কবি গোলাম মোস্তফা ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে (বাংলা ১৩০২, ৭ পৌষ, রবিবার) জিনাইদহের শৈলকুপার মনোহরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। অনেকে তার জন্ম সাল ১৮৯৭ (সার্টিফিকেট অনুযায়ী) বলে উল্লেখ করলেও তার প্রকৃত জন্মসাল ১৮৯৫। এ সম্পর্কে ‘আমার জীবন স্মৃতি’তে গোলাম মোস্তফা নিজেই উল্লেখ করেছেন ‘আমার জন্ম পল্লী হলো ঝিনাইদহ্ মহকুমার (বর্তমানে জেলা) শৈলকুপা থানার অন্তর্গত মনোহরপুর গ্রামে। আমার ম্যাট্রিকুলেশন সার্টিফিকেটের বর্ণনানুসারে দেখা যায় ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে আমার জন্ম। কিন্তু আমার মনে আছে শৈলকুপা হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় আমার আব্বা আমার বয়স প্রায় বছর দুই কমিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই প্রকৃত জন্ম হয়েছিল সম্ভবত ১৮৯৫ খ্রিস্টাব্দে। তবে এটি ঠিক যে, যেদিন আমার জন্ম হয় সেদিন বাংলা তারিখ ছিল ৭ পৌষ রবিবার।’
তিনি ছিলেন একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, প্রাবন্ধিক, উপন্যাসিক, শিশুতোষ-রচয়িতা, অনুবাদক, পাঠ্যপুস্তক-রচয়িতা, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ, সমাজসেবক ইত্যাদি বহুমুখী প্রতিভা ও গুণের অধিকারী। রবীন্দ্র-যুগে রবিকরোজ্জ্বলে সমুদ্ভাসিত বাংলা সাহিত্যাকাশে তিনি ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার সমসাময়িক কবি কাজী নজরুল ইসলামের (১৮৯৯-১৯৭৪) প্রতিভার খর-রৌদ্রতাপে বাংলা সাহিত্য যখন দীপ্ত-সমুজ্জ্বল, গোলাম মোস্তফা সে সময়কার অন্যতম বিশিষ্ট কবি হিসেবে সমাদৃত। রবীন্দ্র-যুগের (১৮৬১-১৯৪১) কবি গোলাম মোস্তফা যেমন রবীন্দ্র প্রভাব-বলয় থেকে মুক্ত ছিলেন না, পরবর্তীতে তার সমসাময়িক যুগ-শ্রেষ্ঠ কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রভাবকেও তেমনি অস্বীকার করতে পারেননি। উভয় কবির প্রভাব সত্ত্বেও গোলাম মোস্তফা স্বকীয় বিনম্র ধারা নির্মাণে তৎপর ছিলেন। এখানেই তার যথার্থ সার্থকতা।
গোলাম মোস্তফার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন পিতার হাতে। পরবর্তীতে দামুকদিয়া ও ফাজিলপুর গ্রামের পাঠশালায় লেখাপড়া করেন। এরপর শৈলকুপা হাইস্কুল থেকে ১৯১৪ সালে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক, ১৯১৬ সালে খুলনা দৌলতপুর কলেজ থেকে আইএ ও ১৯১৮ সালে কলকাতার রিপন কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর তিনি শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। শিক্ষক হিসেবে কবি ১৯২২ সালে কলকাতা ডেভিড হেয়ার কলেজ থেকে বিটি পাস করেন। শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত হয়ে তিনি ব্যারাকপুর সরকারি হাইস্কুল, কলকাতা হেয়ার স্কুল, কলকাতা মাদরাসা, বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট ডিমনস্ট্রেশন হাইস্কুল, হুগলি কলেজিয়েট হাইস্কুল, বাঁকুরা জেলা স্কুল এবং সর্বশেষে ফরিদপুর জেলা স্কুলে ১৯৪৬-১৯৫০ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালনের পর অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি ঢাকায় শান্তিনগরে বাড়ি করে সেখানেই বাকি জীবন অতিবাহিত করেন। এ সময় তার বাড়ি ‘মোস্তফা মঞ্জিল’ সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৯৬৪ সালের ১৩ অক্টোবর তিনি ৬৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।
আমার জীবন স্মৃতি’তে গোলাম মোস্তফা নিজেই উল্লেখ করেছেন ‘আমার বেশ মনে পড়ে, আমার কাব্য-জীবনের প্রথম উন্মেষ ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে। আমি তখন শৈলকুপা হাইস্কুলে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। নীচের ক্লাস থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পর্যন্ত আমি শৈলকুপা স্কুলেই পড়েছি। পঞ্চম শ্রেণিতে উঠবার পরই কেমন যেন একটা কাব্যিক ভাব আমার মধ্যে এলো। এটির কারণও ছিল। আমার পিতা মরহুম মৌলবী গোরাব্বানী সাহেব ছিলেন তখনকার আমাদের দেশের একজন বাংলা ভাষায় সুপণ্ডিত ও কবি। গোলাম মোস্তফা অষ্টম শ্রেণিতে অধ্যয়নকালে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ‘সাপ্তাহিক মোহাম্মাদী’তে ‘আন্দ্রিয়ানোপল উদ্ধার’ শিরোনামের কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে তার সাহিত্য জগতে প্রবেশ। পরে দীর্ঘ ৫০ বছর সাহিত্যকর্ম অব্যাহত রেখে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন। তার লিখিত সাহিত্যকর্মের মধ্যে রক্তরাগ, খোশরোজ, সাহারা, বুলবুলিস্তান, কাব্যকাহিনী ও বনি আদম নামে মৌলিক কাব্যগ্রন্থ, মুসাদ্দাস-ই-হালী, শিকওয়া ও জওয়াব-ই-শিকওয়া, ইখওয়ানুস সাফাসহ চারটি অনুবাদ কাব্যগ্রন্থ, রূপের নেশা ও ভাঙ্গা বুক নামের দু’টি উপন্যাস গ্রন্থ; তারানা-ই-পাকিস্তান ও গীতি সঞ্চায়ন নামের দু’টি গানের সংকলন; ইসলাম ও কমিউনিজম, ইসলাম ও জেহাদসহ চারটি রাজনীতিবিষয়ক গ্রন্থ; বিশ্বনবী, মরুদুলাল ও হজরত আবুবকর নামের তিনটি জীবনী গ্রন্থ, আল-কোরআন নামে কোরআনের একটি অনুবাদ গ্রন্থ; আমার চিন্তাধারা ও গোলাম মোস্তফা : প্রবন্ধ সংকলন নামের দুটি প্রবন্ধ সঙ্কলন পাওয়া গেছে। আলোকমালা (সিরিজ), আলোকমঞ্জুরী (সিরিজ), মঞ্জুলেখা, মণিমুকুর, খোকা-খুকীর বই, বাংলা ব্যাকরণ নামে তার বেশ কয়েকটি শিশু পাঠ্যপুস্তকও আছে।
গোলাম মোস্তফার সাহিত্যের বেশির ভাগের মূল বিষয় ইসলামী আদর্শ ও মুসলিম ঐতিহ্য। নিছক সৌন্দর্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি লিখেননি; বরং ইসলাম ও ইসলামী আদর্শ রূপায়নের জন্যই লিখেছেন তিনি। তিনি রসাত্মক কবিতা রচনা করলেও কোরআন-হাদিস তথা ইসলামী আদর্শ ঐতিহ্যের প্রতি ছিলেন তীক্ষ দৃষ্টিসম্পন্ন। কোনো রচনাই যেন ইসলাম পরিপন্থি কিংবা ইসলামের বিকৃত উপস্থাপন না হয় সে দিকে তিনি ছিলেন সদা সতর্ক। ইসলামী চেতনার রূপায়ণই তার সাহিত্য-সাধনার প্রধান উদ্দেশ্য এবং মুসলিম সমাজের সাহিত্য-সংস্কৃতির জাগরণ তার লক্ষ্য। তিনি মুসলিম জাতির জাগরণমূলক ইসলামী বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বিষয়াবলিকেই গীতি কবিতার আঙ্গিকে পরিবেশন করেছেন। তার জীবন সাধনায় মুসলিম বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত বিষয়াবলিকেই সাহিত্যে রূপায়িত করেছেন।এ প্রসঙ্গে তিনি আমার লক্ষ্য আদর্শ প্রবন্ধে লিখেন, ‘যে যুগে আমার জন্ম সে যুগ বাংলার মুসলমানদের অবসাদের যুগ। সে যুগে আমাদের সাহিত্যের না ছিল কোনো স্বাতন্ত্র, না ছিল কোনো স্বকীয়তা। প্রত্যেক জাতির মনন শক্তি, ঐতিহ্য, ধ্যান-ধারণা ও আশা-আকাক্সক্ষা রূপায়িত হয় তার মাতৃভাষার মধ্যে। জাতির অন্তরমূর্তি ছায়া ফেলে তার সাহিত্যের মনো-মুকুরে। সাহিত্য তাই জাতির মনের প্রতিধ্বনি। সাহিত্যের ভেতর দিয়েই গোটা জাতির সাচ্চা চেহারা দেখা যায়। সেই হিসেবে বাংলার মুসলমানের কোনো সাহিত্যই তখন রচনা হয়নি। আমি তাই ছোট বেলা থেকেই চেয়েছিলাম মুসলমানদের জাতীয় সাহিত্য রচনা করতে।’
গোলাম মোস্তফা বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রতিভা ও খ্যাতনামা কবি। কবি হিসেবে বেশি পরিচিত হলেও তিনি ছিলেন বহু প্রতিভার অধিকারী। সাহিত্যের প্রায় প্রতিটি শাখায় ছিল তার অবাধ বিচরণ। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ইসলামী চেতনার সাহিত্য রচনায় গোলাম মোস্তফার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। তার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো আদর্শের ক্ষেত্রে অনমনীয়তা ও দৃৃৃৃঢ়তা। তার সাহিত্য সাধনা মুসলিম সাহিত্যধারাকে করেছে প্রত্যয়নিষ্ঠ ও আত্মপ্রত্যয়বোধের মধ্যে সংস্থিত এবং বাংলা ভাষায় ইসলামী সাহিত্য-সংস্কৃতিকে করেছে বিকশিত। সাহিত্যের আঙ্গিক-প্রকরণে তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ছন্দের অনুসারী হলেও তার সাহিত্যকর্মের মূল উপজীব্য ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্য। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ বা সত্যেন্দ্রনাথের অনুরাগী হলেও আমার মনে জেগেছিল আমাদের নিজস্ব সাহিত্য সৃষ্টির একটা দুর্জয় আকাক্সক্ষা। সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির তাকিদে নয়, সহজভাবে আমি বাংলার সাহিত্যে চেয়েছিলাম ইসলামী কৃষ্টির রূপায়ণ। মাইকেল, বঙ্কিম, রবীন্দ্র, শরৎ তারা প্রত্যেকে ছিলেন হিন্দু জাতির মর্মবাণীর উদ্গাতা।... বাঙালির অর্ধেকের বেশি হলো মুসলমান। কাজেই বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের জীবনের প্রকাশ যদি না থাকে তবে সে সাহিত্য কিছুতেই পূর্ণাঙ্গ হতে পারে না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে ইসলামের রূপায়ণ তাই অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই অনিবার্য হয়েছিল এবং এখনো আছে।
আজকালের খবর/আরইউ