টিনের বাক্সের উপরে ফুলের ছবি। ধূলোর আস্তরণ পড়ে গেছে। অমিত সেটি পুরোনো আধছেঁড়া একটি কাপড়ের টুকরো দিয়ে পরিষ্কার করছিল। বেশ ব্যস্ত। কিছু অস্থির। তখন সজল এসে ঘরে ঢোকে। তার চোখে-মুখে উদ্বেগ। শেষ বিকালের হালকা আলোতে স্পষ্ট বোঝা যায়। বাঁশের বেড়ার ছোট একটি ঘর। ফাঁকফোকর আর জানালা দিয়ে সূর্যের আলো তির্যক এসে মেঝেয় পড়েছে। ছায়াম্লান দিন। সময় রহস্যময় স্থির। চারিদিকে অসম্ভব নীরবতা। সে জিজ্ঞেস করে,-‘কি রে তাহলে তুই যাবিই?’
‘যেতে আমাকে হবে।’
অমিত গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দেয়। সে হঠাৎ শান্ত হয়ে গেছে। বন্ধুর দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকায়। তার দুচোখে হয়তো কিছু কৌতুকও খেলা করে। সজলের চেহারায় প্রচ্ছন্ন উৎকণ্ঠা আশঙ্কার ছায়া। অজানা শিহরন তাড়া করছে। সে আবার ব্যগ্র কণ্ঠে বলে ওঠে,-
‘আমি বলি কি, সন্ধে হয়ে আসছে, আকাশের অবস্থাও ভালো নয়; তুই বরং কাল সকালে যা। দিনের বেলা যেতে তেমন সমস্যা নেই। অনেক দূরের রাস্তা তো!’
অমিত টিনের বাক্সে কয়েকটি বই সাজিয়ে রাখে। বন্ধুর আকুতিতে একবার মনে হয়, ঠিকই তো রাস্তায় ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। কাল ভোরে রওয়ানা দিলে মন্দ হয় না। কিন্তু...শ্যামল কাকা ওষুধ দিয়ে বলেছেন, -
‘যত তাড়াতাড়ি পারো, সম্ভব হলে আজকেই ওষুধ ব্যবহার করা দরকার। চোখ বলে কথা। যার চোখ নেই তার দুনিয়া অন্ধকার।’
‘ঠিক কাকা, আমি আজই যাব।’
অমিত খবর পেয়েছিল গতকাল বিকেলে। চেরাডাঙ্গি বাজার সপ্তাহে একদিন। জমজমাট বেচাকেনা। লোকজনের প্রচণ্ড ভিড় আর কথার গুঞ্জনে কেউ কেউ বলে, বাজারে নাকি জিন নামে। তারা বাজারে কী কেনে আর সেগুলো কী করে, সেই প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খায়। তখনই দেখা হয়ে যায় সুখদেবপুরের হবিবর চাচার সঙ্গে। গরু বিক্রি করতে এসেছেন। অমিত বাড়ির খবরাখবর শোনে। তার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ভালো সংবাদ নেই। বাবা অসুস্থ। অমিত হবিবর চাচাকে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে বলে খুব দ্রুত শ্যামল কাকার কাছে যায়। নাম করা কবিরাজ। কিন্তু বাজারের দিন; তিনি বাড়িতে নেই, দোকানঘর বন্ধ। অবশেষে আজ সকালে স্কুল শেষ করে দেখা করেছে। যেভাবে খবর শোনে তার ঠিক ঠিক বলে ওষুধ নিয়েছে।
সে সজলের দিকে উদাস দৃষ্টিতে তাকায় আর মন চলে যায় কোন অজানা দেশে। তাকে আজকে যেতেই হবে। একমুহূর্ত দেরি করা চলে না। এমনিতে অনেক দেরি হয়ে গেছে। লেখার কাগজ নেওয়ার জন্য রেশনের লাইনে দাঁড়িয়েছিল দেড়-দুই ঘণ্টা। যুদ্ধ চলছে। কাগজ, কেরোসিন, চিনি, আটা সবকিছু রেশন কার্ডে নিতে হয়। গরিব হওয়া বড় কষ্টের। অমিত মুখ ঘুরিয়ে আবার বন্ধুর দিকে তাকায়। সজল অনেক ভালোবাসে তাকে।
‘তুই দুশ্চিন্তা করিস না। দশ-বারো মাইল রাস্তা দুই-চার ঘণ্টায় ঠিক পৌঁছে যাব।’
‘সে আমি জানি, কিন্তু রাতের বেলা। যুদ্ধের সময়, চোর ডাকাত, ভূত প্রেত জিন...!’
‘চোর ডাকাত আমার কাছে কী পাবে? একটি ইংলিশ বই, বাংলা ব্যাকরণ আর অভিধান। ওগুলো ওদের কোনো কাজে আসবে না। আর জ্বিন ভূতের কথা বলছিস? ভূত আমার পুত পেত্নি আমার ঝি, আল্লাহ রসুল বুকে আছে ভয়টা আবার কি?’
অমিতের কথা শেষ হতে না হতেই আলতাফ মেম্বার ঘরে এসে পড়েন। ভদ্রলোক সজলের চাচা। চুল দাড়ি মেহেদির রঙে কমলা-লাল। অমিত এই লোকটির প্রতি কৃতজ্ঞ। তার বাড়িতে দুই বন্ধু একসঙ্গে থেকে কাছের হাই স্কুলে পড়ছে। সবসময় একজন অভিভাবকের মতো মাথার উপরে আছেন। তিনি সব শুনে বললেন,-
‘সজল তো ঠিকই বলছে অমিত, তুমি বরং আগামীকাল ভোরে রওয়ানা দাও। যুদ্ধের সময় পথঘাট মানুষজন ভালো নয়। রাতের অন্ধকারে শেষে কোন্ রাস্তা ধরে হেঁটে কোন্ রাস্তায় পড়বে!’
