শনিবার ১৮ জানুয়ারি ২০২৫
শিশুদের ডেঙ্গু ও আমাদের করণীয়
ডা. মোহাম্মদ নূরুল্লাহ
প্রকাশ: বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৮:০১ PM আপডেট: ১১.১২.২০২৪ ৮:০৮ PM
ডেঙ্গু একটি ভাইরাসজনিত রোগ। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু হয়। সাধারণত জুলাই মাস থেকে অক্টোবর মাসের কাছাকাছি সময় ডেঙ্গু হয়। এ রোগ হওয়ার প্রবণতা এখন ডিসেম্বরেও দেখা যাচ্ছে। ডেঙ্গুর ধরন ও হওয়ার সময়কালও বদলে যাচ্ছে। তাই বলা চলে এখন আমরা ডেঙ্গুময় সময়েই আছি। বর্তমানে আমাদের হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী অনেক। অনেকে মারা যাচ্ছেন। আমরা প্রতিদিন অনেক রোগী পাচ্ছি এবং শয্যা সংকট তো আছেই। 

তবে আশার কথা সব ডেঙ্গু রোগীকে ভর্তির প্রয়োজনও নেই। আমরা যদি শুরু থেকেই ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত করতে পারি তবে রোগী বাসায় বসেই চিকিৎসা নিতে পারবে। এখানে আমাদের সচেতনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ডেঙ্গু হলে শিশুকে বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়াতে হবে। পানি, খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি বা গ্লুকোজের পানি বারবার খাওয়াতে হবে শিশুকে। তবে হেমোরেজিক ডেঙ্গু কিংবা ডেঙ্গু শক সিনড্রোমের ক্ষেত্রে রোগীর জীবননাশের আশঙ্কা থাকে। এজন্য শুরু থেকেই চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকা জরুরি। এতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জীবননাশের ঝুঁকি কমে যায় অনেকাংশে।

একটু ভয়ের কথা সাধারণত নভেম্বর-ডিসেম্বরে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসে। দেশে গত ২৪ বছরের অভিজ্ঞতা এমনই। কিন্তু এবার এর ব্যতিক্রম হচ্ছে।

আর এ বছর উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। তাদের মধ্যে আবার স্কুলগামী শিক্ষার্থী বেশি। বড় বিপদ হলো, শিশুরা ডেঙ্গুর মধ্যে অন্য রোগেও আক্রান্ত হচ্ছে।

সার্বিকভাবে মশার নিয়ন্ত্রণে জোর তৎপরতার অভাব আছে। স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ড যথাযথভাবে হচ্ছে না। স্কুলে বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিশুরা যে আক্রান্ত হচ্ছে না, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

চলতি বছর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকলেও মার্চ মাস থেকে তা কমতে থাকে। জুন পর্যন্তও একটা সহনীয় অবস্থায় ছিল। কিন্তু জুলাই থেকে তা বাড়তে থাকে। জুলাই ও আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির হয়ে আসে। জুলাইয়ের পর থেকে দেশে ডেঙ্গুর ব্যাপক বৃদ্ধিতে এর ভূমিকা আছে। 

ডেঙ্গু মশা সাধারণত সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেশি কামড়ায়। অর্থাত ডেঙ্গু উজ্জ্বল আলোতে কামড়ায়। দিনের বেলায় শিশুরা স্কুলে যায় বা বিকালের দিকে মাঠে খেলা করে। ওই সময়টিতে মশার কামড় খাওয়ার আশঙ্কাও থাকে।

ডেঙ্গু রোগের লক্ষণ: ডেঙ্গু রোগে সাধারণত জ্বর হয় । এই জ্বর ১০২ থেকে ১০৩ ডিগ্রি ফারেহাইট হতে পারে এবং এই জ্বরের সাথে শরীর ব্যথা, বমি বমি ভাব, পাতলা পায়খানা, চোখের নিচে ব্যথা, ক্ষুধামন্দা এগুলো হতে পারে। তবে সব রোগীর কিন্তু সব সমস্যা নাও থাকতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা জ্বর হলেই ডেঙ্গু ভাইরাসের পরীক্ষা দিচ্ছি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পজিটিভ পাচ্ছি। বড়দের পাশাপাশি শিশুরাও ডেঙ্গুতে খুব বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। আমাদের হাসপাতালে সাধারণত তিন ভাগের এক ভাগ শিশু ডেঙ্গু রোগী পাচ্ছি।

