ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) আলোচনা অনুষ্ঠানে হট্টগোলের মধ্যে ‘মব হামলার’ শিকার হওয়ার পর পুলিশ হেফাজাতে থাকা সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিকসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে মঞ্চ ৭১ নামের একটি সংগঠনের গোলটেবিল আলোচনায় অংশ নেওয়া এই ১৪ জনসহ ১৫ জনের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে শাহবাগ থানায় মামলা করার তথ্য দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত কমিশনার মো. শফিকুল ইসলাম।
রাতে তিনি বলেন, “আমরা তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা করছি। এদের মধ্যে নয়জন শাহবাগ থানায় রয়েছেন। তাদের মিন্টো রোডে গোয়েন্দা কার্যালয়ে নিয়ে আসা হচ্ছে।”
এদিন দুপুরে ডিআরইউর শফিকুল কবির মিলনায়তনে ‘আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের সংবিধান’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে ‘মঞ্চ ৭১’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম।
এ প্ল্যাটফর্মের সমন্বয় করছেন গণফোরামের নেতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আল মাহমুদ (বীর প্রতীক) ও সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। বৃহস্পতিবারের ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল গণফোরামের সাবেক সভাপতি কামাল হোসেনের। তবে তিনি আসার আগেই সেখানে একদল ব্যক্তি হট্টগোল শুরু করে। তাদের হামলায় আহত হন অনেকে।
দুপুরের ওই ঘটনার পর ডিআরইউ থেকে সাবেক মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক অধ্যাপক মেজবাহ কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন ও সাংবাদিক মনজুরুল ইসলাম পান্নাসহ বেশ কয়েকজনকে পুলিশের গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যেতে দেখা যায়।
পরে তাদের মধ্যে কয়েকজনতে মিন্টো রোডে এবং কিছু ব্যক্তিকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যাওয়া হয় বলে খবর আসে। তবে পুলিশ তাদের কারও নাম জানায়নি। রাত ১০টা অবধি তাদের আটক করার বিষয়েও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু বলেনি।
রাত সাড়ে ১০টার পরে তাদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেপ্তার দেখানো হবে বলে বলেন অতিরিক্ত কমিশনার শফিকুল। এর কিছু সময় পর তিনি মামলা হওয়ার তথ্য দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার দেখানোর কথা বলেন।
তবে ডিআরইউ থেকে পুলিশের গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া কাদের কাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে তাদের নাম বলেননি তিনি।
ডিআরইউতে গোলটেবিল বৈঠকে হট্টগোল শুরুর পর ‘মব’ তৈরি করে হামলার মুখে অতিথিসহ অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে যাওয়ার সময় তখন পুলিশ জানিয়েছিল, মব হামলার মুখে নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
এর আগে সেখানে ‘জুলাইযোদ্ধা’ পরিচয়ে আল আমিন রাসেলের নেতৃত্বে কয়েকজন গিয়ে উপস্থিত লোকজনদের ঘেরাও করেন।
অনুষ্ঠানে আসা বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা বলেন, “আমি এখানে প্রোগ্রামে এসেছি। দল মতের হিসাবে নয়, এখানে সব মুক্তিযোদ্ধাদের ডাকা হয়েছে; তাই এসেছি।
“আমরা প্রোগ্রাম শুরু করেছিলাম। লতিফ সিদ্দিকী সাহেব এসেছেন। কামাল হোসেন সাহেব আসেননি। ২০/২৫ জন ছেলে এসে হট্টগোল করে। আমাদের ঘিরে ফেলে।”
লতিফ সিদ্দিকীকে ঘিরে কয়েকজন তরুণ লাফাতে লাফাতে স্লোগান দেয়, ‘একটা একটা লীগ ধর, ধইরা ধইরা জেলে ভর’- এরকম ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধাকে মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
