শুক্রবার ২৫ এপ্রিল ২০২৫
মহাবিশ্বের মহারহস্য ভেদে প্রাণান্তর চেষ্টা
অলোক আচার্য
প্রকাশ: বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ৭:০২ PM
‘থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে, দেখবো এবার জগতটাকে, কেমন করে ঘুরছে মানুষ, যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে- কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই কবিতা প্রমাণ করে বিশ্বকে জানার আকাক্সক্ষা মানুষের চিরকালের অভিপ্রায়। তবে মানুষ কেবল এই বিশ্ব নিয়ে জানতে বা গবেষণা করতেই বসে নেই, মানুষ ছুটছে মহাবিশে^র টানে। এই মহাবিশ্বের গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি, ছায়াপথ, ধূমকেতু সবকিছু নিয়েই মানুষ জানতে আগ্রহী। জ্যোতির্বিদরা মনে করছেন যে দৃশ্যমান মহাবিশ্বে প্রায় ১০০ বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে। মানুষ জানতে চায় কীভাবে এই মহাবিশ্বের জন্ম হলো, প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হলো কীভাবে, প্রথম আলোর বিচ্ছুরণ কেমন ছিল এসব মানুষের আগ্রহের বিষয়বস্তু। এই বিশ্ব হলো এই বিশাল মহাবিশ্বের একটু ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। কারণ এই মহাবিশ্ব ঠিক কতবড় তার স্পষ্ট পরিমাপ নেই। কারণ মহাবিশ্ব এখনো প্রসারিত হচ্ছে। ঠিক একারণেই মহাবিশ্ব কত বড় তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। স্যার এডিংটনের মতে, প্রতি গ্যালাক্সিতে গড়ে দশ সহস্রকোটি নক্ষত্র রয়েছে। বিভিন্ন তত্ত্ব এবং তথ্য দিয়ে মহাবিশ্ব সম্পর্কে একটি ধারণা দাড় করানো হয়েছে মাত্র। তবে মানুষ থেমে নেই। জ্ঞান-বিজ্ঞানে উন্নত হওয়ার পর থেকেই মানুষ চেষ্টা করছে মহাবিশ্বের রহস্য জানার। অনন্ত নক্ষত্রবিথীর দিকে তাকিয়ে সেই রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছে মানুষ। তবে এই অনন্ত মহাবিশ্বের রহস্যের খুব কমই এখন পর্যন্ত মানুষের চোখের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। এই তো এসব রহস্য জানতে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও বড় টেলিস্কোপ মহাকাশে যাত্রা করেছে সফলভাবে। এই টেলিস্কোপ দিয়ে বিজ্ঞানীরা বহুদিনের এই মহাবিশ্বের অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর জানতে চায়। মহাবিশ্ব নিয়ে বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের মাধ্যমে এক হাজার ৩৮০ কোটি বছর আগে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির পর এখন যা যা আছে গ্যালাক্সি, গ্রহ ইত্যাদি ছাড়াও মানুষ কীভাবে এলো সেটাও জানতে চায়। বিগ ব্যাং মডেল অনুযায়ী মহাবিশে^র শুরু হয়েছিল একটি ভিষণ ঘন ও উষ্ণ অবস্থা থেকে। তারপর থেকে এটি সম্প্রসারমান। এর ফলে এক গ্যালাক্সি অন্য গ্যালাক্সি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বর্তমানের এই টেলিস্কোটটি হাবল টেলিস্কোপের উত্তরসূরি। এই টেলিস্কোপটি ভূ-পৃষ্ঠ থেকে সাড়ে পাঁচশ কিলোমিটার উঁচুতে ছিল। এসব ছাড়াও ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ত্বসহ আরো নানা বিষয় নিয়ে কাজ করবে বিজ্ঞানীরা। এই তো মঙ্গলের গিরিখাতে পানির সন্ধান পাওয়ার দাবি উঠেছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, মঙ্গলে পৃথিবীর সর্বোচ্চ গিরিখাত গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন-এর মতোই গিরিখাত রয়েছে। তাদের ধারণা এ গিরিখাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পানি থাকতে পারে। গিরিখাতটি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের চেয়ে ১০ গুণ দীর্ঘ, পাঁচ গুণ গভীর ও ২০ গুণ প্রশস্ত। এক্সোমার্স ট্রেস গ্যাস অরবিটারের ফাইন রেজল্যুশন এপিথার্মাল নিউট্রন ডিটেক্টর (ফ্রেন্ড) যন্ত্রে এ পানি শণাক্ত। কেন বিজ্ঞানীরা পানির অস্তিত্ত্বের খোঁজ করছেন? কারণ প্রাণের প্রধান উৎস পানি। 