‘না চাচা আমাকে যেতেই হবে। বাবার দুচোখ ফুলে গেছে। অবহেলা করা ঠিক হবে না।’
‘সেও তো বটে! চোখ হলো অমূল্য ধন। তারপরও বলি বাবা, একটি রাত তো তেমন অসুবিধা হবে না। দেখ চিন্তা করে।’
অমিত অভিভাবকের কথা রাখতে পারে না। বেশ বিব্রত বোধ করতে থাকে। বার দুয়েক জানালা দিয়ে সূর্যের আলো খোঁজে। মøান ছায়া ছায়া রশ্মি দেখা যায়। সে বাক্সটিতে চার আনা দামের বিলেতি ছোট টিপতালা লাগিয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলে, -
‘সবচেয়ে জরুরি কি চাচা, গতকাল সন্ধেয় বাজারে শুনি, বাবার চোখের ব্যথা বেশি হয়েছে। আশপাশের ডাক্তার কবরেজের ওষুধে নাকি কাজ হচ্ছে না। সকালে শ্যামল কাকার কাছে গিয়েছিলাম। নামকরা কবরেজ জানেন তো! তাকে বলে-কয়ে ড্রপ আর খাওয়ার বড়ি নিয়েছি। বললেন, অবহেলা যেন না করি।’
‘শ্যামল কবরেজের ওষুধ অনেক কাজের। দুপুরে যেতে পারতে!’
‘স্কুলে দেরি হয়ে গেল। তারপর রেশনের লাইনে ছিলাম। আপনি চিন্তা করবেন না। ঠিক ঠিক পৌঁছে যাব, রাস্তা তো চেনা।’
‘ঠিক আছে দেখে শুনে যেও বাবা।’
সজল এতক্ষণ কোনো কথা বলেনি। এবার ফোঁস করে বলে উঠে, -
‘তোর বাবা আর কাজ পাননি, জাম গাছে উঠে মৌচাক ভাঙতে গেলেন কেন? এখন পা মচকেচে আবার চোখে মৌমাছির কামড়। গোদের উপর বিষফোঁড়া।’
‘পুরোনো দিনের মানুষ, খাঁটি মধুর স্বাদ ভুলতে পারেন? আর জানিস তো মধু হলো মহৌষধ।’
অমিত মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ায়। আলতাফ মেম্বারও ঘর থেকে বেরোতে উদ্যত হন। দুই বন্ধুর আলাপে বসে থাকতে চান না। সজল বলে উঠে, -
‘তোকে আটকানো যাবে না, উচিত হবে না। বাবা পরম গুরু। আমিও তাই করতাম। তুই এখনই রওয়ানা দে। তাড়াতাড়ি যেতে চেষ্টা করিস। রাত হলে বিপদ। পথে কিছু জঙ্গল আছে। শেয়াল-কুকুরও কম নেই।’
‘চাঁদনি রাত...ঝকঝকে আলো হবে।’
‘দেখিস জোছনায় আবার জিন ভূতেরা বেরোয়। হা হা হা!’
‘কি যে বলিস তুই, শুধু শুধু বিজ্ঞান পড়ছিস!’
‘তুই ভয় পাওয়ার ছেলে নয়। কে আটকাবে তোকে?’
অমিত একহাতে বাক্সটি উপরে তুলে কলসের মতো কোমরে ধরে নেয়। তারপর অন্যহাতে বন্ধুর হাত ধরে।
‘যাই রে একেবারে গ্রীষ্মকালীন ছুটি শেষে ফিরব। পারলে তুই আসিস, আমাদের গাছের আম অনেক বড় আর মিষ্টি।...চাচিকে বলে আসি।’
সজল নির্বাক হয়ে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে থাকে। অমিত একপলকে খুব দ্রুত বাড়ির ভেতরে ঢোকে। তারপর সজল যখন দুচোখ তুলে রাস্তায় তাকায়, দেখে অমিত বেশ দূরে চলে গেছে। বাঁক নিতে গিয়ে একবার পেছন ফিরে তাকায়। সজলের মনে হয়, এমন বন্ধু আর কে আছে! নিঃসঙ্গতার বোধ তার ভেতরে ডালপালা মেলে ধরে।
বেশ কিছু রাস্তা হেঁটে এসে যখন নদীর কুলুকুলু শব্দ পাওয়া গেল, আমবাগানের ঘন ছায়া শেষ হয়েছে। অমিত বালিয়ারিতে পা দিয়ে আকাশের দিকে তাকায়। অনেক বড় একটি চাঁদ ঈশান কোণকে বাঁ-হাতে রেখে মাথা উঁচু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটি এলোমেলো মেঘপুঞ্জ অলসের মতো ভেসে বেড়ায়। সেগুলোর উপরের দিক তুষার শুভ্র আর নিচের রং ধূসর-কালো। বাক্সটি বেশ ভারী! অতগুলো বই না নিলেই পারত। আবার বই ছাড়া চলে না। ছুটির পর ষান্মাসিক পরীক্ষা।
আত্রাই নদীতে হাঁটু পানি। আবার কোথাও বুক সমান বা দুই মানুষ। বেলাশেষের আলোতে ঠিক জায়গা বুঝতে অসুবিধা হয় না। সে বাক্সটি শক্ত করে ধরে নদীর পানিতে নেমে পড়ে। শীতল স্পর্শে মন ভরে যায়। নদী পেরিয়ে ধান ক্ষেতের আইল ধরে পথ। অনেক ক্ষেতের ধান কাটা হয়ে গেছে। কোনো কোনোটির হয়নি, আকস্মিক দ্বীপের মতো জেগে আছে মাত্র। ক্ষেতের কোনো কোনো জায়গায় বড় বড় ইঁদুরের দাপুটে আনাগোনা আর শিসের মতো অদ্ভূত তীক্ষè চিৎকার। অমিতের এ সকল কমবেশি চেনা। সে হাঁটার গতি দ্রুত করে ফেলে। লক্ষ্য করে, ধীরে ধীরে সন্ধ্যার ছায়া নেমে আসছে। আলোছায়া গভীর ম্লান হতে শুরু করেছে। চাঁদের বেশ কিছু অংশ ঢেকে ফেলেছে কালো মেঘ। অদ্ভুত রহস্যময় আঁধারে ঢেকে যেতে শুরু করেছে সবকিছু।