অনুষ্ঠানস্থলে কেশব রঞ্জন সরকার নামের একজন মারধর করে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া হয়। আর রিপোর্টার্স ইউনিটি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর মারধরের শিকার হন জাসদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও স্থায়ী কমিটির সদস্য আব্দুল্লাহিল কাইয়ূম।
‘মব সৃষ্টির’ ঘটনায় ডিআরইউর নিন্দা
রাতে ওই আলোচনা সভা ও সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় নিন্দা জানিয়ে প্রতিবাদলিপি দিয়েছে ঢাকার প্রতিবেদকদের সংগঠন ডিআরইউ।
এতে বলা হয়েছে, “ডিআরইউ’র একটি গোলটেবিল বৈঠকে বৃহস্পতিবার কতিপয় বহিরাগতদের হামলাকে কেন্দ্র করে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। একদল ব্যক্তি নিজেদের ‘জুলাইযোদ্ধা’ হিসেবে পরিচয় দিয়ে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান (কার্জন), সাবেক সচিব আবু আলম শহীদ খানসহ কয়েকজনকে অবরুদ্ধ করে রাখে।
”এসময় তাদেরকে নিবৃত্ত করতে গেলে ডিআরইউ সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মান্নান মারুফ, সদস্য আসিফ শওকত কল্লোল, সৈয়দ মাহবুব মোর্শেদসহ কয়েকজনকে নাজেহাল করা হয়।”
এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে সংগঠনের সভাপতি আবু সালেহ আকন ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল ঘটনার বলেন, “ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি সবার জন্য উন্মুক্ত। সবারই মত প্রকাশের স্বাধীনতা রয়েছে। এখানে অনুষ্ঠান করার বিষয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই। এই অনুষ্ঠান ঘিরে কতিপয় লোক গতকালই (বুধবার) ফেইসবুকে হুমকি দিয়ে প্রচারণা চালায়। এর প্রেক্ষিতে শাহবাগ থানাকে অবহিত করার পর বৃহস্পতিবার সকাল থেকে ডিআরইউ প্রাঙ্গণে পুলিশ দায়িত্ব পালন করে।
”অনুষ্ঠানটি উন্মুক্ত হওয়ায় হঠাৎ করেই একদল লোক অনুষ্ঠানস্থলে প্রবেশ করে মব সৃষ্টির চেষ্টা করে। ডিআরইউ নেতারা এবং সদস্যদের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। এরপর পুলিশকে অবহিত করার পর তারা এসে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে আবদুল লতিফ সিদ্দিকীসহ কয়েকজনকে তাদের হেফাজতে নিয়ে যায়।”
ডিআরইউ নেতারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, ছাত্র-জনতার জুলাই বিপ্লবের সময়েও ডিআরইউতে সবার কথা বলার সুযোগ ছিল।
"গণ অভ্যুত্থান চলাকালে তৎকালীন সরকারের বাধার মুখেও আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া নাহিদ, সারজিস ও হাসনাতরা এখানে কথা বলেছেন।
”আগামী দিনে কেউ এর ব্যত্যয় ঘটালে ডিআরইউ তা প্রতিহত করবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”
লতিফ সিদ্দিকীর বাড়ির নিরাপত্তায় পুলিশ
এদিকে ডিআরইউ এর ঘটনার পর সাবেক মন্ত্রী এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক লতিফ সিদ্দিকীর টাঙ্গাইলের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাটের একটি ভিডিও বিকালের পর থেকে ফেইসবুকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
এদিন সন্ধ্যার পর থেকে ভিডিওটি ভাইরাল হলে দেশ জুড়ে আলোচনা সৃষ্টি হয়। পুলিশ ও স্থানীয়দের বরাতে জানা গেছে, আগুন দেওয়ার ঘটনাটি গুজব।
কালিহাতী থানা সংলগ্ন লতিফ সিদ্দিকীর গ্রামের বাড়ির নিরাপত্তায় পুলিশ মোতায়েন করার তথ্য দিয়ে কালিহাতী থানার ওসি জাকির হোসেন বলেন, আগুনের ঘটনাটি গুজব।
৪০ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ভবনের ভিডিও ছড়িয়ে তাতে লতিফ সিদ্দিকীর নাম দেওয়া হয়েছে। ভবনটিতে আগুন জ¦লছে। সেখানে জনতা ভিড় করছেন। কিন্তু ভিডিওটি সম্পূর্ণ মিথ্যাও গুজব।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর একান্ত সচিব ফরিদ আহমেদ বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটি গুজব। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লতিফ সিদ্দিকীর বাসায় নিরাপত্তা দিয়ে রেখেছেন।
আজকালের খবর/ এমকে