এখন পর্যন্ত সৌরজগতের এই গ্রহটিতেই প্রাণ রয়েছে। তবে থেমে নেই মানুষ। মানুষ ছুটছে প্রাণের খোঁজে। প্রাণ টিকে থাকার আবশ্যকীয় সম্ভাবনাগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে বিজ্ঞানীরা। এই মহাবিশ্বের রয়েছে অনন্ত রহস্য। এই রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করছে গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষ। মানুষের সাথে পৃথিবীর অন্য প্রাণীর পার্থক্য হলো মানুষের কাছে রয়েছে মস্তিষ্ক নামক একটি সম্পদ। এই সম্পদের জেরেই মানুষ অন্যসব প্রাণীকে তার বশে রেখেছে। পৃৃথিবীর সব প্রাণী মানুষের কাছে মাথানত করেছে। পৃথিবীতে দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান বহু জীব, অনুজীব রয়েছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় রহস্য হলো মৃত্যু। এই মৃত্যু নিয়েও চলছে বিস্তর গবেষণা। মানুষ বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে আরো বহুবছর। এই মহাবিশে^র অন্য যে কোনো স্থানে প্রাণের অস্তিত্ত্ব থাকতে পারে এই বিশ্বাসে মানুষ গবেষণা করে চলেছে। এ নিয়ে বহুবার ইতিবাচক প্রমাণও পেয়েছে। অন্য গ্রহের প্রাণীদের আমরা এলিয়েন বলেই জানি। এইসব এলিয়েন কেমন হবে তাও আমরা জানি হলিউড-বলিউডে নির্মিত সিনেমা বা সিরিয়াল দেখে। ভুড়ি ভুড়ি সিনেমা নির্মান হয়েছে ভিনগ্রহের প্রাণীদের নিয়ে। ভিনগ্রহের প্রাণীরা কেমন হবে? ওরা কি জ্ঞান-বিজ্ঞানে মানুষের চেয়েও উন্নত হবে? এমন ধারণা থেকেই বহু সিনেমা নির্মিত হয়েছে। ভিনগ্রহের প্রাণীদের ব্যবহৃত যানকে আমরা বলি ফ্লাইং সসার। পৃথিবীতে ফ্লাইং সসারের আসার খবর বহু যুগ আগে থেকেই মানুষের জানা আছে। গোল চাকতির মতো একটি যান যা মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে যায়। 
পৃথিবীতে বহুবার ফ্লাইং সসার আসার ঘটনা ঘটেছে। তার স্বাক্ষী আছে মানুষ। চোখের নিমেষেই উধাও হয়ে যায় এসব যান। বছরের পর বছর কেবল রহস্যই ছড়িয়েছে এসব ভিনগ্রহের যানগুলো। কিন্তু কোনো কুল-কিনানা হয়নি। এতসব কথা কি মিথ্যে হবে? মহাবিশে^র কোথাও কি কোনো প্রাণের অস্তিত্ত্ব থাকতে পারে? মানুষের বিশ্বাস যে ভিন গ্রহের প্রাণী আছে। প্রাণের অস্তিত্ত্ব খুঁজতে গিয়ে প্রথমেই পানির অস্তিত্ত্ব খুঁজছে মানুষ। কারণ পানি হলো প্রাণের প্রধান উপাদান। পানি থাকলেই প্রাণ থাকার সম্ভাবনা থাকে। মানুষ যখন প্রথম অ্যাপোলো-১১ তো চড়ে চাঁদের বুকে পা রাখলো সেদিন থেকেই পৃথিবীর বাইরে মানুষের পদচারণার নবযাত্রা শুরু হয়েছিল। আজও চাঁদ নিয়ে মানুষ নিরন্তর গবেষণা চলছে। পৃথিবীর এই একমাত্র উপগ্রহের নানা প্রান্ত থেকে বিজ্ঞানীরা চাঁদের পাথর, মাটি সংগ্রহ করে বিশ্লেষণ করছেন। কোথাও পানির অস্তিত্ত্ব আছে কিনা তা জানতে চেষ্টা করছেন। চাঁদের পর আরো দু’টি সম্ভাবনাময় গ্রহ হলো মঙ্গল ও শুক্র। নাসার মহাকাশযান পারজিভারেন্স রোবট রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষার পর সফলভাবে মঙ্গলের বুকে অবতরণ করেছে। চাঁদের পাশাপাশি মঙ্গল গ্রহ নিয়েও মানুষ গবেষণা করছে নিরন্তর। কারণ সেখানেও যে রয়েছে প্রাণের সম্ভাবনা। হয়তো সময়ের কোনো এক খেলায় তা বিলুপ্ত হয়েছে। আবার গবেষণার ফলে তা ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। তবে সেসব কেবল সম্ভাবনামাত্র। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় আজ সবই সম্ভব। তাই আশা করা যায় এরকম একটি বাসস্থান ঠিক খুঁজে পাবে মানুষ যা পৃথিবীর বিকল্প হতে পারে। অথবা কোনো প্রাণী যা অন্য কোনো গ্রহে অবস্থান করছে তাদের সাথেও দেখা হবে। মঙ্গলে পৌঁছে সেখান থেকে ছবি পাঠাচ্ছে রোবটটি। গ্রহের বিষুব অঞ্চল, যার নাম জেযেরো, তার কাছে গভীর এক গহ্বরে এই রোবটটিকে নামানো হয়েছে। ধারণা করা হয় যে, জেযোরয় কয়েকশ কোটি বছর আগে বিশাল একটি হ্রদ ছিল। সেই হ্রদে ছিল প্রচুর পানি। এবং খুব সম্ভবত সেখানে প্রাণের অস্তিত্ত্ব ছিল। লক্ষ্য সেই একটাই। প্রাণের অস্তিত্ত্বের খোঁজ করা। আপাতত পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ত্ব নেই। অর্থাৎ মানুষ এই মহাবিশে^র সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী। 
