শুক্রবার ২৫ এপ্রিল ২০২৫
সুবর্ণজয়ন্তীতে একজন তরুণের আগামীর ভাবনা
মোহাম্মদ হাসান
প্রকাশ: বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ৬:৫৯ PM
একাত্তর শব্দটি চিরচেনা একটি শব্দ। একাত্তর মানে চিরঞ্জীব। বাংলাদেশের ইতিহাসে একাত্তরের ইতিহাস কোনোদিন মুছে  যাবে না। সবুজের বুকে লাল রঙের তুলি দিয়ে লেখা হৃদয়ে। কেউ চাইলেও মুছতে পারবে না। যদি মুছতে চায়, জীবন নামক শব্দটিকে পৃথিবীকে বিদায় দিয়ে দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ‘আমার প্রাণে বাজে সোনার বাংলার চিরচেনা সুর’। আমাদের মাঝে মাঝে সুরকে খোঁজার জন্য পথ হারিয়ে যেতে হয়। পথ হারিয়ে চিরচেনা মাটির স্পর্শে ফিরে আসার খুব ইচ্ছে হয়। কেউ কেউ অভিমানি হয়ে স্বদেশের মাটির প্রতি টান থাকে না। কিন্তু দূরপ্রবাসে থেকে শূন্যপাতায় মনে মনে চিঠি লিখে-প্রিয় স্বদেশ-আমি তোমায় ভালোবাসি। ভালোবাসি প্রিয় মাটির মানুষকে। কিন্তু সে চিঠিগুলো দেশের কিনারায় আসে না। বাঁধা হয়ে যায় হাজারো মাইলের পথের বাঁকে।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসটি আমাদের কাছে চিরচেনা। এই ইতিহাস আমাদের গৌরবের অর্জন। এই অর্জন আমাদের সামনে এইভাবে আসেনি। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলার ইতিহাস। শহীদের রক্তে পৃথিবীর মানচিত্রে অঙ্কিত হয়েছে লাল-সবুজের পতাকার সীমারেখা। এই সীমারেখা আমাদের দেশের সূর্যসন্তানের বিনিময়ে পেয়েছি। তারাই আমাদের গৌরব। মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় ভূমিকায় ছিলেন আমাদের বুদ্ধিজীবীরা। তাদের মেধার বিনিময় সাথে আমাদের দেশের সকল বয়সী মুক্তিযুদ্ধারা অগ্রগতির ভূমিকা  রেখেছেন। তাইতো বিজয়ের ঠিক আগে আগে বুদ্ধিজীবীদের তালিকা করে হত্যা করা হয়। যেন স্বাধীন দেশ ঠিক স্বাধীনতা ভোগ না করতে পারে। অর্থাৎ মেধাশূন্য একটি জাতি হিসেবে বাঙালি আত্মপ্রকাশ করে। সে ভিন্ন প্রসংগ। 
আগামী প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশা অনুযায়ী কর্মের প্রত্যাশায় আমাদের প্রজন্ম অনেক দূর এগিয়ে যাবে। আমাদের প্রজন্ম আজ বিশ্বের সবকটি অভাবনীয় স্থান দখল করতে শুরু করেছে। শুধু দখল নয় অত্যন্ত গৌরবের সাথে লাল-সবুজের পতাকা পৃথিবীর বুকে ধারণ করে চিহ্ন রেখে আসছেন। 
একসময় বাংলাদেশের তারুণ্যের আধুনিকতার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে ছিলো। এখন বাংলাদেশের তারুণ্য দিন দিন লাল রক্তের মতো ঝলসে ওঠছে পৃথিবীর মানচিত্রে। সকল প্রযুক্তির কিনারায় আমাদের প্রজন্ম। বাংলাদেশের ৫০-এর সুবর্ণজয়ন্তীর অগ্রগতিতে আজ সবচেয়ে বেশি মনে করতে হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধাদের অবদান। তাদের রক্তের প্রতিটি কণা বলে দেয়, বাংলাদেশের অবস্থান কতটুকু হওয়া দরকার?
