
সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী একটা সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। এতে করে অনেক অনিশ্চয়তার মধ্যে দিয়ে গেছি আমরা। অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। জান ও মালের অফুরন্ত ক্ষতি পেরিয়ে আমরা স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু কেন? আমরা সবাই দেশকে ভালোবাসি। দেশকে ভালোবাসলে তাকে পেছনে ঠেলে ধরি কীভাবে? সব আন্দোলনেই রক্ত ঝরেছে। বায়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তর, একাত্তর ও নব্বই খ্রিস্টাব্দ এসবের উদাহরণ।
একপর্যায়ে পরিস্থিতি এতটাই নাজুক হয়ে পড়ে যে সরকারকে সেনাবাহিনী মোতায়েন ও কারফিউ জারি করতে হয়েছে। সারাদেশ কার্যত যোগাযোগবিহীন হয়ে ছিল, কিছুটা এখনো আছে। থেমে থেমে চলছে কারফিউ। এ থেকে পুরোপুরি নিস্তার পায়নি দেশ। সরকার পর্যায়ক্রমে কারফিউ তুলে নিচ্ছে। পুরো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতে আরো সময় লাগবে।
এখন অফিস-আদালত নিয়মিতভাবে চলছে। সেই সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থাও অনেকটা সচল হয়েছে। পুরোপুরি সচল হবে আশা করা যায় অল্প কিছুদিনের মধ্যে। এরপরও কি পুরো উপশম হবে ক্ষতের? যুগ যুগ রয়ে যাবে তা। প্রাণের চেয়ে মূল্যবান কী আছে? কোটার কুঠারাঘাতে সবচেয়ে বেশি ঝরেছে প্রাণ। সম্পদের হিসাব সহজে করা যাবে না। এর প্রভাব করোনার মতো রয়ে যাবে সুদূরপ্রসারি।
আমাদের দেশে গৃহযুদ্ধ নেই। তবে কেন এমন জিঘাংষা? কোটার আন্দোলন হরণ হয়েছে। পরে তা সরকারবিরোধী রূপ পায়। এতে সব পক্ষই চরম অসহিষ্ণুতা দেখিয়েছে। ক্ষতি হয়েছে দেশের। দেশ ধুঁকলে আপনাকে কষ্ট পেতে হবে। আর তা যদি না পান আপনি দেশপ্রেমিক নন। বিগত কিছুটা সময় সোনার বাংলা ধুঁকেছে। আমরা কি কষ্ট পাচ্ছি! এ ঘটনা সৃষ্টির কারণ অনেক। কারণের পেছনে মানুষ থাকে। তারা কি কষ্ট পাচ্ছেন? পেলে কি এমনটি করতেন? আগামীতেও কি এমনটি করতে পারেন তারা!
কোটাপ্রথা নিয়ে এবারের আন্দোলন ছিল দ্বিতীয় দফা। মূল আন্দোলন শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে। তার পরিপ্রেক্ষিতে ১২ এপ্রিল জাতীয় সংসদে ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের ঘোষণা দেন। একই বছর ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোটা বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। গত ৫ জুন ছয়জন ছাত্রের দায়েরকৃত রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন। ফলে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। ১ জুলাই থেকে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করেন, যা এখনো চলমান রয়েছে।
১৯৭২ সালে প্রণীত রাষ্ট্রীয় সংবিধানে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ আছে, সমাজে যারা সুবিধাবঞ্চিত তাদের কোটা সুবিধা দিতে হবে, যাতে তারা আর দশজন মানুষের মতো সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারে। রাষ্ট্র তাদের যদি বিশেষ সুবিধা দেয় তাহলে কোনো ক্ষতি নেই। ১৯৭২ সালে প্রথম কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। এরপর একাধিকবার কোটা পদ্ধতিতে পরিবর্তন সাধন করা হয়। ১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার স্বজনদের জন্য দেয়া কোটা বৃদ্ধি করা হয়।
কোটা কী? কোটা- সরকারি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে বলা চলে শেষ ধাপ। মেধায় সমপর্যায়ের হওয়ার পর বিশেষ একটি সুবিধা। সুবিধাটি পাবে যারা অনগ্রসর তারা। কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্র যাদের কাছে কৃতজ্ঞ তারা। এক্ষেত্রে কোটা সুবিধা পাওয়া জনগোষ্ঠী হলো- প্রতিবন্ধী, তৃতীয় লিঙ্গ, নারী, জেলার অধিবাসীরা এবং সর্বশেষ মুক্তিযোদ্ধার প্রজন্ম। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে এসব কোটার কিছু অনুপাত ধার্য করা হয়। ধীরে ধীরে অনগ্রসররা অগ্রসর হয়। প্রয়োজন পড়ে সংস্কারের। কিন্তু তা করতে গিয়ে কিংবা করার দাবিতে দেশ ধুঁকে যায়। তখনি কথা আসে। দেশকে কী আমরা সত্যিই ভালোবাসি?
সর্বশেষ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী মেধাভিত্তিক ৯৩ শতাংশ; মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনার সন্তানদের জন্য পাঁচ শতাংশ, আদিবাসী এক শতাংশ এবং শারীরিক প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য এক শতাংশ কোটা নির্ধারণ করা হয়েছে।
আদালতের প্রতি পুরোপুরি শ্রদ্ধা রেখে বলছি, এখনো অনেক জেলা অনগ্রসর। সেসব জেলার অধিবাসীরা চাকরিক্ষেত্রে কোটার সামান্য সুবিধা পেলে অগ্রসর জেলা হওয়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখতে পারত। এখনো নারী পুরুষশাসিত সমাজে অনগ্রসর। তাদের অগ্রসর হতে কোটা সহায়ক হতে পারত। আর মুক্তিযুদ্ধার সন্তানদের বয়স খুব বেশি চাকরি পাওয়ার সীমায় নেই। সেক্ষেত্রে কোটা সুবিধা তাদের নাতি-নাতনীদের জন্য রাখা শ্রেয় হতে পারত। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা উপহার; তারা চেয়ে নেননি। এ নিয়ে দর কষাকষি তাদের হেয় করে। আমি মনে করি, কোটা ব্যবস্থা থাকতে পারে, তবে তার ব্যাপক সংস্কার করা প্রয়োজন। অর্থাৎ কোটা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা নয়, বরং যৌক্তিক সংস্কারের মাধ্যমে সময়োপযোগী করা যেতে পারে।
কোটা নিয়ে নানা সময় আন্দোলন হয়েছে। এটি সংস্কার করা ছিল সময়ের দাবি। কিন্তু আদালত-ক্যাম্পাস-সরকার-রাজপথ গড়িয়েছে অনেক সময়। বিগত কিছুটা সময় যে প্রাণহানি হয়েছে তা কী পূরণ হবে কোনোকিছুতে? যে ভাই-বোনটি ঝরে পড়েছে তার পরিবার কি ভুলতে পারবে কখনো সময়টি। হারিয়ে যাওয়া বাংলার মানুষটির আত্মা কি আমাদের ক্ষমা করবে? সে হোক ছাত্র, পুলিশ, সংবাদকর্মী বা সাধারণ মানুষ। আমাদের বুঝতে হবে আমি কার প্রাণ হরণ করছি। ভুল করছি না তো। দেশকে না গড়ে কেন ভাঙছি? আমার মতে, কোটা যৌক্তিক অনেকের জন্য থাকতে পারত। কোটা হতে পারে গরীবেরও। তাদের অধিকার চাকরিতে বেশি। আরো অনেক অনেক অবহেলিত জনগোষ্ঠীর জন্য কোটা হতে পারে। সেসবের পুরোপুরি ও সঠিক ব্যবহারের পর খালি কোটা সাধারণ মেধায় পূরণ করা যেতে পারে। কোটাধারীরা সাধারণের চেয়ে কম যোগ্য নন।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মোড়কে দেশের অনিষ্টকারীরা উৎ পেতে ছিল। সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাঝে তারা ঢুকে পড়ে। সর্বশেষ কোটা আন্দোলন দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে চলে যায়। কোটার সহজিয়া দাবি ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করে এক কিংবা একাধিক গোষ্ঠী। তারা জ্বালাও-পোড়াও ও মানুষ হত্যার ‘আনন্দে’ মেতে ওঠে। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেওয়া হয় রাষ্ট্রের সম্পদ। তার মধ্যে কী নেই? ধীরে ধীরে ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করা হচ্ছে। এ ক্ষতি অনেক। টাকার অঙ্কে তা কোথায় ঠেকে বলা দুষ্কর।
জ্বলেছে বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, সেতু ভবন, ডাটা সেন্টার, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরসহ অগুনতি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। একটি খবর বলে, শুধু ঢাকাতেই রাষ্ট্রের ৭৯টি স্থাপনা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়েছে।
কিছু ভাবনা হোক এবার। যে ছাত্রটি ঝরে পড়ল সে আমার বাংলারই সন্তান। তার জন্য আজীবন ধুঁকে যাবে একটি পরিবার; বাবা-মা-ভাই-বোন। তার বুকে কেন গুলি চালাতেই হলো। যে পুলিশ ভাই মরল সে সাধারণ ঘর থেকেই উঠে আসা, আমার-আপনার কারো ভাই। তারও সোনার বাংলা গড়ায় অবদান আছে। সেও বাংলাকেই ভালোবাসে। কিন্তু অতি উৎসাহী সমাজ, বাংলার ভালোবাসায় নেই। তাদের নির্মূলের সময় এখন। আমার-আপনাকে ভাবতে হবে কাকে কে আঘাত করছি? কার চাওয়া কী? না দুজনের চাওয়া একই!
যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের কালো মানুষদের জন্য শিক্ষালয়ে ভর্তি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা রয়েছে। এই সব বিষয় নিয়ে সেই দেশে একাধিক মামলা হয়েছে এবং তা আদালতের মাধ্যমে সুরাহা হয়েছে। ভারতের কোটা পদ্ধতি অনেক ব্যাপক। সেখানে ৬০ শতাংশ সরকারি চাকরি কোটার মাধ্যমে পূরণ করা হয়। সেনাবাহিনীতেও এই কোটার মাধ্যমে সেনা সদস্য নিয়োগপ্রাপ্ত হয়। একই ব্যবস্থা পাকিস্তানেও। দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, ফ্রান্স, ব্রিটেনসহ ইউরোপের অনেক দেশেই নানা রকমের কোটা ব্যবস্থা ছিল ও আছে।
কোনোটা লিঙ্গবৈষম্য কমাতে, কোনোটা হয়তো বয়স্ক মানুষকে চাকরির সুযোগ করে দিতে। এই কোটা ব্যবস্থা সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চালু আছে। অন্যদিকে জাতিসংঘসহ সব আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশসহ সব সদস্য দেশের জন্য কোটা সংরক্ষিত আছে। পাকিস্তান আমলে সেনাবাহিনীর কথা বাদ দিলেও সরকারি অন্যান্য চাকরিতে সর্বক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া তৎকালীন পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের জন্য বিভিন্ন সময়ে বাঙালি রাজনীতিবিদরা সরকারি চাকরিতে বাঙালিদের জন্য কোটা সংরক্ষণের দাবি করে ব্যর্থ হয়েছেন।
পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামলে পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরি পাওয়া ছিল বাঙালিদের জন্য সোনার হরিণ পাওয়ার মতো। দেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সরকারি চাকরিতে এই কোটা পদ্ধতি চালু করেছিলেন। এটি তাদের জন্য কোনো উপহার ছিল না। এটি ছিল দেশের জন্য তাদের যে আত্মত্যাগ তার জন্য তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
১৯৭৫ সালের পর সব সামরিক- বেসামরিক সরকার অলিখিতভাবে এই কোটা ব্যবস্থা স্থগিত করেছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার ‘অপরাধে’ অনেককে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। কোটা ব্যবস্থার যে সংস্কার প্রয়োজন তা কেউ অস্বীকার করবে না। সব দেশে তাই করা হয়।
এদিকে হতাহত ও হামলার ঘটনার তদন্ত ও বিচার নিয়ে জনমনে নানা প্রশ্ন উঠেছে। ন্যায়বিচারের জন্য যেকোনো ঘটনার সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত প্রয়োজন। ইতোমধ্যে সরকার বিচারপতি খোন্দকার দিলীরুজ্জামানের নেতৃত্বে তদন্ত কমিশন করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সেটি হত্যার বিচারে খুব একটা সহায়ক হবে না। ইনকোয়ারি অ্যাক্ট-১৯৫২-এর অধীনে গঠিত এই কমিশন সমস্যার কারণ খুঁজে বের করবে এবং এর সমাধানে একটা সুপারিশ করবে। তদুপরি এই কমিশন সহিংসতার প্রথম দিনে সংঘটিত ছয়টি হত্যার বিষয়ে তদন্ত করবে বলে জানানো হয়েছে। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড হয়েছে দিলীরুজ্জামান কমিশন গঠনের পর। পরের ঘটনাবলি তাদের কার্যক্রমে আসবে কিনা, সেটি পরিষ্কার নয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যদিও বলেছেন, প্রতিটি হত্যার তদন্ত করবে কমিশন।
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও বাস্তব চিত্র বলে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সুযোগ নিয়ে গত কয়েক দিনে দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে। এমন বাংলা কারো কাম্য নয়। বরং কোটা বা সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিয়মিতভাবে যৌক্তিক ও বিজ্ঞান সম্মতভাবে সংস্কার করা উচিত। কিন্তু তা করতে গিয়ে কিংবা করার পথ পরিক্রমায় দেশদ্রোহীদের সুযোগ দেওয়া কোনো অবকাশ নয়। কারণ দাম দিয়েই কিনেছি আমরা এ বাংলা। কারো দানে পাওয়া নয়।
লেখক: সাংবাদিক, অর্থ সম্পাদক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে)।
আজকালের খবর/আরইউ