ক্রমেই প্রসারিত হওয়া এই মহাবিশে^ কতদিন মানুষই সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হিসেবে পরিচিত সেটা একটি প্রশ্ন। তবে পৃথিবীর বাইরে বসবাসের উপযুক্ত একটি নিরাপদ বাসস্থান খোঁজার এই প্রচেষ্টা কি শুধুই কৌতুহল থেকে না এর পেছনে অন্য কোনো উদ্দেশ্যও রয়েছে? প্রথমত কৌতুহল তো বটেই। কারণ বিজ্ঞান মানেই তো কৌতুহল। আজ পর্যন্ত যা হয়েছে সবই মানুষের কৌতুহল থেকেই হয়েছে। তবে কৌতুহলের বাইরেও রয়েছে মানুষের প্রয়োজন। বলা হয় প্রয়োজনীয়তাই উদ্ভাবনের জনক। এখন পৃথিবীর বাইরে বাসযোগ্য গ্রহ খোঁজার প্রধান কারণ হলো মানুষ এই গ্রহে আর কত বছর টিকে থাকতে পারবে তা নিয়েই রয়েছে সন্দেহ। ক্রমেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে মানুষের প্রিয় ধরণী। তার দায় মানুষেরই। প্রতিদিন পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে দেখা দিয়েছে বহুমুখী সমস্যা। রয়েছে ভয়ংকর সব প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতিবছর এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে নাজেহাল হচ্ছে মানুষ। পৃথিবীতে কার্বন নিঃস্বরণের মাত্রা বাড়ছে। ওজোন স্তর ছিদ্র হচ্ছে। কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বাড়ছে। পৃথিবী উত্তপ্ত হচ্ছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতসব সমস্যা নিয়ে পৃথিবী আজ ভারাক্রান্ত। বিজ্ঞানীরা বলছেন ক্রমেই পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে। যদি সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণেই একটি বড় অংশ পানিতে ডুবে যায় তাহলে মানুষের আশ্রয় কোথায় হবে? আবার মানুষ মানুষকে মারার জন্য মারণাস্ত্র তৈরি করছে। এই মারণাস্ত্র দিয়ে মানুষ নিজেই নিজের ধ্বংসের কারণ হবে। পৃথিবীতে মানবজাতি ছাড়াও রয়েছে আরো অনেক প্রাণ। পৃথিবী বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে উঠলে সেসব প্রাণীর কী হবে? অন্য যে গ্রহ মানবজাতির পরবর্তী গন্তব্য হবে সেখানে কী ধরনের প্রাণ থাকবে? এতসব প্রশ্ন রয়েছে এর সাথে জড়িয়ে।
মঙ্গলের বাইরে মানুষের শুক্র গ্রহ নিয়ে আগ্রহ রয়েছে। কারণ শুক্র পৃথিবীর সবচেয়ে নিকটতম গ্রহ। আকারে ছোট হলেও এর গঠন পৃথিবীর সাথে মিল রয়েছে। সূর্যের থেকে দূরত্ব বিবেচনায় এটি দ্বিতীয় গ্রহ। পৃথিবী তৃতীয়। বিশাল এই মহাকাশ নিয়ে পৃথিবীর বিজ্ঞানী এমনকি সাধারণ মানুষের আগ্রহের শেষ নেই। কী আছে এত বিশাল এই মহাকাশে? কোটি কোটি নক্ষত্রবিথী, নিহারীকা, উল্কা, ধূমকেতু, গ্রহাণুপুঞ্জ আরো কত কত সব নাম যা মানুষের কৌতুহলের কারণ। এর কোথায় বা কোন অংশে মানুষের মতোই বা মানুষের চেয়ে উন্নত ধরনের প্রাণী বাস করছে। তারা হয়তো প্রতীক্ষা করছে আমাদের সাথে যোগাযোগের। পৃথিবী থেকে অন্য কোনো গ্রহে পাওয়া যাবে প্রাণের অস্তিত্ত্ব। তারপর পৃথিবী নামক এই গ্রহটি হবে রূপকথার ইতিহাস। এই সম্প্রসারণশীল মহাবিশ^ নিয়ে মানব জাতির রয়েছে অপার রহস্য। সেই রহস্য ভেদ করতেই মানুষের এত শ্রম। মানুষ জানতে চায় এই গ্রহ নক্ষত্র কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে? এই বিপুল শক্তির উৎস কী? একদিন হয়তো সেই রহস্য ভেদ করা সম্ভব হবে। মানুষ জানতে পারবে এই মহাবিশে^র মহারহস্য! 

লেখক : শিক্ষক, কলাম ও মুক্তগদ্য লেখক। 
আজকালের খবর/আরইউ