চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় বিএনপির দুগ্রুপে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকারসহ অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। ভাঙচুরের পাশাপাশি কয়েকটি যানবাহনে আগুন দেওয়া হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত সেখানে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) বিকাল ৪টার দিকে রাউজান পৌরসভার ছত্তারহাট এলাকায় এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ওই ঘটনায় আহতদের মধ্যে কয়েকজন হলেন- রাউজান উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাসিম উদ্দিন চৌধুরী, গোলাম আকবর খোন্দকারের ব্যক্তিগত সহকারী অর্জুন কুমার নাথ ও এপিএস আসিকুর রহমান, যুবদল নেতা সাজ্জাদ হোসেন, বিএনপি নেতা আওরঙ্গজেব সম্রাট, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রদলের সহসভাপতি নাঈম উদ্দিন মিনহাজ, মোহাম্মদ হুমায়ুন প্রমুখ।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গোলাম আকবর খোন্দকার এবং দলটির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরী উভয়ে রাউজান উপজেলার বাসিন্দা। রাউজানে বিএনপির নেতাকর্মীরা দুই নেতার আলাদা বলয়ে বিভক্ত। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে রাউজানে উভয় গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে দফায় দফায় রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়েছে। এতে কমপক্ষে ১২ জনের
প্রাণহানি ঘটেছে বলে গণমাধ্যমের ভাষ্য। জানা গেছে, মঙ্গলবার বিকালে রাউজান পৌরসভা সদরে গোলাম আকবর খোন্দকারের চট্টগ্রাম উত্তর জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও রাউজান উপজেলার সাবেক সভাপতি প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদের কবর জেয়ারতের কর্মসূচি ছিল। অন্যদিকে একই সময়ে গিয়াসউদ্দিন কাদের চৌধুরীর অনুসারীরা মোটরসাইকেল শোভাযাত্রার কর্মসূচি ঘোষণা করে। গোলাম আকবর খোন্দকারকে নিয়ে নেতাকর্মীরা গাড়িবহর সহকারে রাউজান পৌরসভা এলাকার সুলতানপুরে প্রয়াত মহিউদ্দিন আহমেদের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। অন্যদিকে পৌরসভার মুন্সীঘাটা এলাকা থেকে মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা বের করেন গিয়াস কাদেরের অনুসারীরা। পৌরসভার ছত্তারহাট এলাকায় উভয় গ্রুপ মুখোমুখি হয়।
একটি ভিডিওচিত্রে দেখা গেছে, একটি কালো রঙের পাজেরো গাড়িতে গোলাম আকবর খোন্দকারসহ কয়েকজন ছিলেন। সামনে-পেছনে আরো কয়েকটি গাড়ি ও মোটরসাইকেলে তার অনুসারী নেতাকর্মীরা ছিলেন। ছত্তারহাট এলাকায় তাদের গাড়িবহর পৌঁছার পর দেখা যায়, আনুমানিক ৫০-৬০ গজ দূরে লাঠিসোঁঠা নিয়ে কয়েকশ লোক সড়ক অবরোধ করে রেখেছেন। এতে গোলাম আকবরের গাড়িবহর থেমে যায়। তখন তার গাড়ি ও নেতাকর্মীদের লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়। তখন পাল্টা ইট-পাটকেল তাদের দিকেও ছোড়া শুরু হয়। সংঘর্ষের মধ্যেই গাড়ি থেকে গোলাম আকবর খোন্দকারের চালক নামার পর অপরদিক থেকে ছোড়া ইটের আঘাতে তিনি রক্তাক্ত হন। এ সময় তিনি গাড়ি সরিয়ে নেওয়ার জন্য বারবার সেলিম নামে একজনের কাছ থেকে চাবি খুঁজছিলেন। কিন্তু চাবি না পাওয়ায় গাড়ি সরিয়ে নিতে সক্ষম হননি। এর মধ্যেই বিপরীত দিক থেকে লোকজন ইট-পাটকেল ছুড়তে ছুড়তে একেবারে গাড়ির সামনে এসে যান। ইটের আঘাতে গাড়ির কাচ ভেঙে ছিটকে পড়তে দেখা যায়।
তখন গোলাম আকবর খোন্দকার গাড়ি থেকে নেমে যান এবং নেতাকর্মীরা তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেন। তবে গাড়িতে থাকা অবস্থায় ইট এবং ভাঙা কাচের আঘাতে তিনি রক্তাক্ত হন। গাড়ি থেকে নামার পর তার শরীর থেকে রক্ত ঝরতে দেখা যায়। এরপর সড়কের ওপর কয়েকটি মোটরসাইকেল ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন ধরিয়ে দেয় হামলাকারীরা।
পুলিশ-র্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুল পরিমাণ সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়ার পর সংঘাতে জড়িতরা চলে যান বলে জানা গেছে।
গোলাম আকবর খোন্দকারের সঙ্গে একই গাড়িতে থাকা তার ব্যক্তিগত সহকারী অর্জুন কুমার নাথ বলেন, আমরা সুলতানপুরে যাচ্ছিলাম। ছত্তারহাট এলাকায় আমাদের ওপর আক্রমণ হয়। গোলাম আকবর খোন্দকার সাহেবের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। আমাদের নেতাকর্মীদের আরো কয়েকটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়েছে। আমাদের লক্ষ্য করে গুলিও ছোড়া হয়েছে। কমপক্ষে ২০-৩০ জন নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। পুলিশ এসে হামলাকারীদের রাস্তা থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর আমরা অন্য গাড়িতে চট্টগ্রাম শহরের দিকে যাচ্ছি।
আহত গোলাম আকবর খোন্দকারকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার নেওয়া হচ্ছে বলে জানান অর্জুন কুমার নাথ।
হামলার পর গোলাম আকবর খোন্দকার বলেন, আমি আগেই সংবাদ পেয়েছিলাম তারা হামলা করবে। কিন্তু বিশ্বাস করিনি। পরে একটি নোট পেলাম, গিয়াস উদ্দিনের নির্দেশে আজকে (মঙ্গলবার) সারাদিন সত্তরঘাট থেকে মুন্সিঘাটা পর্যন্ত মিছিল করা হবে। চিন্তা করলাম এটা একটা অশুভ পরিকল্পনা। আমি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানালাম, তারা আমাকে কনফার্ম করলো, কোনো অসুবিধা নেই, আমরা আছি। তারপর আমরা আসছি। কিন্তু আমরা যখন সত্তরঘাট ব্রিজ ক্রস করলাম; তখন ৫০-৬০ জন লোক ইটপাটকেল নিক্ষেপ শুরু করল। লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা করল।
সংঘর্ষের ঘটনা নিয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন। তিনি বিকালে ফোনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি গত এক সপ্তাহ ধরে অসুস্থ। ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানি না। ঘুমে ছিলাম। তবে তার অনুসারী রাউজান উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উদ্?যাপন কর্মসূচি বানচাল করতে পরিকল্পিতভাবে হামলা করা হয়েছে। ফটিকছড়ি থেকে সন্ত্রাসী ভাড়ায় এনে গোলাম আকবরের লোকজন হামলা চালিয়েছে।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার মো. সাইফুল ইসলাম সানতু বলেন, রাউজানে বিএনপির দুগ্রুপে সংঘর্ষ হয়েছে। আমাদের ওসি উভয়পক্ষকে নিবৃত্ত করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। তিনি একেবারে সংঘর্ষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে বড় রিস্ক নিয়ে উভয়পক্ষকে শান্ত করার চেষ্টা করেছেন। এখন পরিস্থিতি শান্ত আছে। একজন সিনিয়র লিডারের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। উনি আহত হয়েছেন বলে শুনেছি। দুটি মোটরসাইকেল জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখনো এসব বিষয়ে আমাদের কাছে কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।