সে ঠিক বুঝতে পারে না নদী পেরিয়ে কোন্ জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। দৃষ্টি ফেলে শুধু দেখা যায়, গাছের অন্ধকার কায়া আর আকাশে মেঘের ফাঁকে চাঁদের হালকা আলোর লুকোচুরি। আত্রাই নদী পেরিয়ে পুব-উত্তর কোণে ছয়-সাত মাইল রাস্তা এগোলে আর একটি নদী। সেটির নাম কাঁকড়া, অনেক গভীর তার পানি। একজন মাঝি পারাপারের জন্য নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করে। হাট-বাজারের দিন লোক সমাগম হয়। শত শত মানুষের কলরোলে নদীর পাড় গমগম করতে থাকে। সেই জায়গা পেরিয়ে আরও মাইলখানেক দক্ষিণে যেতে হবে। তারপর নিজের গ্রাম সুখদেবপুর...তার বাড়ি। সে-সময় ধীর গতিতে বাতাস বইতে শুরু করেছে। অত্যন্ত শীতল। কাছে কোথাও হয়তো বৃষ্টি হয়েছে বা হচ্ছে। অমিত বাক্সটি ঠিক করে বাঁ-কোমরের দিকে চেপে ধরে। তারপর ধান ক্ষেতের আইল-রাস্তায় নেমে যায়। বড় রাস্তা ছেড়ে শর্টকাট যেতে পারলে অনেক আগে পৌঁছনো সম্ভব।
কতক্ষণ ঠিক মনে করতে পারে না, অমিত থমকে দাঁড়ায়। সামনে একটি আমবাগান। চাঁদের মৃদু আলোয় বেশ বোঝা যায়, এ তার গন্তব্যের রাস্তা নয়। সে পথ ভুল করেছে। বাগানের গাছগুলো প্রসারিত ঝাঁকড়া ডালপালা নিয়ে তাকে ঘন অন্ধকারের মধ্যে ডেকে নিতে চায়। বাগানের সামনে সরু রাস্তা ছায়া ছায়া আবছা আলোয় অদ্ভুত দৃশ্যমান। সে কী করবে ভেবে পায় না। এ রাস্তা যে সঠিক নয়, এখন কোন্ দিকে নিজেকে ঘোরাবে; সে ধাঁধায় পড়ে যায়। তখন কাছে কোথাও কোনো তক্ষক টিট্ টিট্ শব্দে চিৎকার করে কয়েকবার ডেকে উঠে আর পরিবেশ হয়ে পড়ে কেমন অস্বস্তিকর ভয়াবহ। তার চোখের সামনে ধান ক্ষেতের উপর দিয়ে ছুটে যায় কোনো নিশাচর প্রাণি। আবছা ছায়া দৃষ্টির কোণে ঢেউ তুলে যায়। কোনো শেয়াল হবে। সেটি অনেকটা ধূসর-সাদা। অমিত বাক্সটিকে চেপে ধরে সিদ্ধান্ত নেয়, আমবাগানের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া সরু রাস্তা নিশ্চয় বড় রাস্তায় নিয়ে যাবে। আর এভাবে সে এগোতে থাকে। অন্ধকার ধীরে ধীরে গাঢ় হতে থাকে আর নিঃসীম নিস্তব্ধতা। বাগানের গাছে গাছে ডালে ডালে খুব নিচে ধরে আছে অনেক আম। কোনো কোনোটি তার মাথা স্পর্শ করে চলে। কিছু অচেনা ক্ষুদ্র ফড়িং চোখে-মুখে এসে ঝাপটা মারে। সে কোনোকিছু তোয়াক্কা না করে সামনে এগোয়। নিশ্চয় এই সর্পিল পথ বড় রাস্তায় নিয়ে যাবে।
কোথাও আলোর রেখা দেখা দেয়। অমিত আশার আলোতে ভরসা খোঁজে। আলো মানে মানুষ আছে। সে দৃষ্টি তীক্ষè করে সেদিকে এগোয়। শোনা যায়, নদীর কুলু কুলু শব্দ। এ নদী কি তবে কাঁকড়া? না তা হতে পারে না। কাঁকড়া নদী আরও অনেক দূর। সে তবে এতক্ষণ আত্রাইয়ের পাড় ধরে উত্তরে এগিয়েছে। এসব ভাবনার মাঝে ভক করে পচা দুর্গন্ধ তার নাকে এসে লাগে। বুকের মধ্যে শিরশিরে ঢেউ বয়ে যায়। ভূত-পেত্নির শরীরে নাকি প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। তাদের দুচোখ অনেক বড় বড় আর টকটকে লাল। মুখের ভেতর থেকে ছেঁদন দাঁত ঠোঁটের দুপাশ দিয়ে বেরিয়ে থাকে। আসলে ভূতের কোনো শরীর আছে? কেউ কেউ বলে, ভূতেরা নাকি হাওয়ার মতো। তারা গাছে থাকে, পুরোনো কুেয়ার জলে, পুকুরের গভীরে আর পোড়ো বাড়ির অন্ধকারে থাকে। তারা কোথায় থাকে থাক, তাদের সে বিরক্ত করেনি। সেও প্রত্যাশা করে, তারা তাকে ভয় দেখাবে না। অমিত নিজের মধ্যে সাহস আনার চেষ্টা করে। সে খুব সাবধানে গাছগুলোর দিকে দৃষ্টি দেয়, কিছু দেখা যায় না। তখন আবার মনে পড়ে, ভূতেরা শ্মশানেও থাকে; তারা মড়া পোড়ার গন্ধ খায়। এই কথাটি মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলে, সে আত্রাইয়ের কোনো এক শ্মশানে এসে পড়েছে আর চণ্ডালের ঘর থেকে ছিটকে পড়া আলোক বিন্দু সে দেখেছিল।
