
বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীর দখলে থাকা মিয়ানমার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অশান্ত একটি রাষ্ট্র। এই দুর্বল রাষ্ট্র কাঠামো, গভীর দুর্নীতি আর দীর্ঘমেয়াদি সামরিক-রাজনৈতিক সংকট মিলিয়ে দেশটি এখন বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ মাদক উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে “গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল” নামে পরিচিত অঞ্চল- যা মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও লাওসকে কেন্দ্র করে, এই অঞ্চলটি দীর্ঘদিন ধরেই ইয়াবা ও ক্রিস্টাল মেথ উৎপাদনের প্রধান ঘাঁটি। এই বিশাল অপরাধ নেটওয়ার্কের প্রথম লক্ষ্যবস্তু এখন বাংলাদেশ, কারণ এখানকার জনসংখ্যার বিশাল একটি অংশ যুবক ও তরুণ। এখানকার ভোক্তা বাজার ক্রমবর্ধমান, আর ভৌগোলিক অবস্থান অপরাধীদের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক। সেই সুযোগে মিয়ানমারের মাদক আজ বাংলাদেশের সমাজ, পরিবার, রাষ্ট্রব্যবস্থা আর অর্থনীতিকে গভীর থেকে গভীরতর ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তজুড়ে নাফ নদী, পাহাড়ি অরণ্য, গহীন পথ এবং বিচ্ছিন্ন বসতির সুযোগে মাদক ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত সহজেই প্রবেশপথ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। কখনো ট্রলার, কখনো মাছ ধরার নৌকা, কখনো পর্যটকের গাড়ি, আবার কখনো সাধারণ মানুষের ব্যাগ বা মালপত্রের আড়ালে বিপুল পরিমাণ ইয়াবা বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। এমনকি এখন অনলাইনে অর্ডার নেওয়া, কুরিয়ার প্যাকেটে লুকিয়ে পাঠানো, কিংবা অ্যাপভিত্তিক ডেলিভারি ব্যবহার করে মাদক বিতরণ করা হচ্ছে। এই সবকিছুই স্পষ্ট করে যে, মাদকের অর্থনীতি এখন আর ছোটোখাটো কোনো অপরাধ নয়- এটি একটি সুসংগঠিত, প্রযুক্তিনির্ভর, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অপরাধচক্র, যা পুরো বাংলাদেশের নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জ করছে।
মাদকের সবচেয়ে ভয়াবহ ক্ষতি হয় ব্যক্তির জীবনে। ইয়াবা বা আইস কয়েক মাস নিয়মিত গ্রহণ করলেই একজন যুবকের মানসিক স্থিতি সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। তার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে যায়, চিন্তাশক্তি নষ্ট হয়, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা ক্ষয়ে যায়, আত্মগ্লানি ও হ্যালুসিনেশন বা কল্পনার জগৎ শুরু হয়, এবং অনেক ক্ষেত্রে আত্মহত্যাপ্রবণতা পর্যন্ত তৈরি হয়। শারীরিকভাবে এই মাদক হার্ট, কিডনি, লিভার, ব্রেইন- সবকিছুর ওপর ভয়াবহ আঘাত হানে। মাত্র কয়েক মাসেই একজন মানুষের চেহারা বুড়িয়ে যায়, শরীর ভেঙে পড়ে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যায়। আর্থিকভাবে তারা পরিবারকে নিঃস্ব করে তোলে, টাকা ফুরিয়ে গেলে তারা চুরি করে, ছিনতাই করে, ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করে, এমনকি অপরাধচক্রে জড়িয়ে পড়ে।
এই ক্ষতির সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী হলো পরিবার। মাদকাসক্ত ছেলের কারণে বাবা-মা সারাজীবন মানসিক যন্ত্রণায় ভোগেন। সংসারে অশান্তি তৈরি হয়, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক নষ্ট হয়, ঝগড়া-বিবাদ বাড়ে, সন্তানরা ভয় আর অস্থিরতার মধ্যে বড় হয়। একসময়ের সুখী পরিবার ধীরে ধীরে চাপা যন্ত্রণার একটি ঘরে পরিণত হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়- মাদকাসক্ত স্বামীর কারণে স্ত্রী নিয়মিত নির্যাতনের শিকার হন, সন্তানরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে, আর পরিবার অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে। একটা মানুষ যখন মাদকের কারণে পতনের দিকে যায়, সে একা পড়ে না- তার সাথে ডুবে যায় তার পুরো পরিবার।
সমাজেও মাদকের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে আগুনের মতো। অপরাধ বাড়ে, ছিনতাই, ধর্ষণ, খুন, মারামারি ও গ্যাং কালচার বিস্তার লাভ করে। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ক্যাম্পাসে মাদক নতুন এক ‘ফ্যাশন’ হিসেবে ঢুকে পড়ছে। অনেক তরুণ নিজের ভবিষ্যতের শক্তি, বুদ্ধিমত্তা, সৃজনশীলতা সব নষ্ট করে দিচ্ছে কয়েকটা ট্যাবলেটের পেছনে। সমাজে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে, পাড়ায়-পাড়ায় অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে, রাতের শহরে ছুটে বেড়াচ্ছে মাদকাসক্ত গ্যাং- যারা নিজেরাও ধ্বংস হচ্ছে, অন্যকেও ধ্বংস করছে। আইসের প্রভাবে মানুষ কিছু মুহূর্তের জন্য নিজেকে ‘অপরাজেয়’ মনে করে, আর সেই ভুল ধারণা থেকেই ঘটে সবচেয়ে বড় অপরাধ।
দেশের অর্থনীতিতে মাদকের ক্ষতি আরো বেশি গভীর। মাদকাসক্ত যুবক দেশের উৎপাদনশীল শ্রমশক্তি থেকে ছিটকে পড়ে। সে চাকরি হারায়, কাজের মান কমে যায়, শিল্প-কারখানায় দুর্ঘটনা বাড়ে, কর্মক্ষম শ্রমশক্তির ঘাটতি দেখা দেয়। রাষ্ট্রকে মাদকাসক্তদের চিকিৎসা, পুনর্বাসন, পুলিশিং, তদন্ত, এবং কারাগারে রাখার জন্য বিপুল অর্থ ব্যয় করতে হয়। এর ফলে স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেমন চাপে পড়ে, তেমনি আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। দেশের সামগ্রিক উৎপাদনশীলতাও কমে যায়। অর্থনীতিকে সচল রাখতে যে তরুণশক্তি দরকার, মাদক সেই শক্তিকে ভিতর থেকে খেয়ে ফেলছে।
সবচেয়ে বড় ক্ষতি হচ্ছে জাতির ভবিষ্যতের। বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি যুবশ্রেণি। এই যুবশক্তিই দেশের শিল্প, প্রযুক্তি, শিক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, সৃজনশীলতা ও অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। দেশকে এগিয়ে নেয়ার জন্য যে তরুণেরা নেতৃত্ব দেবে, গবেষণা করবে, নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, শিল্প গড়ে তুলবে, নতুন নতুন উদ্যোগ নেবে- সেই যুবসমাজের একটি বড় অংশ যদি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, তাহলে ভবিষ্যতই নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা হারাবো সম্ভাবনাময় একটি প্রজন্ম। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যা ঘটছে, তা একটি বড় সতর্কবার্তা। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ইয়াবা এবং আইসের বিস্তার একটি জাতীয় বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয়। ক্লাস ফাঁকি দেয়া, পরীক্ষায় খারাপ ফল, সহিংসতা, গ্যাংভুক্তি- সবকিছুই বলে দিচ্ছে, মাদক আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার শেকড় পর্যন্ত ঢুকে গেছে।
রাষ্ট্রের নিরাপত্তাও ঝুঁকির মুখে। মাদক ব্যবসা কখনো একা চলে না- এর সাথে থাকে অস্ত্র ব্যবসা, মানবপাচার, জঙ্গি বা সন্ত্রাসী অর্থায়ন, বিদেশি অপরাধচক্রের প্রভাব, আর দুর্নীতির জাল। মাদক কারবারিরা যেহেতু অল্প সময়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে, তাই তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের ভেতরেও প্রভাব বিস্তার শুরু করে। স্থানীয় রাজনীতি, প্রশাসন, ব্যবসা- সবখানেই তারা শিকড় গাড়ার চেষ্টা করে। রাষ্ট্রের ভেতরেই একটি “অন্ধকার অর্থনীতি” তৈরি হয়, যা বৈধ অর্থনীতিকে দুর্বল করে দেয় এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ফাটল ধরায়। ফলে মাদক আর শুধু ব্যক্তির অপরাধ থাকে না, এটি জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি হয়ে ওঠে।
এই পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় তরুণেরা- বিশেষ করে ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সীরা। এরপর ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিক্ষার্থীরা, বেকার তরুণেরা, শ্রমজীবী মানুষ, নারী এবং শিশুরা। যারা এইসব পরিবারের মধ্যে বড় হচ্ছে তারা ভবিষ্যতে নতুন এক সামাজিক সংকটে পরিণত হতে পারে। মাদক একটি সমাজকে শুধু আজকে ধ্বংস করে না, আগামী দশ-বারো বছর পরের ভবিষ্যতকেও অন্ধকারে ঢুকিয়ে দেয়।
এখন প্রশ্ন হলো- এ সংকট সমাধানের উপায় কী? প্রথমত, সীমান্ত নিরাপত্তা বহুগুণ শক্ত করতে হবে। নাফ নদী, পাহাড়ি সীমান্ত, উপকূল- সবকিছু প্রযুক্তি নির্ভর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। দ্বিতীয়ত, মিয়ানমারকে কূটনৈতিক চাপের মুখে ফেলতেই হবে। তারা সংকট তৈরি করেছে, তারা দায় এড়াতে পারে না। তৃতীয়ত, দেশের ভেতরের দালালচক্রকে ধরতে হবে- যারা মূলত নোংরা লাভের লোভে একটি দেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভেতরকার দুর্নীতিও নির্মূল করতে হবে। চতুর্থত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পরিবারকে আরো সচেতন হতে হবে। তরুণদের বোঝাতে হবে- মাদক কোনো আনন্দ নয়, বরং ধ্বংসের নিশ্চিত পথ। পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোকে আধুনিক করতে হবে, যাতে মাদকাসক্তরা ফিরে আসার সুযোগ পায়।
শেষ কথায় যা বলতে চাই তাহলো- মিয়ানমারের মাদক আজ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নীরব শত্রু। এটি আমাদের ঘর দখল করছে, পরিবার ধ্বংস করছে, সমাজকে দুর্বল করছে, অর্থনীতিকে ভেঙে দিচ্ছে, আর সবচেয়ে বড় কথা- একটি সম্ভাবনাময় জাতির ভবিষ্যতকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করছে। এখনই যদি কঠোর পদক্ষেপ না নেয়া হয়, তাহলে আমরা এমন একটি প্রজন্ম হারাবো, যারা বাংলাদেশকে আরো বহু দূর এগিয়ে নিতে পারত। মাদক-বিরোধী লড়াই আজ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্ব নয়- এটি পুরো জাতির যুদ্ধে রূপ নিয়েছে। নিজেদের ভবিষ্যত রক্ষার জন্যই এখন এই যুদ্ধে জয়ী হওয়া প্রয়োজন; এর কোনো বিকল্প নেই।
লেখক: সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
আজকালের খবর/