রবিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৫
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনন্য ভূমিকায় ইসলামী ব্যাংক
মোতাহার হোসেন
প্রকাশ: রবিবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৩, ৬:৩১ PM
ব্যাংক খাত দেশের শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থনের মাধ্যমে বেকারত্বের অবসান, গ্রামীণ জনগোষ্ঠির জীবনমানের উন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে অনন্য ভূমিকা রেখে চলেছে। বিশেষ করে শরিয়াহভিত্তিক ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের যাত্রাকাল   থেকেই সুদবিহীন ও জামানতবিহীন ক্ষুদ্র বিনিয়োগ দিয়ে সমাজের অনগ্রসর ও অস্বচ্ছল নারী পুরুষকে আয়বর্দ্ধক কাজে সম্পৃক্ত করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ইসলামী ব্যাংকের এসব ক্ষুদ্র বিনিয়োগ আদায়ের হার প্রায় শতভাগ। এর ফলে ঋণগ্রহীতাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটছে। পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের মতো ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে অনন্য ভূমিকা পলন করছে।

ক্ষুদ্র ঋণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন এনজিওর উচ্চ সূদে ঋণদান, ঋণ আদায়ে কাবলিওয়ালা পদ্ধতি নিয়ে দেশের সাধারণ মানুষ, ভুক্তভোগী, তথা ঋণগ্রহীতাদের ভীতিকর অভিজ্ঞতা রয়েছে। এনজিও ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় সংশ্লিষ্ট ঋনগ্রহীতার আত্মহত্যা, সংসারে অশান্তি, বিচ্ছেদ, মামলা, হয়রানি, টাকার জন্য ঘর-বাড়ি, পুকুরের মাছ, মোরগ, হাঁস নিয়ে যাওয়া, অথবা ঋণের জাল থেকে পরিত্রাণ পেতে ভিটে-বাড়ি ছেড়ে দেশান্তর অথবা অজনার উদ্দেশ্যে পাঁড়ি দেওয়ার অসংখ্য অমানবিক ঘটনা রয়েছে। পক্ষান্তরে শরিয়াহ ভিত্তিক ইসলামী ব্যাংক শ্রেণী বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে ব্যাংকিং সেবা দিয়ে যাচ্ছে। দেশে ব্যাংকিং জগতে মানবিক ব্যাংক হিসেবে ভাগ্য বিড়ম্বিত, অস্বচ্ছল, অসহায়, হতদরিদ্র, দিনমজুর, কাজের বুয়া, আয়া, রিক্সা চালকসহ নিন্ম আয়ের মানুষের ভরসা এবং দুর্দিনে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। বড় বিনিয়োগ গ্রহীতার পাশাপাশি এসব ক্ষুদ্র গ্রহীতারাও বিনিয়োগ পান সহজেই। এসব গ্রহীতার অনেকেই এখন স্বাবলম্বী এবং আত্ম নির্ভরশীল।

১৯৮৩ সালে দেশে প্রথম শরিয়াহ ভিত্তিক ব্যাংকিং কার্যক্রম শুরু করে ইসলামী ব্যাংক। আন্তরিক সেবা ও সততার কারণে শুরু থেকে এই ব্যাংক রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করতে থাকে দ্রুততার সঙ্গে। পাশাপাশি  দেশে প্রথম কোনো ব্যাংক ১৯৯৫ সালে ১০ টাকা দিয়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করার প্রথা চালু করে। বর্তমানে  দেশের ৩৩ হাজার গ্রামের ১৭ লাখেরও বেশী মানুষ ইসলামী ব্যাংকের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের সদস্য যাদের এ ধরনের অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ৯২ শতাংশ গ্রাহকই নারী।

ইসলামী ব্যাংকের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প (আরডিএস) একটি জনপ্রিয়, কল্যাণমূলক, মাবনিক এবং সফল প্রকল্প। এই ব্যাংকের  পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় জামানতবিহীন বিনিয়োগ সহায়তায় এসব পরিবারে এসেছে স্বচ্ছলতা, সুখ, সমৃদ্ধি। পাশাপাশি দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করে দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে সহজে ব্যাংকিং সেবায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ  ব্যাংক ২০১৩ সালে এ বিশেষায়িত ব্যাংকিং  সেবা পরিচালনার অনুমতি দেওয়ার পর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা  দেশে  মোট ২১ হাজার ৪৪৮টি এজেন্ট আউটলেটের আওতায় প্রায় দুই কোটি সাত লাখ আমানত হিসাব খোলা হয়েছে যার প্রায় ৮৬ শতাংশ গ্রামীণ গ্রাহকদের।

এসব গ্রাহকদের আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিতে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে যুক্ত ব্যাংকগুলোর জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ‘প্রুডেনশিয়াল গাইডলাইন ফর এজেন্ট ব্যাংকিং অপারেশন ইন বাংলাদেশ-২০১৭’ প্রণয়ন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং ২০১৭ সালের ১৫ জুলাই কার্যক্রম শুরু করে। এই ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের কার্যক্রম কিছুটা  দেরিতে শুরু হলেও গ্রাহকদের আস্থা ও গ্রহণযোগ্যতায় খুব দ্রুত প্রসার লাভ করে। এই ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং দুই হাজার ৭৫৯টি আউটলেটের মাধ্যমে  দেশব্যাপী ৪৬৮টি উপজেলায় আধুনিক ব্যাংকিং  সেবা দিচ্ছে। এজেন্ট আউটলেটগুলোতে এ পর্যন্ত ৪২ লাখ ৮১ হাজার হিসাব  খোলা হয়েছে  যেখানে ডিপোজিটের পরিমাণ ১৪ হাজার ২০০ কোটি টাকা।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের ব্যাংকিং  সেবা পাওয়ার সুযোগ  সৃষ্টি করেছে এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এখানে শাখার মতোই বিভিন্ন ধরনের সেবা নিচ্ছেন গ্রাহকরা। এ-টু আই-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে সব ধরনের ইউটিলিটি বিল  দেওয়া ও ইন্সুরেন্স প্রিমিয়াম সংগ্রহের ব্যাপক পরিষেবা দিয়ে যাচ্ছে এজেন্ট আউটলেটগুলো। এ ব্যাংকের এজেন্টগুলোর দৈনিক  লেনদেন প্রায় এক হাজার  কোটি টাকা। এই ব্যাংকের বিশাল  নেটওয়ার্কেও মাধ্যমে বিদেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স সহজেই উত্তোলন করতে পারেন প্রবাসীদের স্বজনরা। রেমিট্যান্স আহরণে শীর্ষ স্থানে থাকা এই ব্যাংক একই সঙ্গে এজেন্ট ব্যাংকিংয়েও দেশের শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে।

২০২৩ সালে ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকদের ১৩ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা রেমিট্যান্স এসেছে যা দেশের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আহরিত রেমিট্যান্সের ৬০ শতাংশের ওপরে। কোনো  কোনো দিন  দৈনিক রেমিট্যান্স সরবরাহ হয় প্রায় ১২০ কোটি টাকার ওপরে।

ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রদত্ত সব নিয়ম-কানুন মেনে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে গ্রাহক  সেবা দিয়ে যাচ্ছে। যেমন বাংলা কিউআর কোডের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করা,  গ্রাহকদের শতভাগ ডিজিটাল কানেক্টিভিটি বাড়ানো,  ফাস্ট মুভিং কনজুমার গুডস কোম্পানি ও অন্যান্য কোম্পানির এপিআই কেন্দ্রীক অনলাইন  লেনদেনের উদ্যোগসহ বিভিন্ন প্রকল্প এজেন্ট ব্যাংকিং জগতে নতুন দ্বার উন্মোচন করছে। তা ছাড়া গ্রাহকদের আমানত শতভাগ নিরাপদ রাখতে ‘টু ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন’ এর মাধ্যমে লেনদেন নিশ্চিত করা, জাতীয় পরিচয় পত্র, ওটিপি, ওবায়োমেট্রিক ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে গ্রাহকের আমানত ও লেনদেন শতভাগ নিরাপদ করা হয়।