এরমধ্যে কিছু অস্ফুট কোলাহল আর তীব্র শব্দ ভেসে আসে। মনে হয় কোনোকিছুর উপর খুব জোরে আঘাত করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে কিছু পোড়ানোর দুর্গন্ধ। অমিতের আর নিশ্চিত হতে বাকি থাকে না। এটি শ্মশান আর সে ভুল করে তার কাছাকাছি এসে পড়েছে। শ্মশানে নিশ্চয় কোনো মৃতদেহ পোড়ানো হচ্ছে। সে আর থেমে থাকে না, খুব দ্রুত উলটো দিকে হাঁটা শুরু করে দেয়। এ বাগান থেকে বেরোতে হবে। এদিকের পথ তার জন্য নয়। এ ভুল রাস্তা। এখন তাকে আবার নদীর কাছাকাছি যেতে হবে। তারপর বড় রাস্তা ধরে পুব-উত্তর কোণে।
কিছু দূর হেঁটে আসার পর মনে হয়, আমবাগান এত দীর্ঘ কেন? এত লম্বা তো ছিল না! তবে কি তাকে ভূতে ধরেছে? গোলকধাঁধায় ফেলে মজা করছে? সে বুকের মধ্যে সাহস আনার জন্য ‘আসতাগফিরুল্লাহ’ পড়তে শুরু করে দেয়। আর এভাবে যেতে যেতে এক ফাঁকা জায়গায় এসে পড়ে। সেখানে বালি আর বালি, নদীর পানি বয়ে যাওয়ার মর্মর শব্দ; আর সামনে বিশাল এক মূর্তি। সে চমকে ওঠে। মূর্তিটির বড় বড় সাদা চোখ-দুটো আলোছায়ায় বীভৎস আর ভয়ংকর লাগে। সেটি লম্বা এক জিহ্বা বের করে দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর চাঁদোয়ার মতো কোনোকিছু দিয়ে ঢাকা, পলিথিন বা কাপড়; হাওয়ায় শট শট শব্দ তুলে ভাসছে। অমিত সেদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, এটি শ্মশানের দক্ষিণ দিকের সেই বিশাল চামুণ্ডা মূর্তি, যা অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। সে যখন নদীতে নেমে পার হয়ে এসেছিল, দূর থেকে দেখেছে। তা হলে তার সঠিক পথ খুব ধারেকাছে আছে। সে নিজের মধ্যে সাহস খুঁজে পায়।
কথায় বলে বিপদ একা আসে না। অমিত আত্রাইয়ের অন্ধকার আমবাগান, শ্মশান ঘাট আর বিশাল চামুণ্ডা পেরিয়ে যখন বড় রাস্তায় পা রেখেছে, আকাশ অন্ধকার। একটি বিস্তৃত কালো মেঘ ঢেকে ফেলেছে চাঁদ। সামনের যা কিছু আবছা দেখা যাচ্ছিল, সব আঁধারে মিশে কালোতে ঢেকে গেছে। সে আলগোছে হাতড়ে চলার মতো সামনে পা ফেলে। মনে বিশ্বাস ঠিক পথেই এগোচ্ছে। রাত কত কে জানে! গ্রাম অঞ্চলে সন্ধের সময়ে অনেক রাত হয়ে যায়। সে রাত যত গভীর আর দীর্ঘ হোক না কেন, তাকে ঠিকমতো পৌঁছতে হবে। সে বাক্স ভালোভাবে চেপে নিয়ে অন্যহাতে পকেটে রাখা ওষুধের শিশি স্পর্শ করে। ঠিক আছে।
কিছুক্ষণ পর তার দৃষ্টির সম্মুখে বেশ দূরে দুটো আলোক বিন্দু নেচে ওঠে। পাশাপাশি হেঁটে চলেছে। এগুলো জোনাকি নয়। আশে পাশে শত শত জোনাকি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অদ্ভুত মায়ালোক লাগে সবকিছু। মায়াই বটে। অমিত জানে, জোনাকি একধরনের ক্ষুদ্র পতঙ্গ যার শরীরের পেছনে আলো জ্বলে। সেই আলোয় অন্য পোকা আকর্ষিত হয়। জোনাকির এই আলো শিকার ধরার ফাঁদ মাত্র। সে সন্ধের পর থেকে রাস্তায় অনেক জোনাকি দেখেছে। শহরে তেমন একটা দেখা যায় না। সামনের আলোকবিন্দু তেমন কোনো জোনাকির আলো নয়। এ দুটোর রং আর আকার বড়। সে ভেবে নেয়, ধারেকাছে কোনো বাজার রয়েছে, কে জানে মাদারগঞ্জের হাট কি না? হাট শেষে লোকজন বাড়ি ফিরছে। তেমনই ঘর ফেরতা কোনো মানুষ হবে। তাদের হাতে ধরে থাকা লন্ঠনের আলো। তার মনে সাহস বাড়ে, এ বিশাল প্রান্তরে সে তবে একা নয়; মানুষ আছে। সে আলোক বিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকে। সেগুলোর অবস্থান বেশ নিচু। সে হাঁটার গতি একটু বাড়িয়ে দেয়। ঠিকমতো এগোন যাচ্ছে না। আকস্মিক পা-দুটো মাটির বড় বড় টুকরোতে গিয়ে পড়ছে, হোঁচট খাওয়ার দশা। সে এরমধ্যে দৃষ্টি থেকে আলোকবিন্দুকে হারাতে দিতে চায় না। সম্ভবত ওই দিকে মূল রাস্তা আর ওটা ধরতে হবে। তবে কত দূর কে জানে!
