প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২১, ৭:২৩ PM
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার লেখা ‘ভুল সবই ভুল’ গানটি শোনেননি বা পছন্দ করেন না এমন বাঙালি খুব কম আছে। সব ভুল কিন্তু ভুল না আবার সব দুর্ঘটনা কিন্তু দুর্ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক সময়ে ভুল আর দুর্ঘটনা আমরা পেঁচিয়ে ফেলেছি। এখন ভুল নিয়ে কি আগে বলবো না দুর্ঘটনা নিয়ে তা নিয়েই পরলাম বেকায়দায়। যাই হোক আগে ভুল দিয়েই শুরু করি। গত ১৬ ডিসেম্বর ছিল আমাদের বিজয়ের ৫০ বছর অর্থাৎ আমাদের বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী। মহান বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজা থেকে বিশ্বসভায় মাথা উঁচু করে চলতে দেশবাসীকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উন্নত-সমৃদ্ধ ও অসম্প্রদায়িক চেতনার সোনার বাংলা গড়ে তোলার শপথ পাঠের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। শপথ বাক্য পাঠ করান প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠানের ডায়াসের সামনে লিখা ছিল ‘সুবর্ণজয়ন্তী ও মজিবর্ষের শপথ’ এই লেখাটি। আয়োজনকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে না পারলেও দেশের সাধারণ মানুষ যখন বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে সরাসরি শপথ অনুষ্ঠান দেখছিলেন তাদের দৃষ্টি এড়াতে পারেনি। ডায়াসের সামনের ওই লিখাটিই ছিল ভুল। মুহূর্তে এই ভুল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় তুলে। পরে অবশ্য আয়োজকেরা এই ভুলের একটা ব্যাখাও দিয়েছেন। আয়োজকদের বক্তব্য, কারিগরি জটিলতার কারণেই এমনটা হয়েছে। ডিভাইস ট্রান্সফারের একপর্যায়ে ‘মুজিববর্ষের’ একটি ‘ব’ অক্ষর বাদ পড়ে গিয়েছে। এই তো গেল প্রধানমন্ত্রীর শপথ অনুষ্ঠানের ডায়াসের ভুল। ভোলার লালমোহন উপজেলা প্রশাসন ও কিন্তু তাদের সম্মাননা স্মারকে ‘মুজিববর্ষ’ বানান ভুল করতে ভুল করেনি। তারা তাদের সম্মাননা স্মারকে ‘মুজিববর্ষ’কে ‘মুবিজবর্ষ’ লিখেই চালিয়ে দিয়েছে। রাষ্ট্রীয় বা প্রাতিষ্ঠানিক পার্যায়ে এমন ভুল আমাদের দেশের জন্য নতুন কিছুই নয়। তার জন্য কার গাফিলতি তাও তেমন খোঁজ করা হয়নি। তবে আমাদের প্রশাসন ও রাষ্ট্র পরিচালনায় যে অনেক অযোগ্যরা যোগ্যতার স্থান দখল করে আছে তা কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখে না। মানুষের শারীরিক চিকিৎসায় আমাদের দেশে ভুল অহরহ ব্যাপার। বেশির ভাগ ডাক্তারের মন-মানষিকতা এতাটা বাণিজ্যনির্ভর যে তাদের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে টাকার গুরুত্ব অনেক অনেক বেশি। তাই কখনো তারা রোগীকে অপারেশন করার পর পেটে অপারেশনের সরঞ্জাম রেখেই সেলাই করে ফেলেন। কখনো আবার মুমূর্ষু রুগীর মাথার খুলি দেশে রেখে উন্নত চিকিৎসার জন্য এয়ার এ্যাম্বুলেন্সে করে রোগীকে বিদেশ পাঠিয়ে দেন। আর ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগের তো শেষ নেই। ইঞ্জিনিয়ারে ভুলে নানান প্রকল্পে গচ্চা দিতে হয় জনগনকে! নাম মিল বা ভুল তদন্ত প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন কারণে বছরের পর পর বিনা অপরাধে কারাবাসের ঘটনাও কি কম? মানুষের ভুল হওয়াটা স্বাভাবিক তবে বিশেষ ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যক্তির ভুল কখনোই ক্ষমা করা যায় না বা উচিত নয়।
যাই হোক বলতে চাচ্ছিলাম মনোরঞ্জন হাজংয়ের কথা। নেত্রকোনার কলমাকান্দার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য মনোরঞ্জন হাজং। জীবনের অনেকটা সময়ই পার করেছেন দেশের অস্তিত্ব রক্ষা জন্য। বিজিবির একজন হাবিলদার হয়ে চাকরি থেকে অবসর নিয়ে জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে পরিবারকে একটু স্বাচ্ছন্দ্যে রাখার জন্য চাকরি করতে একটি বেসরকারি সিকিউরিটি কোম্পানিতে। গত ২ ডিসেম্বর রাতে বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি সড়কে বিচারপতির রেজাউল হাসানের ছেলে সাইফ হাসানের বেপরোয়া গাড়িচাপায় আহত হন বিজিবির অবসরপ্রাপ্ত এই সদস্য মনোরঞ্জন হাজং। সেই সময় গাড়িতে আরো ছিলেন সাইফের স্ত্রী অন্তরা আর বন্ধু রোয়াদ। ঘটনার পর স্থানীয় লোকজন বিচারপতির সেই ছেলে সাইফ হাসানকে তার বিলাসবহুল বিএমডব্লিউ (ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৫-৪৯০৬) গাড়িতে থাকা তার স্ত্রী ও বন্ধুসহ বনানী থানায় পাঠায় আর আহত মনোরঞ্জন হাজংকে উদ্ধার করে পাঠানো হয় পঙ্গু হাসপাতালে। সেখানে ৯ দিন চিকিৎসার পর অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে বারডেম হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে গুরুতর অবস্থায় তিনি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন।
গাড়ি চাপা দেওয়ার পর সাইফ হাসানকে তাট স্ত্রী ও বন্ধুসহ আটক করলেও পরে কাউকে কিছু না জানিয়ে গাড়িসহ (ঢাকা মেট্রো-ঘ ১৫-৪৯০৬) সাইফকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। আর মনোরঞ্জনকে উদ্ধার করে পঙ্গু হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসকেরা তার একটি পা কেটে ফেলেন। পঙ্গু হাসপাতালে ৯ দিন চিকিৎসার পর অবস্থার অবনতি ঘটলে তাকে বারডেম হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। বর্তমানে গুরুতর অবস্থায় তিনি আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছেন। তবে মনোরজ্ঞন হাজংয়ের দুর্ভাগ্য যে চিরজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়েছে তাকে। মনোরঞ্জন হাজংয়ের মেয়ে মহুয়া হাজং ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সেন্ট্রাল কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারের কর্মকর্তা। মনোরঞ্জন একজন সাবেক বিজিবি সদস্য ও তার মেয়ে মহুয়া একজন পুলিশ অফিসার হওয়া স্বত্ত্বেও ও আইনের সঠিক আইনের সহযোগিতা তাদের ভাগ্যে জুটেনি। বনানী থানা পুলিশ বিচারপতি পুত্র সাইফ হাসানকে থানায় নেওয়ার কিছুক্ষণের ভেতরই গাড়িসহ ছেড়ে দেয়। আর মনোরঞ্জন হাজংয়ের মেয়ে পুলিশ অফিসার মহুয়া হাজংকে পিতার হত্যাচেষ্টার মামলা করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। দীর্ঘ ১৩ দিন পর নানা সমালোচনাকে মাটি চাপা দিতে গাড়ির ধাক্কায় অবসরপ্রাপ্ত বিজিবি সদস্য ও একজন পুলিশ অফিসারের বাবা গুরুতর আহত হওয়ার ঘটনায় মামলা নিয়েছে পুলিশ। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাস সবকিছু জানা-শোনার পরও, প্রমাণাদি ঠিক থকলেও মহুয়া হাজং কতৃক দায়ের করা মামলায় আসামী হলেন অজ্ঞাতনামা। তবে আশ্চর্য করার বিষয় হলো মহুয়া হাজংয়ের মামলা নেওয়ার ২ দিন আগেই তার পিতা মনোরঞ্জন হাজংয়ের বিরুদ্ধে রাজধানীর বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন তাকে চাপা দেওয়া বিএমডব্লিউ গাড়ির সেই প্রভাবশালী চালক সাইফ হাসান। এতে দুর্ঘটনার জন্য ভুক্তভোগীকেই পুরো দোষ দেওয়া হয়েছে। এমনকি এই ঘটনায় মনোরঞ্জন হাজংকে আসামি হিসেবে মামলা করা উচিত ছিল বলেও জিডিতে উল্লেখ রয়েছে। দুর্ঘটনার পর পর্যাপ্ত আর্থিক সহযোগিতা করা হয়েছে বলেও দাবি জিডি করা ব্যক্তির। সাইফ হাসান তার জিডিতে আরো অনেক বিষয় যোগ করেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের যথেষ্ট চেষ্টা করেছে। হয়তো কোনো এক সময় আমরা শুনবো সাইফ হাসান হয়তো আইনের কাছে নির্দোষই থাকবে। সমস্ত দোষ এসে বর্তাবে আজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মনোরজ্ঞন হাজং ও তার মেয়ে মহুয়া হাজংয়ের ওপর। জানা গেছে, অভিযুক্তের পরিবারের পক্ষ থেকে চিকিৎসার খরচসহ অন্যান্য সহায়তা করার মাধ্যমে আপসের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আপস করতে নারাজ মনোরঞ্জন হাজংয়ের পরিবার। মেয়ে মহুয়া নানা প্রতিকূলতার মাধ্যে পার করছেন তার বর্তমান সময়। একদিকে কর্মক্ষেত্রের চাপ অপর দিকে জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা বারা সু চিকিৎসা। মহুয়া তার পরও মামলা করতে পেরেছেন। জানি না মহুয়ার এত ত্যাগের ফসলের বিচার কি পাবে তার পরিবার?
আমাদের বিশ্বাস ছিল আইন সবার জন্য সমান-কিন্তু এখন বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ঘটনায় তা মানতে অনেকটাই কষ্ট হয়। আইন সবার জন্য সমান হলে বিচারপতির ছেলেকে বিচারের আওতায় আনতে কেন আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এত গড়িমসি? ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সদস্য হলেও মনোরঞ্জন হাজং একজন সাবেক বিজিবি সদস্য তার মেয়ে একজন পুলিশ অফিসার। তার পরও আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের কাছে আজ বড়ই অসহায়। এমনটিা যদি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ক্ষেত্রে ঘটে তা হলে যে কী হবে তাতো বলার অপেক্ষা রাখে না।
আজ মনোরঞ্জন হাজং একটি পা হারিয়ে তাহলে কি প্রমাণ করতে স্বার্থক হলেন যে আমাদের আইনব্যবস্থার পা দুটো আসলেই ভেঙে গেছে? আইনের প্রতি আমাদের এখনো সম্পূর্ণ আস্থা আছে বলে বিশ্বাস করি। তবে তার প্রমাণ হবে যথাযথ সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে। মনোরঞ্জন হাজং কখনোই আর সুস্থ জীবনে ফিরতে পারবেন না। মনোরঞ্জন তার পা ফিরে না পেলেও আইনের মাধ্যমে পা হারানোর সুষ্ঠু বিচার পাবেন এটাতো প্রত্যাশা করতে পারি!
লেখক : কলামিস্ট।
আজকালের খবর/আরইউ