ডেঙ্গু হলে কী করব: প্রথমত, যে বাচ্চাদের জ্বর থাকে তাদেরকে আমরা ডেঙ্গু পরীক্ষা করব । খুব সহজে আমরা পরীক্ষা করতে পারি । আমরা প্রথম দিন রক্তের সিবিসি এবং ডেঙ্গু অ্যান্টিজেন পরীক্ষা করে থাকি । অ্যান্টিজেন আমরা তিন দিন পর্যন্ত পরীক্ষা করি তারপর পাঁচ দিন সাধারণত অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করতে পারি।

প্লাটিলেট নিয়ে অহেতুক ভয় নয়: সাধারণ মানুষের মধ্যে ধারণা হয়েছে যে, প্লাটিলেট কমে গেলেই রোগী খারাপ হয়ে যাবে তাই তারা অনেক সময় প্লাটিলেট ভালো থাকলে রোগীগুলোকে নিয়ে হাসপাতালে আসতে চাচ্ছে না এবং অবহেলা করছে । একটি ডেঙ্গু রোগী খারাপ হওয়া আমরা অনেকভাবে বুঝতে পারি, তার মধ্যে প্লাটিলেট একটি মাধ্যম মাত্র। ডেঙ্গু রোগী সন্দেহ হলে আমরা সাধারণত সিবিসি পরীক্ষা করি এবং সম্পূর্ণ শ্বেতকণিকা, রক্তের তরল অংশ ও কনিকাগুলোর অনুপাত যাকে আমরা হেমাটোক্রিট বলি ইত্যাদি দেখে আমরা বুঝতে পারি যে একটি শিশু স্বাভাবিক অবস্থা থেকে খারাপ দিকে যাচ্ছে কিনা এবং তখনই আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেই। এই তাৎক্ষণিক ব্যবস্থার কারণেই বেশিরভাগ ডেঙ্গু রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি সাধারণ মানুষের মতো শুধু প্লাটিলেটের দিকে তাকিয়ে থাকি তবে ভুল হবে ও খুব বড় ধরনের ক্ষতি হওয়ার শঙ্কার থাকে। অনেক সময় প্লাটিলেট ভালো থাকা অনেক রোগী খারাপ হয়ে যাচ্ছে আবার প্লাটিলেট খুব কম থাকা রোগী ও ভালো হয়ে যাচ্ছে।

ডেঙ্গু সাধারণত বিভিন্ন রকম তীব্রতা নিয়ে হয়, যেমন স্বাভাবিক ডেঙ্গু যার বাড়িতে চিকিৎসা সম্ভব শুধু বেশি বেশি তরল খাবার প্রদানের মাধ্যমে । অথবা ডেঙ্গুর সঙ্গে আরো অনেকগুলো বিপদ চিহ্ন থাকতে পারে যেমন- শরীরের কোথাও রক্তপাত হওয়া , তীব্র পেটে ব্যথা, শিশু নিস্তেজ হয়ে যাওয়া, বার বার বেশি বেশি বমি হওয়া ।

তাই প্রথমে একটি রোগী জ্বর নিয়ে আসলে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হতে হবে যে তার ডেঙ্গু আছে কি নেই এবং ডেঙ্গু থাকলে আমরা কিছু ওষুধ খেতে নিষেধ করি। যেমন- কোনো রকম ব্যথার ওষুধ না খাওয়া, অ্যান্টিবায়োটিক না দেওয়া, স্টেরোয়েড জাতীয় ওষুধ না খাওয়ানো।