কতক্ষণ ঠিক মনে নেই, সে হেঁটে চলেছে আর দৃষ্টির সামনে আলোকবিন্দু। সেগুলো কখনো নিজেদের খুব কাছে, কখনো সামান্য দূরে পাশাপাশি ভেসে চলেছে। কখনো হয়তো হাত ধরাধরি করে কাছাকাছি, কখনো উঁচুতে আর দূরে দূরে। তারপর একসময় মনে হয় আলোকবিন্দু দুটো আকাশে উঠে গেল। অমিত আলোকবিন্দু হারিয়ে ফেলে। সে বুঝতে পারে না হঠাৎ কী হলো...কী করে হলো? তার বুকের মধ্যে ভয়ের কাঁপন জেগে ওঠে। সেগুলো কি তবে জিনের বাতি? তখন বাবার মুখে শোনা এক গল্প মনে পড়ে যায়।
কাঁকড়া নদীর পশ্চিম পাড়ে তাদের ছোট এক জঙ্গল আছে। সেখানে ডুমুর অশ্বত্থ কদম গাছ ছাড়াও রয়েছে আম-জাম-কাঁঠাল আর ডেউয়ার গাছ। কয়েকটি শিমুল আর সোনালু গাছও রয়েছে। আছে নানা ঝোপঝাড় আর গুল্মলতার অগোছালো বেড়ে ওঠা। সে বাবার সঙ্গে নদীতে স্নান করতে যায়। তারপর দু-জনে সেই জঙ্গলের ভেতরে চলে আসে। অদ্ভুত ছায়া ছায়া আলোর ভেতর মায়াময় জগৎ। গাছের শাখায় শাখায় অনেক পাখি। সবগুলোর নাম সে ঠিকমতো জানে না। মাটিতে শুকনো পাতার সঙ্গে কিছু ফুল আর ফল পড়ে আছে। তার দু-একটিকে চেনা যায়, কদম, ডুমুর আর ডেউয়া। অমিতের কাছে সবকিছু বিস্ময়। এই প্রথম সে জঙ্গলে এসেছে। সে অবাক হয়ে দেখতে থাকে আর বাবার পেছনে পেছনে হেঁটে চলে। এভাবে কিছু দূর গিয়ে আকস্মিক থেমে যায়। সামনে বিশাল এক আম গাছ। তার কাণ্ড অনেক চওড়া। হাত দিয়ে ঘিরে ধরতে চাইলে দুজন মানুষের দরকার। বাবা সেই গাছে খুব অনায়াসে উঠে যান। অমিত নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। গাছে বেশ বড় বড় আম। সে নিচ থেকে বাবার আম পাড়া দেখে। কখনো আশেপাশে ঘোরে। একবার খুব সতর্কতায় কাঁটা বাঁচিয়ে বৈচি ফলের দু-চারটি তুলে মুখে নেয়। টকমিষ্টি স্বাদ, অপূর্ব; মন ভরে যায়। বাবা তাকে সতর্ক করে দিয়েছেন। জঙ্গলে অনেক বিষাক্ত সাপের আবাস। সুতরাং সাবধান। তারপর ফেরার পথে শোনে সেই গল্প। গল্পটির সত্যাসত্য নিয়ে কোনোদিন ভাবেনি, তবে ভয় পেয়েছিল। কখনো সেই গল্প ভাবনায় হানা দেয়। গল্পটি বাবা তার বাবার কাছে শুনেছিলেন। সে গল্প নাকি অন্য এক দাদুর জীবনের সত্য ঘটনা। তিনি বাবার মামা, জামিলুর রহমান। সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ যার মাথায় সবসময় সাদা রঙের টুপি, পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি। একটি মানুষ পুরো সাদা রঙের কাপড়ে জড়ানো।
অমিত আকাশের দিকে একপলক তাকিয়ে দেখে, ঈশান কোণের জমাট মেঘ কিছু সরে গেছে। সে দিকের আকাশে দেখা দিয়েছে কয়েকটি তারা। নিকষ কালো আঁধার সরে আলোছায়া রাত মনে বেশ ভরসা দেয়, দৃষ্টিতে সহনীয় হয়ে এসেছে অনেককিছু। সে মনে মনে সাহস খোঁজে, কিন্তু আলোকবিন্দুর আকস্মিক হারিয়ে যাওয়ার কথা মন থেকে সরে যায় না। বাবার মুখে শোনা সেই গল্প খুব বেশি জেগে ওঠে তখন। মনে হয়, সে বাড়ির আঙিনায় গরুর গাড়িতে আধশোয়া বসে আছে। তার সঙ্গে এসে বসেছে পাড়ার আরও ক’জন ছেলেমেয়ে। সকলে গল্প শুনবে। বাবা খুব সুন্দর করে গল্প বলতে পারেন। এভাবে অমিত কত গল্প বাবার কাছে শুনেছে! এখন শ্রুতিতে তেমনি বেজে ওঠে ভারী কণ্ঠ।
