান ঝন্টু জানিয়েছিলেন ছবি নির্মাণ প্রস্তাবের দরপত্রে নাম থাকলেও এটি নিয়ে আলোচনা শুরুর আগে কিছুই জানতেন না। 

ওই সময় ঝন্টু বিবিসি বাংলাকে তার অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে বলেছিলেন, ‘অপারেশন জ্যাকপট সিনেমার বিষয়ে এসব আলোচনার আগে আমি কিছুই জানতাম না। একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে আমি প্রথম শুনি, আমাকে না কি পরিচালক হিসাবে প্রস্তাব করা হয়েছে। তাকে বললাম, আমি তোমার কাছেই প্রথম শুনলাম, আমি তো জানিই না। তখন সে বলল, টেন্ডারে অ্যাপ্লাই করে কিবরিয়া ফিল্ম ছবিটা পেয়েছে।’

এ ঘটনা প্রমাণ করে ইতিহাস আশ্রিত অপারশেন জ্যাকপট সিনেমা নির্মাণে চিত্রপরিচালকদের গবেষণা সম্পর্কে পূর্ব ধারণাই নাই। তাই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে ইতিহাস ও গবেষণায় অনভিজ্ঞ এই নির্মাতাদ্বয় বড় ক্যানভাসের এই সিনেমাটি কতটুকু পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে পারবেন? 

শিল্পীদের তালিকায় গড়মিল
এদিকে টেন্ডারে জমা দেওয়া শিল্পীদের তালিকায় দেখা গেছে গড়মিল। কিবরিয়া ফিল্মসের প্রস্তাবিত অপারেশন জ্যাকপট চলচ্চিত্রে অভিনয় শিল্পীদের তালিকায় সুপাস্টার শাকিব খান, ওমর সানি, মোশাররফ করিম, মৌসুমি, পূর্ণিমা, অপু বিশ্বাস, রিয়াজ, নিপুণ, ববিতা, আহমেদ শরীফ, সুচরিতা, মিশা সওদাগর, সুচরিতা, চম্পা, ভারতের রাণী মুখার্জি, সানি দেওল, সুনীল শেঠি, ফারদিন খান, জয়া বচ্চনসহ আরও কয়েকজনের নাম থাকলেও ২৭ ডিসেম্বর নামের তালিকায় গুণী অভিনেতা আহমেদ শরীফ, ইলিয়াস কাঞ্চন এবং মিশা সওদার ছাড়া উল্লেখিত নামের কারো নাম দেখা যায়নি। 

প্রযোজক স্বপন চৌধুরীর দেওয়া তথ্যে জানা যায়, এই ছবিতে ৮০ জনের বেশি অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করবেন। এর মধ্যে মুখ্য চরিত্রগুলোতে চূড়ান্ত হয়েছেন অনন্ত জলিল, রোশান, ইমন, নিরব, শিপন মিত্র, সাঞ্জু জন, জয় চৌধুরী, আমান রেজা, ডন, ড্যানি সিডাক প্রমুখ। যারা প্রায়ই অভিনয় দক্ষতার প্রশ্নে গণমাধ্যমে নেতিবাচক আলোচনার জন্ম দেন। অপরদিকে চিত্রনাট্য পছন্দ না হওয়া ছবি থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন চিত্রনায়ক বাপ্পি চৌধুরী, সিয়ামের মতো তারকা অভিনেতারা।

অপারেশন জ্যাকপট বানিয়েছিলেন মানিক
নেভাল কমান্ডার এসোসিয়েশন কর্তৃক অপারেশন জ্যাকপট বানিয়েছিলেন নব্বই ও শূণ্য দশকের তারকা পরিচালক এফ আই মানিক। টেলিফিল্মটি নির্মাণে খরচ হয়েছিলো ১৯ লাখ টাকা। এক ঘণ্টা ২০ মিনিট দৈর্ঘের টেলিফিল্মটি  বিটিভিতে প্রচারিত হয়েছিলো ১৯৯৮ সালে। 

তিনি বলেন, শুরুতে শুনেছিলাম গিয়াসউদ্দিন সেলিম কাজটি নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার সঙ্গে আরো কয়েকজন গুণী নির্মাতাও ছিলেন। যাদের পরিচ্ছন্ন নির্মাণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। পরে জানলাম তারা পাচ্ছেন না। সত্যি বলতে টেন্ডার ডেকে সিনেমা নির্মাণ এ ধারণাটাই আমাকে অবাক করেছে। অপারেশন জ্যাকপট প্রেমের গল্প নয়, এটা একটা ইতিহাসের বাঁক পরিবর্তনের অংশ। এখানে অনেক গবেষণার বিষয় রয়েছে। উপযুক্ত শিল্পী বাছাই করে প্রচুর গবেষণা আর পর্যাপ্ত ট্রেনিং ছাড়া এ সিনেমাটি নির্মাণ অসম্ভব। যারা কাজটি পেয়েছেন তারা যদি যথাযথভাবে এগুলো না করে থাকেন তবে সেটা হবে ইতিহাসের সঙ্গে তামাশা। কোনোভাবেই প্রকৃত ঘটনা এড়িয়ে কারো মাহাত্ম্য দেখানো হবে শিখিয়ে দেওয়া বুলির মতো ঘটনা। এ প্রজন্ম খুবই সচেতন, তারা এগুলো লক্ষ্য রাখবে। 