আমাদের লাল-সবুজের বিজয় অর্জিত হওয়া এবং আমাদের প্রজন্মের কাছে তারুণ্যের প্রভাব কী ভূমিকা রাখে। এই বিজয় আমাদের তারুণ্যকে উল্লাসিত করে নতুন প্রজন্মের কাছে। আমরাও পাড়বো আমাদের আশানিত লক্ষ্যে। যেমনটা করেছে আমাদের উত্তর প্রজন্মের শহীদ বুদ্ধিজীবী, মুক্তিবাহিনী, গেরিলাবাহিনী, গ্রাম্য মুক্তিবাহিনীরা নিজেদের জীবন বাজি রেখে।
৫০ বছরের আমাদের আগামীর প্রজন্মের কাছে কিছু ব্যর্থতা তুলে ধরতে হবে। কেন তুলে ধরতে হবে? কারণ, আমরা স্বাধীনতার ৫০ বছরে পারিনি, আমাদের দেশের মধ্যে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে। এখন হিসাব মেলাতে পারিনি-দুই দেশের তিস্তা পানির হিসাব। দেশের ব্যাণিজিক খাতের হিসাব মিলাতে পারছি না। 
আমাদের দেশের অনেক মানুষ আছে যাদের খাদ্য, বাসস্থান ইত্যাদি পরিপূর্ণ ছিলো না কখনোই। প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের ভূমিহীনদের ভূমি ও ঘর তৈরি করার প্রয়াস চালাচ্ছেন। আশা করি ক্রমে দেশের সব শাখায় তার হাত ধরে অগ্রগতি হবে।  
৫০ বছরে দেশ শোষণ ও  বৈষম্যহীন হয়নি। তেমনটি হলে সঠিক জায়গা পেতাম আমরা। কিন্তু ৫০ বছরে আমরা সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। আমার এখানো দেশের ভিসা নিয়ে আত্মনির্ভরশীল হতে পারিনি। সেই অবস্থান থেকে আমাদের দেশের সামগ্রিক জাতীয় বিকাশে গণতন্ত্রের ধারা ঘড়ির কাটার বিপরীতে চলছে।
আমাদের মূল লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে, দেশের সাম্যের অবদান ঠিক রাখতে হবে। রক্তে লেখা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে দাম্ভিকতা এবং হিংসাত্নক, গুম, ধর্ষণ, পরিবারিক কোলাহল বেড়েই চলছে। দেশের সাম্প্রদায়িকতার মূল এখনো উপড়ানো যায়নি। চিরকালীন বাংলা ছিল সব ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের। কিন্তু ইদানিং তা ফিঁকে হতে চলেছে।  
গত ৫০ বছরে দেশকে আমরা কী দিলাম, আর কী নিলাম, আর দেশ আমাদের কী দিল আর নিল সেই প্রশ্ন চলে আসে বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তীর ক্ষণে। আর বাকি ৫০ বছরে আমরা কী দিব, আর দেশ আমাদের কী দিবে এখন সেই প্রশ্ন করার কিংবা ভাবারও সময় এসেছে। 
বলতে হয় গত ৫০ বছরে আমরা যা পেয়েছি তা অনেক। আমাদের আগামী ৫০ বছর দেশ থেকে পাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা। এ ব্যক্তিগত মতামত। আমাদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে এখন সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে পারিনি। তাই শিক্ষা খাতকে দক্ষ তরুণ প্রজন্ম সৃষ্টির জন্য তৈরি করতে হবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ধারা পরিবর্তনের জন্য কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করে দেশের সেবায় নিয়োজিত করতে জাগরণের আশার স্থান তৈরি করতে হবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মের রক্তে লেখা অর্জিত বিজয়ের কাহিনী তুলে ধরতে হবে। শুধু স্বাধীনতা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর আসলে বেশি বেশি জাতীয় সঙ্গীত শুনার খুব বেশি প্রয়োজন নেই। প্রজন্মের কাছে বিজয়ের গৌরবময় কাহিনী তুলে ধরতে হবে। আমাদের তরুণ সমাজ আজ খুব বেশি নেটে আসক্ত। সেই জেনারেশনের কাছে দেশের অতীত, বর্তমান তুলে ধরতে হবে। আগামীর করণীয় কী তা বুঝাতে হবে। তাদের জানাতে হবে মুক্তিযুদ্ধ মানে- ন্যায়বিচারের সাম্যবাদ। দেশে স্বাধীন মত প্রকাশের ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে তরুণ সমাজকে এগিয়ে আসার পথ তৈরি করতে হবে। ছাত্র রাজনীতির কারণে বিকলাঙ্গ প্রজন্ম তৈরি করা বন্ধ করতে হবে। কারো অধিকার ক্ষীণ না হয় সে ব্যবস্থা করতে হবে।
কতটুকু গণতন্ত্র আমাদের মাঝে আছে তা বিবেচনার ভার আপনার-আমার। সঠিকভাবে গণতন্ত্র ব্যবহার করতে হবে। শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার সময়ে কাধে কাধ মিলিয়ে চলেছি; এখন দেশের বেকারতা হ্রাসে, স্বাধীন মত প্রকাশে এবং একইসঙ্গে প্রত্যেকটি অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কাজ করার ক্ষেত্রে তেমনটি করতে হবে। দেশের সকল ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পৌঁছে দিতে হবে। আমাদের প্রজন্ম সঠিক ইতিহাস জানুক, সঠিকভাবে বেড়ে ওঠুক। এই সকল প্রত্যাশা যেন আগামী ৫০ বছরে পূর্ণ হয়। 
উত্তর বা আধুনিক প্রজন্ম দেখতে চায় বাংলাদেশ আগামী ৫০ বছরে বিশে^র বুকে ঈর্ষণীয় অবস্থানে পৌঁছেছে। 
আজ একদিকে বিজয়ের উল্লাস অন্যদিকে অর্জনের জন্য হাজারো বেদনার অশ্রু। যারা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে শহীদ হয়েছেন, তাদের প্রতি সমবেদনা। আমাদের সুষ্ঠু ও সুন্দর দেশ গঠনে অগ্রগতির নায়কদের তৈরি করতে হবে। বিশ্বদরবারে আমাদের পৌঁছতে হলে সিদ্বান্ত আমাকে আপনাকে নিতে হবে? শুধু পরিকল্পনা বা রেখা অঙ্কন করলে হবে না। এটা বাস্তবে পরিণত করতে সিদ্বান্ত আপনার হাতে। তাই দেশকে সুষ্ঠু ও সুন্দর করে গড়ে তুলার জন্য তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা অপরিসীম। তাদের যোগ্য করে গড়ে তোলার কথা ভাবতে হবে অগ্রজদের, সরকার ও সংশ্লিষ্ট সব মহলকে। 
পরিশেষে বলা চলে দেশপ্রেমিক তৈরি করতে হবে। আশা করি বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের প্রতিটি তরুণ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে। তারা বুঝতে শিখবে বাংলা ও বাংলাদেশ কী? কীভাবে এসেছে আমার সোনার বাংলা। তাদের জানতে হবে ইতিহাস। কারা সূর্যসন্তান আর কারা দেশদ্রোহী। আশা করি আগামীর সময়ে প্রতিটি তরুণ বুঝতে শিখবে এসব। তবেই দাম দিয়ে কেনা বাংলা যাদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল সেই রক্তের ঋণ কিছুটা হলেও শোধ হবে। না হয় আজীবনের আক্ষেপ থেকে যাবে। সেই আক্ষেপ যেন ঘুচে যায় আগামী ৫০ বছরে।   

লেখক : শিক্ষার্থী ও সংবাদকর্মী। 
আজকালের খবর/আরইউ