অনেক আগে জঙ্গলের সেই আম গাছে নাকি একদল জ্বিন থাকত। সে জ্বিনেরা কারও কোনো ক্ষতি করত না। কোনো মানুষ কোনো সমস্যায় পড়লে সেই গাছের কাছে নদীর তীরে গিয়ে সাহায্য চাইতেন। লোকটি যদি সৎ হন, তিনি দু-একদিন পর নদীর তীরে বা সেই গাছের গোড়ায় পেয়ে যেতেন তার প্রার্থিত জিনিস। এই সহায়তা ছিল সাময়িক, অল্প কিছুদিনের জন্য। যেমন কোনো ব্যক্তি কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে চান, তার কাছে পর্যাপ্ত বাসনপত্র নেই। তিনি শুদ্ধ মনে জঙ্গলে এসে সে কথা জানালে পরদিন সন্ধের সময় সে-সব পেয়ে যেতেন। তিনি দেখতেন জ্বিনেরা তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নদীর তীরে রেখে দিয়েছে। সে চমৎকার মনভোলানো এক কাহিনি।
নদীর খুব কাছে কারেন্টের হাট। সপ্তাহের একটি দিন হাট বসে। দুপুর থেকে শুরু হয়ে চলে অনেক রাত-অবধি। লোকজনের ভিড়ের মধ্যে চলে কেনাবেচার সকল আয়োজন। কেউ কেউ সেই ভিড় আর হাটের ভেতরের মৃদু গুঞ্জনের বিষয় নিয়ে নানাকথা বলে থাকেন। কেউ বলেন, জ্বিনেরা বাজার করতে আসে। তারা মানুষের হাতে তৈরি মিষ্টি পছন্দ করে। মানুষের রূপ ধরে রেস্তোরাঁয় খায় আর কিনে নিয়ে যায়। এ গল্প সত্য না বানানো কে জানে, তবে বাস্তবিকই হাটে প্রচুর মিষ্টি বিক্রি হয়। সেই হাটে ছোট একটি দোকান নিয়ে বসতেন, বাবার মামা জামিলুর রহমান, তার আর এক দাদু। অমিত শুনেছে, এই দাদুর বাপ-দাদারা নাকি পীর বংশের উত্তরাধিকার। তিনি মাঝে মধ্যে বাবার কাছে এসে বেশ জমিয়ে গল্প করতেন। একটি দুপুর থেকে বিকেল বা সন্ধেয় ফিরে যেতেন নিজের গ্রামে। অমিত জানে, তিনি কিছু টাকার জন্য আসতেন। অথচ এই লোকটি আগে তেমন অভাবি ছিলেন না। ভালো ব্যবসা ছিল। কাপড়ের দোকান। কিন্তু লোভে পড়ে তার ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যায়। তার নিজের মাথা আর মুখমণ্ডল ডানদিকে কিছু বাঁকা হয়ে পড়ে। সেই গল্পটি মনে পড়ে যায় আবার।
জামিলুর রহমান প্রতি বৃহস্পতিবার কারেন্টের হাটে দোকানের পশরা নিয়ে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় বসেন। সে রাতে অনেক দেরি হয়ে যায়। বেচাবিক্রি চলে অনেকক্ষণ। সামনে ঈদ। সকলে নতুন নতুন কাপড় গেঞ্জি-সার্ট-প্যান্ট কেনায় ব্যস্ত। তিনিও গ্রাহক সামলাতে অবসর পান না। তারপর হাট ভেঙে গেলে, বোচকা বেঁধে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলেন। সে রাত ছিল পূর্ণিমার আলোয় উজ্জ্বল। শুভ্র রুপোলি আকাশ। আলোর ধাঁধায় ভুল করে কয়েকটি কাক আকাশে ডানা মেলে ডেকে উঠছে। জামিলুর রহমান মনে আশ্চর্য খুশি নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। ঈদ আসতে আরো দশ-পনেরো দিন রয়েছে। এরমধ্যে নিয়মিত একটি বা দুটি হাট পাওয়া যাবে। শহরে গিয়ে আরও কাপড়-চোপড় আনতে হবে। এসব ভাবনা আর পরিকল্পনায় ধীরে ধীরে এসে পড়ে কাঁকড়া নদীর তীর। নদীর ধারে ধারে তীর ঘেষে উত্তরের রাস্তা। জ্যোৎস্নার আলোয় নদীকেও লাগে অদ্ভূত মায়াবী। তিনি চাঁদের দিকে, কখনো আকাশের তারাগুলোয় মুগ্ধ দৃষ্টি মেলে খুশি মনে ফিরছেন। তখনই এক ভুল হয়ে যায়। তিনি ভুল করে বসলেন। মনের মধ্যে অসম্ভব কৌতূহল নিয়ে দূরের আমগাছের দিকে তাকান। যা দেখলেন তাতে হাত পা জমে যাওয়ার কথা, কিন্তু তিনি সাহসী, হয়তো একটু বেশি। দেখেন, গাছের শাখায় শাখায় উজ্জ্বল আলোর দীপ জ্বলছে। এ আলোক বিন্দুগুলো মিথেন গ্যাস নয়। সেগুলো স্থির হয়ে আছে। কখনো কোনো কোনোটি এক শাখা থেকে অন্য শাখায় খুব স্বাভাবিক ভেসে যাচ্ছে। মনে হয়, কেউ লন্ঠন হাতে গাছের এদিক-ওদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে। তিনি বুঝলেন, এগুলো জিনের বাতি। তার মধ্যে লোভ জেগে ওঠে। রূপকথার গল্পে আলাউদ্দিনের এক জ্বিন ছিল। সেই জ্বিন তাকে অনেক ধনবান করে দেয়। জিনদের মধ্যে এমন অনেক দাতা জিন আছে। পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে কিংবা লুকিয়ে থাকা সম্পদের খবর তাদের জানা। জামিলুর ভাবনায় পড়ে গেলেন। তিনি কাঁধের উপর থেকে বোঁচকা নামিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। ভাবছেন, গাছের কাছে যাবেন। কখনো নিজেকে প্রবোধ দিচ্ছেন, লোভ করা ভালো নয়...