ডেঙ্গু হলে কী করবেন: প্রথমত বাচ্চাকে বারে বারে তরল খাবার খাওয়ান। যেমন- খাবার স্যালাইন, ডাবের পানি, গ্লুকোজের পানি, চিড়ার পানি অথবা যে কোনো রকম তরল বারবার বেশি বেশি করে খাওয়াতে হবে যাতে একটি বাচ্চা ২৪ ঘণ্টায় কমপক্ষে ছয় বার প্রস্রাব করে। এতে বোঝা যাবে আপনার বাচ্চা পানিশূন্যতা রোধ করতে সক্ষম হয়েছে। তারপরেও আমাদের কিছু বাচ্চা আছে যাদের হাসপাতালে ভর্তি প্রয়োজন হয়। ভর্তি করে আমরা স্যালাইন ও অন্যান্য চিকিৎসা দেই। সবসময় ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া এবং ডাক্তারের পরামর্শ মতো ও সময় মতো ঠিকভাবে ভর্তি করলে এবং স্যালাইন ও অন্যান্য চিকিৎসা নিলে এই বাচ্চাগুলো খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরে যেতে পারে। যে বাচ্চার ডেঙ্গু হয়েছে তাকে সারাদিন বাসার মধ্যে মশারির ভেতরে পর্যাপ্ত বিশ্রামে রাখতে হবে, যাতে আরেকটি সুস্থ মানুষকে সেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে দিতে না পারে।

সচেতনতা: ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে আমাদের কিছু সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে তার মধ্যে একটি হলো যে এডিস মশার আবাসস্থল ধ্বংস করা । এডিস মশা সাধারণত আমাদের খুব কাছে আমাদের ঘরের চার পাশেই থাকে এবং যেই জিনিসগুলো আমরা সাধারণত ব্যবহার করি সেগুলোতে তারা বংশবৃদ্ধি করে। যেমন আমাদের ফুলের টব, ডাবের খোসা, ফ্রিজের জমে থাকা পানি, ফেলে দেওয়া বোতল, টায়ার, ছাদ বাগানের জায়গা। এ সব জায়গায় তিন দিনের বেশি পানি জমে থাকলে এডিস মশার বংশবৃদ্ধি হতে পারে। পানি যেন তিনদিনের বেশি জমে থাকতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে এবং আমরা যদি দিনের বেলা বিশ্রাম নেই তাহলে অবশ্যই মশারি টাঙাতে হবে কারণ এডিস মশা দিনের বেলায় কামড় দেয়।

ডেঙ্গু নিয়ে আমরা কিছু বার্তা দিতে সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে পারি, যেমন- ‘ফুলের টব ডাবের খোসা প্লাস্টিকের কৌটা/ডেঙ্গুর আবাসস্থল- থাকবে না পানি এক ফোঁটা’; ‘যদি ডেঙ্গু থেকে বাঁচতে চান/এডিস মশার বংশবৃদ্ধি কমান’; ‘ছোট্ট একটি মশা-সাবধান/ডেঙ্গু প্রতিরোধে হও আগুয়ান’।

পরিশেষে বলতে চাই যে ডেঙ্গু প্রতিরোধে এবং ডেঙ্গুর চিকিৎসায় সচেতনতাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি সচেতন থাকি তাহলে ডেঙ্গু হওয়ার শঙ্কা খুব কম। আর যদি ডেঙ্গু হয়েও যায় তবে সময়মতো চিকিৎসা নিলে একটি মৃত্যুও আর ডেঙ্গু থেকে হবে না।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, দিনাজপুর মেডিক্যাল কলেজ। 

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
যে খাবার শরীরের ক্ষতি ডেকে আনে
শীত আরও বাড়বে বলছে আবহাওয়া অধিদপ্তর
ইমাম-মুয়াজ্জিন ও খাদেমরা পাবেন সম্মানী ভাতা, কে কত?
বই থেকে 'আদিবাসী' গ্রাফিতি বাদ দেওয়ায় টিআইবির উদ্বেগ
পঞ্চগড়ে শৈত্যপ্রবাহ কাটলেও কমছে না শীতের দাপট
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
অপহরণ বাণিজ্য বন্ধে সেনাবাহিনীর অভিযান চান টেকনাফের মানুষ
মাহফিলে সুদের বিরুদ্ধে কথা বললেন হাসনাত আবদুল্লাহ
সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আওয়মী লীগের জয়জয়কার
গাজীপুরে শ্রমিক নেতা আব্দুল হামিদের দাফন সম্পন্ন
জাবি ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাহমুদ-কৌশিকসহ ছয় নেতা বহিষ্কার
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft