
রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর পূর্ব এবং পশ্চিমের দুই চীফ কমান্ড্যান্ট এর বদলীর পর চট্টগ্রামে আতংক ছড়িয়ে পড়ে বাহিনীর সদস্যদের মাঝে। উপপরিচালক (পার্সোনেল ১) জান্নাতুল ফেরদৌস জিসা সাক্ষরিত এক আদেশে সোমবার (৮ ডিসেম্বর) পূর্বাঞ্চলের চীফ কমান্ড্যান্ট আশাবুল ইসলামকে পশ্চিমাঞ্চলে এবং পশ্চিমাঞ্চলের চীফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলামকে পূর্বাঞ্চলে বদলীর আদেশ করা হয়।
এই বদলীর তথ্য প্রকাশের পর থেকে এটিকে সমঝোতার বদলী বলছেন অনেকে। কেউ কেউ বলছেন পূর্বাঞ্চল সঠিক ভাবে সামাল দিতে না পারায় আশাবুল ইসলামকে বদলী করা হয়েছে।
মূলত পূর্বাঞ্চলে রাজনৈতিক প্রভাব, বিভিন্ন আঞ্চলিক কোরাম গঠন, অনৈতিক ভাবে টাকা দিয়ে প্রভাব শালী পোষ্ট ধরে রাখা সহ নিয়ম নীতির বাহিরে কার্যক্রম সামাল দেয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। যা বাহিনীর শৃঙ্খলাকে আরো অধিক নষ্ট করে দিয়েছে গত এক বছরে। ধারণা করা হয়েছিল আশাবুল ইসলাম পূর্বাঞ্চলে এসে বাহিনীর অতিতের সমস্যা গুলো সমাধান করবেন। কিন্তু আশানুরূপ ফলাফল দেখা মেলেনি তাতে।
বলা হয় এর আগে পূর্বাঞ্চলে কুমিল্লা এবং বরিশাল বিভাগের লোকদের দ্বারা বাহিনীর ভিতরে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট ছিলো। যারা পূর্বাঞ্চলের রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কনট্রোল করতো সেসময়।
বিশেষ করে এতে অনেকেই আগের চীফ কমান্ড্যান্ট জহিরুল ইসলামকে চাপে ফেলে বিভিন্ন সুবিধা লুটে নেয়ার তথ্য ভেসে ওঠে। যার কারণেই জহিরুল ইসলামের নামে বিভিন্ন অপবাদ ছড়িয়ে যায় সে সময়। এতে বাহিনীর কিছু দুষ্টু স্বভাবের হাবিলদার ও ইন্সপেক্টর জড়িত ছিলো সেসময়।
অন্যদিকে আশাবুল ইসলাম পূর্বে বদলীর পর সেখানে আগের চেয়ে অনিয়ম দূর্নীতি বেড়ে যায়। সেখানেও প্রভাবশালী কিছু সদস্যদের বেপরোয়া আচরণ অনিয়ম দুর্নীতির বিরুদ্ধে গত এক বছরে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি তিনিও।
সূত্রে জানা যায়, মব জাস্টিস এর মাধ্যমে অফিস ঘেরাও দিয়ে সুবিধাজনক স্থানে বদলী করানোর মত ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া পছন্দ মত জায়গায় দায়িত্ব বাগিয়ে নিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের দিয়ে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে বাহিনীর আইনকে ভঙ্গুর করে দিতেও কাজ করেছে একটি অসৎ সিন্ডিকেট।
তবে গুঞ্জন আছে, জহিরুল ইসলাম এর সময়ে একই কায়দায় তাকেও লাঞ্ছনা করেছে কিছু প্রভাবশালী সদস্যরা।
যার সব'ই হয়েছে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রশ্রয়ে থাকা বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে। অথচ বাহিনীর আইনে স্পষ্ট ভাবে লিখা আছে বাহিনীর কোন সদস্য রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকতে পারবে না। এসবের তোয়াক্কা না করে বাহিনীর সদস্যরা সরাসরি রাজনীতির মাঠে থাকতেন। থাকতেন বিভিন্ন ব্যানার ফেস্টুন আর গরম করে রাখতেন ফেইসবুকের মত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