ওরা ৭ জন নির্মাণের অভিজ্ঞতা জানালেন খিজির হায়াত খান
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সিনেমা নির্মাণের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন খিজির হায়াত জানালেন তার ওরা ৭ জন সিনেমা নির্মাণের অভিজ্ঞতার কথা। বলেন, এ সিনেমা করতে গিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণা আর তিন মাস ধরে গ্রুমিং করেছি। স্পট রেকি করেছি কয়েকবার। এরপর শুটিংয়ে গিয়েছি। এটা ইতিহাসের আশ্রিত বলেই এতোগুলো কাজ করতে হয়েছে। হুটহাট করে শিল্পী বাছাই করে ক্যামেরা ওপেন করে শর্ট নিলেই সিনেমা হয়ে যাবে না। এমন সিনেমা নির্মাণের আগে গণমাধ্যমের কাছে তাদের গবেষণার ফিরিস্ত দেওয়া উচিৎ।   

‘এটা স্রেফ অরাজকতা’
পর্যাপ্ত গবেষণা, নির্মাণ প্রক্রিয়ায়, শিল্পী বাছাই গরমিল প্রসঙ্গে কিবরিয়া ফিল্মেসের পুরো প্রক্রিয়া ‘অরাজকতার’ সঙ্গে তুলনা করেছেন অপারেশন জ্যাকপটের জন্য গবেষণাকর্ম ও চিত্রনাট্য তৈরি করা মনপুরা’খ্যাত নির্মাতা গিয়াসউদ্দিন সেলিম।  

সিনেমা নিয়ে বিতর্ক কেন
প্রায় আড়াই বছর আগে অপারেশন জ্যাকপট নিয়ে প্রথম একটি চলচ্চিত্র তৈরির উদ্যোগ নেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। সেই সময় তারা চিত্র পরিচালক গিয়াসউদ্দিন সেলিমকে চিত্রনাট্য তৈরির দায়িত্ব দেয়।

পরবর্তীতে এই চলচ্চিত্র নির্মাণ তদারকির দায়িত্ব পায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়।  এরপর গত বছরের (২০২৩) আগাস্ট মাসে তারা এই চলচ্চিত্র নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করে।

সেই দরপত্রে অংশ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজটি পায় ‘কিবরিয়া ফিল্মস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। তাতে গিয়াসউদ্দিন সেলিমের ‘আশীর্বাদ চলচ্চিত্র’ অংশ নিলেও, আবেদন ‘বিধিসম্মত না হওয়ায়’ তাদেরকে বাদ দেয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়।

ওই চিত্রনাট্য কমিটির সদস্য মোরশেদুল ইসলাম অভিযোগ করে বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, ‘এখানে যা হয়েছে, তা হলো দুর্নীতি। অনেক টাকার কাজ, সেটা দুর্নীতির মাধ্যমে তাদের দেয়া হয়েছে। টাকা পয়সার লেনদেন হয়েছে। এ ছাড়া আর কোন কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না।’

তিনি আরো বলেছিলেন- ‘আমরা শুরু থেকেই চিত্রনাট্য কমিটিতে ছিলাম। চারবছর ধরে সেলিমের স্ক্রিপ্ট মূল্যায়ন করেছি। কিন্তু এদের স্ক্রিপ্ট কোন কমিটি মূল্যায়ন করেছে, আদৌ করেছে কি না, তা তো আমরা জানি না। এভাবে তো হতে পারে না।  টেন্ডারে লোয়েস্ট বিড দিলেই তো হবে না, তাদের স্ক্রিপ্ট কেমন, তা আমি জানি না। কিন্তু ফিল্ম মেকিং তো টেন্ডারের বিষয় না। তাদের স্ক্রিপ্ট তো মূল্যায়ন হতে হবে।’

প্রসঙ্গত, কয়েক বছর আগে অপারেশন জ্যাকপটের ঘটনা নিয়ে সিনেমা বানানোর উদ্যোগ নেয় নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়। তখন ছবির চিত্রনাট্য তৈরির দায়িত্ব পান গিয়াস উদ্দিন সেলিম। সে সময় ছবিটির বাজেট ধরা হয় ২৩ কোটি ২৩ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। তবে পরে প্রকল্পটি তদারকির দায়িত্ব পায় মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়। তারা দরপত্র আহ্বান করে। কিন্তু সেখানে আহ্বান করেও বাতিল হয়ে যায় নির্মাতা সেলিমের প্রতিষ্ঠান। এ নিয়ে অনেক বিতর্কও হয়েছিল। সেসব ছাপিয়ে এখন ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নির্মিত হচ্ছে।

আজকালের খবর/আতে