তিনি কিছু দেখেন নাই। চুপচাপ ফিরে যাওয়াই মঙ্গল। এই দোদুল্যমানতার মধ্যে আকস্মিক ঠিক করলেন, বারবার সুযোগ আসে না, জ্বিনের কাছে হাত পাতবেন। যা পাওয়া যাবে, অমূল্য সম্পদ। তা হলে ব্যবসা আরও বড় করা যায়। দু-বিঘে জমি বন্ধক রেখেছেন, ছাড়ানো সম্ভব হবে।
জ্বিনেরা কি তার মনের ভাবনা শুনেছে? জামিলুর রহমান দেখলেন এবং তার হাত পা ঠক ঠক করে কাঁপতে লাগল। একটি সোনালি রঙের রথ তার চোখের সামনে দিয়ে প্রায় অশ্রুত গুঞ্জন তুলে এগিয়ে আসছে। সাদা দুটো ঘোড়া হাওয়ায় টেনে চলেছে সেই বাহন। সেগুলোর গলায় বাঁধা ঝুনঝুনি ঝুন ঝুন শব্দের মৃদু ঝংকার তুলছে। কতক্ষণ স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মনে নেই। সম্বিত পেয়ে তিনি ছুটলেন রথের পেছনে। অনেক দূর দৌড়েছেন হয়তো। একসময় রথ থেমে গেল। দীর্ঘদেহী উজ্জ্বল শুভ্র বসন চালক ঘুরে তাকালেন তার দিকে। লম্বা জোব্বা পরিহিত এক লোক। জিনদের চেহারা কি মানুষের মতো? শুনেছেন, তারা আগুনের তৈরি। নানা রকম রূপ ধারণ করতে পারে। এখন কি তবে মানুষের চেহারা ধারণ করেছে? শ্বেতশুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত জিনের চেহারা আশ্চর্য কোমল আর সেখান থেকে অজানা আভা বিচ্ছুরিত হচ্ছে। জামিলুর কী বলবেন ভেবে পেলেন না। ভাবনায় কোনোকিছু স্থির নেই। থাকছে না। তিনি শুধু দুটো হাত ভিখিরির মতো পেতে রইলেন। অনেকক্ষণ পর লক্ষ্য করেন, তার হাতের মুঠোয় কয়েকটি স্বর্ণমুদ্রা। মোহর। অনুভব করলেন, মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠে কিছু অচেনা সংকেত খোদিত। সে শব্দ বা ভাষা আরবি না হিব্রু কে জানে, জানার কথাও নয়; পরে দেখেছেন, বুঝতে পারেন নাই। সে-রাতে তিনি পরম তৃপ্তি নিয়ে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন।
অমিত সেই গল্পের ভেতর অদ্ভূত পুলক খুঁজে পেয়েছিল। এখন বুক জুড়ে শূন্যতা বা ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। সে আশেপাশে দৃষ্টি দেয়। আকাশ আবার অন্ধকার হয়ে আসছে। এবার হয়তো বৃষ্টি হবে। সে খুব ব্যস্ততায় কিছুক্ষণ আগে দেখা আলোকবিন্দুকে খোঁজে। না নেই, সামনে কাশবনের ঝাড়; তাই কিছু দেখা যাচ্ছে না। আবছা আলোছায়ায় কাশফুলের শাখাগুলো কোনো অশরীরি জ্বিন বা পরীর মতো বা ধূসর-সাদা ছায়া ছায়া লাগে। তখন মনে হয়, আজ রাতে না বেরোলেই বরং ভালো হতো। সজল বলছিল। কিন্তু বাবার চোখের যন্ত্রণা? তার কাছে ওষুধ রয়েছে। সে আলতো করে পকেটে রাখা শিশি স্পর্শ করে নেয়। তারপর হাঁটার গতি বাড়িয়ে চলে। রাত খুব বেশি হয়তো নয়। সে অহেতুক ভয় করছে। ভয়কে ভয় করলে সে আরও চেপে বসে। সাহস আনতে হবে। ভীরুরা মরে বারবার। ইত্যাদি বাক্য দিয়ে সে নিজের মনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা নেয়। সে কোনোদিন জামিলুর দাদুর গল্প সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেনি। এবার দেখা হলে জানার চেষ্টা করবে। আসলে সত্য ঘটনা কী?
গল্পের শেষ পর্বে জানা যায়, জিনের দেওয়া মুদ্রায় জামিলুর রহমানের কপাল খুলে গিয়েছিল। ব্যবসার অনেক উন্নতি হয়। স্টেশনের মার্কেটে বড় এক দোকান বসে। কেনাবেচাও ভালো। মহাজনের কাছে বন্ধকি রাখা জমি ঘরে ফেরত আসে। আরো কিছু জমি কেনা হয় ইত্যাদি। এসব ঘটনা ঘটেছিল ছয় মাসের মধ্যে। তারপর একদিন রাতের ভোজসভায় গরুর মাংস খেয়ে সব ভেস্তে যায়। তখন তার দু-কানে কে যেন বারবার সাবধান করে দিতে থাকে, ‘খেও না-খেও না, মাংস খেও না।’ কিন্তু মন সেই নিষেধ শোনেনি। নিমন্ত্রণ রক্ষা করে বাড়ি এসে দেখেন, অনেক টাকায় কেনায় বড় বড় চারটি গাভি একসঙ্গে মরে গেছে। এই শোক সামলাতে না সামলাতে কয়েক দিন পর এক দুপুরে মার্কেটে আগুন লাগে। তার দোকানের সবকিছু পুড়ে যায়। চোখের সামনে এসব দুর্ঘটনার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। ওই দিন সন্ধেয় আকস্মিক স্ট্রোকে তার মুখমণ্ডলসহ মাথা ডানদিকে কাত হয়ে পড়ে। মুখের কথা জড়িয়ে যায়।
বাবার মুখে শোনা দাদুর এই গল্পের মূল শিক্ষা ছিল, কোনোকিছু শটকার্ট রাস্তায় পাওয়া যায় না। যদিও কখনো অর্জন হয়, সে ক্ষণিকের। সেটি সম্পূর্ণ মায়া। মানুষকে সাধনা করতে হয়। লক্ষ্য স্থির করে নিমগ্ন হতে হয়। যার ধৈর্য রয়েছে তার সিদ্ধিও নিশ্চিত। অমিত এইসব ভাবনায় নিজের মধ্যে আশ্চর্যরকম শক্তি ফিরে পায়। ভয় ডর তেমন আর করে না। এভাবে কিছু দূর হেঁটে পা রাখে মূল রাস্তায়। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা। ইট-সুরকির ঢালাই, আলোছায়া রাতে ধূসর-সাদা। এখন সে জানে এই রাস্তা তাকে কাঁকড়া নদী পর্যন্ত নিয়ে যাবে। তারপর আর কিছু পথ উত্তর-পুব কোণে এগিয়ে গেলে চিরিনদীর বাঁক। সরু খালের মতো সেই নদী মিশেছে কাঁকড়ায়। অমিত সেখানের মোহনায় অনেকদিন মাছ ধরেছে। এবার গ্রীষ্মের ছুটিতেও ছিপ নিয়ে চেষ্টা করবে। বোলতার চাক খুঁজে বের করতে হবে। ভালো টোপ হয়। কালবাউস-আঁইড় আর খড়কি মাছের প্রিয় টোপ। এসব ভাবনার মাঝে আকস্মিক সেই হারিয়ে যাওয়া আলোকবিন্দু উদয় হয় সামনে। আসলে সেগুলো হারিয়ে যাওয়া কিনা সে নিশ্চিত নয়। তবে শ্রুতিতে এসে লাগে কিছু কথাবার্তার অস্ফুট ধ্বনি। মানুষের গলার আওয়াজ। সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। মনে হয় বুকের উপর থেকে বিশাল পাথর নেমে গেছে।
সে পা চালিয়ে আলোকবিন্দুর কাছাকাছি হতে থাকে। লন্ঠনের আলো। আকাশে তখন মেঘ সরে গেছে অনেকটা। রুপোলি জ্যোৎস্নায় সবকিছু বেশ স্পষ্ট। তার সামনে দু-জন লোক হেঁটে চলেছে। সে কোমরে চেপে ধরা বাক্সটি আবার উপরে তুলে খুব দ্রুত হেঁটে তাদের কাছাকাছি হয়। বাবা বোধহয় জেগে আছেন। তার বোধকরি খুব কষ্ট হচ্ছে। জেগে না থাকলেও ডাক শুনে বাবা জেগে যাবেন। তখন তার চোখে ওষুধ দিতে হবে। বড়ি খাওয়াবে। শ্যামল কবিরাজের অনেক নাম ডাক, দু-চারদিনে নিশ্চয় সব সেরে যাবে। তখন সে সজলকে চিঠি দেবে। আজকের ঘটনার কথা জানিয়ে অনেক কথা লিখবে।
‘আস্সালামু আলাইকুম।’
অমিত খুব সহজভাবে লোক দু-জনকে সালাম দেয়। তখন দমকা বাতাসে একটি লন্ঠন নিভে যায়। তারা বেশ ব্যস্ত হয়ে ওঠে।
‘ওয়া-আলাইকুম আস্সালাম। কাঁয় বাহে? কোঠকার ছইল তুই? অমিত ব্যাটা নাকি?’
‘হয় চাচা মুই-এ। হাট করি আলেন?’
‘হয় বা, তুই ফির এত রাইতত্ চেরাডাঙি থাকি আইলু?’
‘হয়!’
‘তোর বাপে সেখন চোখ ফুলি কাহিল হইছে, খবর পাইছি নআয়?’
‘হয় চাচা সেই তনে মন মানিল না। চলি আইনু।’
‘ভাল করিছি বা, মা-বাপ হলি বড় ধন; যার মা-বাপ নাই, তার কেহ নাই।’
অমিত তার গ্রামের মানুষ পেয়ে গেছে। তার বুকে নির্ভরতার স্বস্তি মৃদুমন্দ বাতাসে ভেসে বেড়ায়। তখন কাঁকড়া নদীর বুকে বয়ে যাওয়া স্রোতের শব্দ খুব কাছাকাছি হতে থাকে। নৌকা বয়ে চলা দাঁড়ের আওয়াজ ভেসে আসে। অমিত জানে, নদী পেরিয়ে ঈশান কোণের রাস্তা ধরে কিছু দূর যেতে হবে। তার পাশে চিরিনদীর পাড় পুব দিকে এগিয়ে গেছে। আর কিছু দূর এগোলে বাঁ-দিকে ছোট একটি সাঁকো। সেই সাঁকো পেরিয়ে তার গ্রামের সরু পথ। এখন আর কোনো ভাবনা নেই।
আজকালের খবর/আরইউ