করতেন বিভিন্ন এমপি মন্ত্রী সহ স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিদের তোষামোদি।
গত ৮ ডিসেম্বর দুই চীফের বদলীর আদেশে চট্টগ্রাম জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এক অনাজা অতংক। এই বদলীর গুঞ্জন শুনা যাচ্ছিলো গত মাসখানেক ধরে। এতেই অনেকে পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন, কে কোথায় নতুন করে আকামের ঢেকি খুলবেন আর আগের মত কোরাম ঠিক করে আবারো বিভিন্ন অপরাধ সৃষ্টি অনৈতিক সুবিধা নিবেন। অন্যান্য দিকে যারা আশাবুল ইসলামের আস্থা ভাজন ছিলেন, তারাও এখন বদলী আতংকে আছেন।
ধারণা করা হচ্ছে গত এক বছরে পূর্বাঞ্চলে ৪-৫শ জন সদস্যকে বদলী করা হয়েছে বিভিন্ন স্টেশন চৌকি সহ চট্টগ্রাম জেলা-বিভাগের বাহিরে। বিশ্বস্ত একাধিক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য মতে জানা যায়, মোট এই বদলীর ৭০-৮০ শতাংশ বদলী হয়েছে অনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে। অন্যদিকে আলাদিনের চেরাগ খ্যাত বাহিনীর সদস্যদের হয়নি কোথায় বদলী। বরং তারা নানান অপরাধ করেও থেকে গেছেন একই কর্মস্থলে।
এছাড়াও বাহিনীতে কোনো গুরুতর অপরাধ সংঘটিত হলে সেটাও ধামাচাপা পড়তো কথিত তদন্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে।
এছাড়া জুনিয়র অফিসার দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সার্কেল পরিচালনা করা, এএসআইদের মূল্যায়ন না করে হাবিলদার দিয়ে সাব সার্কেল পরিচালনা করানো, বিতর্কিত সদস্যদের পুনরায় চট্টগ্রামে পুনর্বাসন করা ও পছন্দের ইউনিট ইনচার্জদের তাদের মন মত দায়িত্ব দিয়ে রাখা, অধিক অপরাধ করার পরেও স্বজনপ্রীতির আড়ালে বাহিনীর আইনকে দেখানো হয়েছে বৃদ্ধা আঙ্গুলি। এছাড়াও নানান জটিলতা বাঁধে গত এক বছরে।
চলতি দায়িত্ব প্রাপ্ত চীফ কমান্ড্যান্ট আশাবুল ইসলামের নামে দুদকের চলমান মামলার কারণে অনেকেই আরো অধিক বেপরোয়া হয়ে গেছে বলেও জানা যায়। একজন প্রধানের নামে দুদকে মামলা থাকাকে পুঁজি করে অনেকে অন্যায় করে গেছেন দেদারসে। এ যেন এক অসাংবিধানিক অনধিকার চর্চার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল পূর্বাঞ্চলে।
এছাড়া লোকবল সংকটের মূহুর্তে প্রায় স্টেশনে ভগবান ডিউটি করা, কর্ম না করেও ভুয়া টিএ বিল তৈরী করা, বিলের পারসেন্টিজ বন্টন করা, মৌখিকভাবে রেঙ্ক ধারীদের বিরুদ্ধে সমালোচনার পরেও সেটিকে সম্মানসূচক অবস্থানে না নেয়া, টিকিট কালোবাজারির সাথে সম্পৃক্ত থাকা, মাদকের মামলায় জড়িত থাকা, বিভিন্ন সার্কেল চৌকির ইন্সপেক্টর ও ইউনিট ইনচার্জদের সাদা পোষাকে ডিউটি করা, রাজনীতিতে জড়িত থাকা, ইচ্ছা মত অফিসে আসা যাওয়া, ৮ ঘন্টার ডিউটিতে কর্মফাঁকি দেয়া, অসুস্থ দেখিয়ে কর্ম না করা, ৩-৪ শ টাকার বিনিময়ে অতিরিক্ত ছুটি কাটানো, তেল চুরি সহ বিভিন্ন চুরির সাথে জড়িত থাকা, নিজেরা নিজেরা মারামারি করা, কর্মস্থলে জুয়া খেলা, দখলদারদের থেকে মাসোহারা নেয়া সহ ইত্যাদি অন্যায় চলমান ছিলো।
অধিক গুরুত্বপূর্ণ অপরাধের মধ্যে ছিলো, মাসের পর মাস চীফ কমান্ড্যান্ট এর বাসায় বাহিনীর আইবি-এবি'র সদস্যদের ফরমায়েশ খাটানো এবং তাদের নামে ভুয়া টিএ বিল তৈরী করে রাষ্ট্রের টাকা আত্মসাৎ করা।
এত সব অনিয়ম দুর্নীতির আখড়ার মধ্যে নতুন কোন চীফ কমান্ড্যান্ট না আসারই কথা। তবু বদলী যেহেতু একটি নিয়মতান্ত্রিক বিষয় এটি তারই ধারাবাহিক অংশ।
চীফ কমান্ড্যান্ট, কমাড্যান্ট সঠিক সময়ে বা তার আগে পরে বদলী হলেও পূর্বাঞ্চলে ১৫-২০ জন অধিক ক্ষমতাশালী ইন্সপেক্টর , সাব ইন্সপেক্টর, হাবিলদার, নায়েক ও সিপাহিদের দীর্ঘদিন একই জেলা, একই অফিসে ৩ বছরের অধিক, ১ যুগ বা তার বেশী সময় ধরে রয়ে যাওয়ার ঘটনাও প্রভাবিত করেছে বাকি সদস্যদের। একটি পদের বিপরীতে সহায়ক কোন পদ না থাকায় এখানে হাতে কলমে শিখার চেয়ে টাকার অংকে পরিবর্তন ও একই পদে থেকে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা বেড়ে যেত। বাহিনীর সুবিধার্থে এসব ধীরে ধীরে পরিবর্তন করার কথা বললেও, এসব বিষয়ে আশাবুল ইসলাম কর্ণপাত করেনি কখনো।
পূর্বাঞ্চলের চীফ কমান্ড্যান্ট আশাবুল ইসলামের এই চলমান বদলীর আগে থেকে তিনি ঢাকায় অবস্থান করাকে কেন্দ্র করে আবারো গুঞ্জন উঠেছে, তিনি তার বদলী ঠেকাতে মরিয়া। অথচ বিগত ছয়মাস আগেই তিনি জানিয়েছিলেন, এখনই বদলী হলে বাচ্চাদের স্কুলের পড়ালেখার ক্ষতি হবে, তাই বদলী যদি হয়েই যায়, তবে সেটি নভেম্বর ডিসেম্বরে হলেই ভালো হবে।
দীর্ঘদিন ধরে চলমান দুদকের মামলা থেকে তিনি সহ সকলেই খালাস পাওয়ার পরেও সবচেয়ে বেশী আলোচনায় রয়েছে পূর্বাঞ্চলের চীফ কমান্ড্যান্ট আশাবুল ইসলামের দুদকের মামলা চলাকালীন সময়ে কমাড্যান্ট থেকে চীফ কমান্ড্যান্ট পদে তার প্রমোশন পাওয়া বিষয়টিকে কেন্দ্র করে।
এবিষয়ে বিস্তারিত জানতে চট্টগ্রাম দুদক কার্যালয়ে গেলে দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, এ মামলার বিস্তারিত জানতে আদালতের রায়ের কপি সংগ্রহ করার পরামর্শ দেন এবং দুদকে মামলা চলাকালীন সময়ে তথ্য গোপন করে প্রমোশন নেয়ার বিষয়ে ওই কর্মকর্তা কিছু জানেন না বলেই মন্তব্য করেন তখন।
উল্লেখ্য যে, ২০১৭ সালে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনির ১৮৫ সিপাহি নিয়োগে ব্যাপক অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগে (কমাড্যান্ট থাকাকালীন) আশাবুল ইসলামের নামেও দুদকের মামলায় নাম উঠেছিল।
সিজিপিওয়াইতে কর্মরত দুইজন সদস্যদের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগের তথ্য উঠলে, তাদের বলদী করার কথা থাকলেও তার আগেই আপনার বদলী হয়ে যাচ্ছে মর্মে প্রতিবেদক মন্তব্য করলে আশাবুল ইসলাম জানান, তিনি এখনো দায়িত্বে আছেন।
সুশৃংখল একটি বাহিনী কিভাবে দিনের পর দিন শৃঙ্খলা বিহীন মূল্যহীন ও বেপরোয়া হয়েছে, এসব বিষয়ে বিস্তারিত চলমান থাকবে।
আজকালের খবর/ এমকে