ইতোমধ্যে ইসলামী ব্যংকের ১৩৮টি এজেন্ট আউটলেটে ব্যাংকের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বিনিয়োগ বিতরণ শুরু হয়েছে। ৭০০ কোটি টাকার উপরে বিনিয়োগ বিতরণ করেছে ইসলামী ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।

বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে দেড় লাখ গ্রাহক ইসলামী ব্যাংকের এজেন্টের মাধ্যমে সেবা নিচ্ছে। পিওএস ও অন্য ব্যাংকের কার্ডে নগদ টাকা উত্তোলন, ই-কেওয়াইসি কার্যক্রম জোরদার করা, সেলফিনের মাধ্যমে ক্যাশ ইন ও ক্যাশ আউট করা,  সামাজিক সুরক্ষা ভাতা দেওয়া, কিউআর কোডসহ অন্যান্য লেনদেন পরিচালনার সক্ষমতা ইত্যাদি পদক্ষেপগুলো দেশের এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে।

সব মিলিয়ে ইসলামী ব্যাংকের এ পর্যন্ত ব্যাংকের সকল শাখা ও উপশাখায় সফলভাবে ব্যাংকিং কার্যক্রম চলছে। বেড়ে চলেছে আমানত ও বিনিয়োগের পরিমাণ। ৩১ ডিসেম্বর ২০২২-এ যেখানে ব্যাংকের আমানত ছিলো এক লাখ ৪১ হাজার ২০০ কোটি টাকা যা ৩০ জুন ২০২৩ এ ছিল এক লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা এবং বর্তমানে ব্যাংকের আমানত দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৫২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। ডিসেম্বর ২০২২-এর তুলনায় আমানত বেড়েছে ১১ হাজার কোটি টাকা। আমানতের এই পরিমাণ দেশের সরকারি,  বেসরকারি সকল ব্যাংকের মধ্যে সর্বোচ্চ। দেশে বিদেশে অবস্থানরত প্রায় দুই কোটি গ্রাহকের অকুণ্ঠ ভালোবাসায় ব্যাংক অব্যাহত গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে চলছে, এগিয়ে যাবে।

গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল করতে ইসলামী ব্যাংকের পল্লী উন্নয়ন প্রকল্প এবং এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা ইতোমধ্যে মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস অর্জনে সক্ষম হয়েছে। রেমিট্যান্স আহরণ, সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়ন, কৃষির উন্নয়ন,  দারিদ্র বিমোচন, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসায় সহায়তায় অনন্য এক ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক। এ ব্যাংকের অগ্রযাত্রা ও সফলতায় ঈর্ষান্বিত হয়ে অপপ্রচারসহ নানান ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে একটি মহল। মূলত আর্থিক শৃঙ্খলা নষ্ট করে দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধ্বংসের লক্ষ্যে এ ষড়যন্ত্র। ব্যাংকিং সেক্টর হচ্ছে শরীরের রক্ত প্রবাহের মতো। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অগ্রযাত্রা, কর্মসংস্থান, দারিদ্র বিমোচনে অর্থপ্রবাহ সচল রাখার স্বার্থে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন। নুতবা শুধু সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশ ও মানুষ, ব্যাহত হবে উন্নয়ন-অগ্রযাত্রা, দারিদ্র বিমোচন ও কর্মসংস্থানের মহা কর্মযজ্ঞ।

মোতাহার হোসেন : উপদেষ্টা সম্পাদক, দৈনিক ভোরের আকাশ এবং সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম।

আজকালের খবর/আরইউ